Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

অনেক কথা৭

: | : ০৮/০৯/২০১৩

সাহিত্যভাষা–

* একবার বন্ধুদের আড্ডায় আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী বড় ভাই হেসে বলল, আমি নাকি এক হাজার বছর আগে পৃথিবীতে আসার দরকার ছিল। তাঁর ধারণা, তখনকার মানুষ ছিল সৎ এবং পৃথিবী ছিল সত্য। আমার চলাফিরায় তিনি সেযুগের আভাস পায়। এযুগে এরকম মানুষের সাক্ষাৎ বিরল। আমার কথাবার্তা চিন্তাধারা সেযুগের মানুষের সঙ্গে মিলত ভাল। এ আধুনিকের বর্তমানে আমার স্থান খুব কঠিন। লেখালেখির হাত মোটামোটি হলেও অত্যাধুনিকের ফ্যাশনের আড়ম্বরে ফিকে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমার রচনার ধারাবর্ণনা খারাপ না–কিন্তু, কোথাও কোথাও পুরাতন-ভেলা থেকে ছিটকে পড়ে আমি নাকি নতুন প্লাবনে শুধু সাঁতার কাটি। দুর্বোধ্যের এ শৃঙ্খলবেড়ি খুলে তার গণ্ডি থেকে বের হয়ে আমাকে আধুনিকতার সাহেবিপোশাকে সরলতার আসমানীকে স্পর্শ করতে হবে। ‘পুরানো চাল ভাতে বাড়ে’ সেকথা বুঝে জ্বাল বেশি দিলে বাড়ার কথা দূরে থাক্‌‌, হাঁড়ি পুড়ে ছাই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাতাস যেদিকে ছুটে ছাতাটা সেদিকে ধরতে হয় বিপরিত হলে ছাতা আর মাথা দুটোই রক্ষা করা দায়। কথা সমীচীন, মন্তব্য একেবারে খাঁটি। আসলে আমি আধুনিকতা কী এখনো বুঝে ওঠতে পারি নি। মানুষ সোজা পথ ধরে চলতে অক্ষম। হয়তো আমার বেলায়ও অনেকটা সেরকম। তবু মনে করি : বাধাহীন পথিকের পথচলা যেমন সহজ–আধুনিক মানুষের ভাষা এবং জীবনটা আরও বেশি সহজ হওয়া দরকার। তজ্জন্যে মানুষকে ভুলতে হবে কঠিনত্বের পরিচয়–একথা সত্য। আমি যা পারলাম না অনেকে যে পারবে না–একথা মিথ্যা। আজ এ প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো কিছু অসম্ভব বলা যায় না। তা হলে ওরা কেন সহজত্ব লাভ করতে পারবে না! তবে আমার মনে হয়, সাহিত্যভাষা কখনো মানুষের দৈনন্দিনজীবনের কথপোকথনের ভাষা হবে না; কারণ সাহিত্য বা সাহিত্যের ভাষার একটা আলাদা মর্যাদা আছে, রস আছে, রূপ আছে। যদি তা কোনো কারণবশত দৈনন্দিনজীবনে নেমে আসে তা হলে আর মান থাকবে না, রস থাকবে না, রূপ থাকবে না। আলাপাদি অবশ্য সহজ হওয়া দরকার। কিন্তু ধারাবর্ণনা পুরাতন বা নতুন কী আমার জানা নেই। তবে হাঁ, এতটুকু জানি চলিতরীতিতে তৎসম শব্দের ব্যবহার যত কম করা যায় তত ভাল। কিন্তু তার রূপগঠন হতে হবে সুসংগত সুডৌল। বর্ণনায় থাকতে হবে প্রাণ ও প্রকৃতি–ফুল-পাখি, আকাশ-বাতাস, সাগর-নদী, অমল-আবর্জনা, লতা-পাতা-ঘাস এগুলোর রূপবর্ণনায় তো সাহিত্য এবং সাহিত্যশোভন? তা হলে? প্রকৃতি ছাড়া কখনো কি সাহিত্য হয়? আর প্রকৃতির রূপবর্ণনা যেখানে, সেখানে তো সুবোধ্য-দুর্বোধ্য এক-আধটু থাকবেই–এ কথাটা যেমন রূপরসের দাবি রাখে তদ্রূপ মানরক্ষার ভরসাও রাখে। মাকে আমরা যতই আধুনিকতার সুরে ডাকি মায়ের কণ্ঠ অভিন্ন…

