শরৎ শিউলি কাশবন
অনেক দিন পর গ্রামে এলাম। সেই চেনা পরিবেশ; হাঁটছি। সেই প্রকৃতি, বুক ভরে দম নিচ্ছি। চারপাশ দেখছি। আমার সেই চির পরিচিত ব্রহ্মপুত্র, কাশবন, বুনোফুল সবই যেন একান্তই আমার। স্মৃতিতে রাঙ্গা সেই ব্রহ্মপুত্র, ব্রহ্মপুত্র তীরের প্রকৃতি-পরিবেশ যেখানে আমার জীবনের অনেক মধুর সময় অতিবাহিত হয়েছে; ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যাই।হঠাৎ দেখি দূরে ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে আসছে কে যেন। মনে হল পরিচিত। হ্যা পরিচিত সেই হাঁটার ভঙ্গি, শারিরিক গঠন, চুলের ভাঁজ, মুখাবয়ব; সুমন আমাকে চিনল না। আমার ছেলেবেলার বন্ধু।
আনমনে হেঁটে যাচ্ছি কাশবনের পাশ দিয়ে। সাদা ফুল ফুটে আছে; ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তুলোর মতন নরম পাপড়িগুলো, বাতাসে দুলে ওঠে উড়ে এসে আমার গায়ে। মনে হলো চিরচেনা কেউ যেনো ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়। একটি নাম না জানা পাখি ঘাসে ঠোকর দিতে দিতে আমার দিকে তাকায়; ডেকে ওঠে। মনে হলো বলছে, “ফিরে এসেছ, স্বাগতম।”
একটু দূর এগিয়ে একটি খেকশিয়াল দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ; আমার দিকে।
হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখি, একঝাঁক প্রজাপতি উড়ে আসছে আমার পাশে পাশে। উড়ে বেড়াতে লাগলো আমার চারপাশে; রঙ-বেরঙ্গের পাখা মেলে। স্বাগত জানায় আমাকে।
এরই মধ্যে ডুবে যাই প্রকৃতির মাঝে; কখন যে সন্ধ্যে হয়ে এল টের পাই না।
হঠাৎ পিছন থেকে কে যেনো ডাকল, “এই যে শুনছেন?”
সেই পরিচিত কন্ঠ; কিছুক্ষণের জন্য ফিরে যাই অতীতে। দশ বছর আগে এমনি করেই কেউ একজন ডেকেছিল আমায়।
তখন শরৎকাল। আমি একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছি কাশবনের ভিতর দিয়ে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে তখন। পিছন থেকে মেয়ে কন্ঠে ডাক আসলো, “এই যে শুনছেন?”
পিছন ফিরে তাকাই; পাঁচজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “জ্বী বলেন।”
“আমার নাম শিউলি। ওরা আমার বান্ধবী। আমরা বেড়াতে এসেছিলাম, পথ হারিয়ে ফেলেছি।”
বললাম, “ঠিক আছে চলেন, পথ দেখিয়ে দিচ্ছি।”
তাদেরকে নিয়ে বড় রাস্তায় এলাম। এরই মধ্যে জানতে পারলাম, তারা মুমিনুন্নেসা মহিলা কলেজে পড়ে। কলেজ হোস্টেলে থাকে।
আমি তখন নাসিরাবাদ কলেজে পড়ি। ওদের কলেজের পাশেই থাকি। শেষ পর্যন্ত ওদের সাথেই বাসার দিকে রওয়ানা হলাম।
শিউলি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি সব সময়ই এখানে আসেন?”
আমি বললাম, “হ্যা আসি, প্রায় প্রতিদিনই আসি। কেন বলেন তো?”
ও থতমত খেয়ে গেল। বলল, “না মানে এমনিই।”
তারপর ওদের কলেজের সামনে এসে ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আর আমি চলে এলাম বাসায়। আমি তখনও বুঝতে পারি নি ঐ ঘটনাটা আমার জীবনে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে।
কয়েকদিন পর আবারও অন্যমনষ্ক হয়ে কাশবনে হাঁটছি। পিছন থেকে আবারও সেই মেয়ে কন্ঠের ডাক, “এই যে এই দিকে; শুনছেন?”