 

বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার কালোপযোগী বিদ্যমান। তবে, ভাষাবিজ্ঞানও কি তাই? তা হলে ‘মা’ শব্দটাও কি কালের যাত্রায় ভেসে যাবে! পুরাতনের কার্যকারিতা কিন্তু নতুনে ধরে রাখতে পারে না–এটা সত্য বলে মানতে হবে। আমরা বর্তমানে অত্যাধুনিকতার যে সাহিত্যস্বাদ গ্রহণ করছি, তা বোধ হয় লৌহার কড়াইয়ে শাকপাতার ঘণ্ট? মাটির পাতিলের রান্নাস্বাদ কিন্তু আলাদা–অনেকটা নিরাময় বলাও যেতে পারে। আধুনিকতার থালাবাসনের ঠুংঠাঙে এসব ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী আজ হারানোর পথে নয় একেবারে হারিয়ে গেছে বলতে হয়। গরুর মাংসের স্বাদ যেমন মহিষের মাংসে পাওয়া যায় না তদ্রূপ হরিণের মাংসের স্বাদ মেষের মাংসে পাওয়া যাবে না। এখানে যার যার রুচির বিষয়বস্তু যার যার মতে। সেমতে এক-একজনের রচনাশৈলীও এক-একরকম এবং এক-একজনের রসনারুচিও এক-একরকম। তাই বলে–শিক্ষিতজন বলল ‘গাছ’ এবং মূর্খজন কেন ‘বৃক্ষ’ বলল সেটা নিয়ে তর্ক করা বোকামি বৈ কী? গাছ আর বৃক্ষের ব্যবধান বুঝে পাদপ বলা অপরাধ কী?

 

এবার আমার কতিপয় ধারাবর্ণনায় আসি :–

 

* বৃষ্টিস্নাত সকাল। বাসে সফর করছে অনি। পুরা নাম অনিরুদ্ধ হাওলাদার। সংসারে অনিকে সাদরে বরণ করে রুদ্ধকে যখন অনাদরের আবর্জনায় নিক্ষেপ করা হয় তখন পূর্ণরূপে রূপায়িত হয় ‘অনি’। বর্তমানে তাকে ‘অনিরুদ্ধ’ বললে বান্ধবমহলেও চেনা দায়। চালকের পিছনাসনে আসীন। রঙিন চশমা পরে আছে চোখে। না না–একেবারে রঙিন বলা সমীচীন হবে না, কালোর উপর ঘোলাটে ধূসর। বাইর থেকে চোখদুটো দেখার কোনো সুযোগ নেই। স্টপ স্টপে যাত্রী উঠানামা চলছে। শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। এ সময়টাতে বৃষ্টির উপর আস্থা রাখা যায় না, যখন তখন বর্ষণমুখর হয়ে উঠতে পারে–কখনো প্রবলাকারে মুষলধারে, কখনোবা মৃদু মৃদু থেমে থেমে। বর্তমানে আকাশের রঙ ফর্সা, তবু গুটিগুটি বৃষ্টিফোঁটা ঝরছে অজস্র। সাদা এপ্রন পরা একটি মেয়ে উঠে বসল চালকাসন ঘেঁষে অনির হাঁটুদুটো স্পর্শ করে একেবারে তার সম্মুখে। বৃষ্টিভেজা তরুণীর অবয়বে ফুটে উঠেছে অপ্সরারূপ! আপ্লুত চুলের গুচ্ছ বেয়ে ‘টপ’ ‘টপ’ করে ঝরে পড়ছে স্বচ্ছ জলের ফোঁটা। ললনার এক হাতে কিছু বইখাতা অন্য হাতে একটা পরিষ্কার চশমা ও সামান্য একটা লেখনী। সহজে বুঝা যাচ্ছে কোনেক কলেজছাত্রী, রওনা হয়েছে বিদ্যালয়োদ্দেশ্যে। পাশে বসা যাত্রিণীর সঙ্গে টুকটাক আলাপে জানা গেছে, ছাতা একটা সঙ্গে ছিল কিন্তু কলমটা কেনার সময় যথাস্থান থেকে দোকানিকেও ফাঁকি দিয়ে উধাও!

 

* আজ উনিশে শ্রাবণ নওরীনের  সতেরতম জন্মদিন। গৃহে কোনো উদ্দীপ্তিপূর্ণ ঘটা নাই, আনন্দোল্লাস–কোনো হট্টগোল নাই। কারণ, তাহার পিতৃমহোদয় মনে করেন, যাহারা হৃদয়প্রসন্ননিমিত্তে জন্মকে ঘিরে আলোড়ন করে তাহাদিগের আয়ু অল্প। তিনি মনে করেন না, জীবন কোনো আনন্দের বিষয়! তিনি আরও মনে করেন, পৃথিবী একটা অভিশপ্তস্থল! অভিশাপ মোচনান্তে প্রস্থান–এই যুক্তিউক্তির সত্যতা কতুটুকু তাহা কোনো শাস্ত্রে প্রমাণ মিলে না। হইতে পারে ইহা ধর্মান্ধতার নিদর্শন। এইখানে একটি বিষয়ে প্রমাণ মিলে–যাহারা ধর্মভীরু তাহারা যেকোনো আধ্যাত্মিক কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, তাহারা সকল কুসংস্কারকে সংস্কার বলিয়া মানিয়া লয়! এই পৃথিবীতে এমন কতক লোক আছে, তাহারা শিক্ষিত-শিক্ষিতা হইয়াও অন্ধকারে বাস করে! তাহাদের মধ্যে নওরীনের পিত্রমহোদয় একজন। এবং বাস্তব কথা হইল–গ্রাম্যস্ত্রীলোকেরা এইসব কুসংস্কারকে প্রধান্য দেয় বেশি। আর যাহাসব কাণ্ড করে তাহাসব বিষয় প্রকাশ করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ না হইলেও প্রকাশ করা সমীচীন বোধ হয়। তাহারা গোল করিয়া বসে, একে অপরের মাথার উকুন বাছে আর যত কুৎসিত–আজেবাজে–কুসংস্কার কথা লইয়া কৌতুকাহ্লাদে মাতামাতি করে, …শান্তার মায়ের নাম ‘কালিনী’। …সায়নের গরুয়ে রায়নের ধান খেয়েছে খোঁয়াড়ে দিল না কেন। …‘শরিফুদ্দিন’ দেখ নাম রেখেছে কী! আস্ত একটা বদমাশের হাড্ডি। …করিমশেখ নাকি হজ্ব করেছে–হয়েছে হাজি, শয়তানের রূপ দেখলে বেটাকে দেখতে হয়। …পাজি মক্কা গেলেও গাজি হয় না এ কথাটা সত্য। …নীরাদের হীরা ছেলেটা ত জন্ম থেকেই এমনই হারামি–নামের কত সোহাগ দেখ ‘হীরা’। …‘প্রাচী’ আবার কী নাম দেখ! …রিদল চাচার মেয়েটার কাণ্ড দেখলে নি! অজাতের একটা ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। …রুকুনুদ্দৌলা মাতব্বর তার কত বংশগৌরব! মেয়ে বিয়ে দিল একটা কমজাতের ছেলেকে। …রানুর লেখাপড়ার কত দেমাগ কিন্তু ঘর বাঁধে একটা অশিক্ষিতের সঙ্গে–আবার বলে কি ভালবাসা… …ইত্যাদি বলিয়া একে অপরের সহিত ব্যঙ্গার্থে রসিকতা করে।

 

এখানে সুবোধ্যাবোধ্য এ হতে পারে : সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বাসে চলছে অনি। পুরো নাম অনিরুদ্ধ হাওলাদার। ঘরে অনিকে সোহাগ করতে গিয়ে রুদ্ধকে যখন অনাদরের ময়লায় ছোড়ে ফেলে, তখন পুরা রূপে রূপ পায় অনি… …এটাই মনে হয় সুবোধ্য? অত্যাধুনিকতা? আর অবোধ্য বোধহয় নওরীনের পর্ব। তবে কত আকাশ-পাতাল তফাৎ! ‘এই বেটা এদিকে আয়’ আর ‘বাবা, এদিকে আস তো।’ এদুটো বাক্য কিন্তু একই। শব্দও প্রায় এক। তবে বলার ক্ষেত্রবিশেষে প্রথম কথার শ্রী হয়েছে শ্রবণতেতো আর পরের কথা শ্রবণমধু। এ বাক্যদুটোতে নবীনতা আর প্রাচীনতা কী হতে পারে আমার জ্ঞানের অতীত। দৃষ্টান্তপর্বদুটো আমার অন্ততসাধনা গল্প এবং বাস্তব নামক উপন্যাসের অংশবিশেষ।

চলবে…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top