আমি থতমত খেয়ে তাকালাম। দেখি, আমাকে থতমত খেতে দেখে যে মেয়েটি হেসে কুটিকুটি হচ্ছে সে আর কেউ নয়; সেদিনকার সেই শিউলি। ঐ দিনই তাকে ভালভাবে দেখলাম। যতই দেখছিলাম ততই ভাল লাগছিল। আমি জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আপনি, এখানে?” প্রশ্নটা করার পর বুঝতে পারলাম, আমি বোকা বনে গেছি।
সে বলল, “কেন আমার আসতে মানা আছে নাকি?” আবারও হাসতে শুরু করলো। তারপর যখন বুঝতে পারল আমি বিব্রত হচ্ছি, সে চুপ করলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি একাই এসেছেন?”
সে হাসতে হাসতে উত্তর দিল, “আপনি তো দেখছি শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। সেজন্যই আমার সাথে যে আমার বান্ধবী আছে চোখেই পড়ে নি।” আবারও সেই পাগল করা হাসি। তার বান্ধবীকে দুঃখিত বলে, ওদেরকে সাথে নিয়েই হাঁটতে লাগলাম। কথা বলতে থাকলাম। যতই কথা বলছিলাম আরও বেশি করে ভাল লাগা আমাকে পেয়ে বসছিল। বুঝতে পারছিলাম তার ভিতরেও একই ঘটনা ঘটছে।
তারপর প্রায়ই দেখা হতো আমাদের। একসময় দেখা গেল আমরা প্রতিদিনই দেখা করছি। অবশেষে আমাদের ভাল লাগা, ভালবাসার কথা একজন আরেকজনকে জানালাম। আমাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো। এভাবে কেটে গেল ভাল লাগার, ভালবাসার দুইটি বছর। একসময় এলাকার সবাই জেনে গেল আমাদের সম্পর্কের কথা।
ইতোমধ্যেই আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। সে হোস্টেল ছেড়ে চলে গেল তাদের গ্রামের বাড়ীতে। এরপরও আমাদের যোগাযোগ ছিল। আমি মাঝে মাঝেই ওদের গ্রামে চলে যেতাম। আর শিউলি ওর ছোট বোনকে সাথে নিয়ে আমার কাছে চলে আসতো।
এভাবেই চলতে থাকলো আমাদের সময়। এক সময় উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশ হল। আমরা দুজনেই ভাল ফলাফল অর্জন করি। কোথায় ভর্তি হব সেই খোঁজ খবর নিতে থাকি। ঐ মুহূর্তে হঠাৎ শুনি তার বিয়ে। ছেলে বিদেশে থাকে, অনেক টাকা বেতন পায়। আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। শিউলিকে ঘরে এনে কি খাওয়াব, কি পরাব। আমার এখানে এসে সে শুধু কষ্টই পাবে। নাইবা আসুক সে আমার ঘরে, তবুও সে সুখে থাকুক।
আমি চলে এলাম ঢাকায়। আমার জীবনের শরৎ শেষ হয়ে যায়, শিউলি ঝরে যায়, কাশফুল ঝরে যায়।
তারপর আট বছর…………
আজ আবার; সেই শিউলি, সাথে তার স্বামী-সন্তান।
অন্ধকারে সে আমাকে চিনল না। আলোতেও চিনত কিনা! আমার মাথায় লম্বা চুল, গালভর্তি দাড়ি, গোঁফ, চেহারাও এখানে ওখানে ভেঙ্গে গেছে।
পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম। দেখলাম স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে আমার শিউলি।
আমি শান্ত্বনা খুঁজি; সে আমাকে এখনও ভালবাসে, আমাকে অনুভব করে। আর আমাকে নিয়ে স্মৃতির টানেই সে বার বার এখানে ফিরে আসে।