Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

দুঃসাহস

: | : ১২/০৯/২০১৩

একদিন সকালে জানালা দিয়ে অন্য ঘরের বারান্দায় দৃষ্টি যেতেই দেখলাম, কালো পোশাক পরা, ফর্শা, হালকা-পাতলা, লম্বা, সিল্কি চুলওয়ালা একজন অচেনা মেয়ে আমার ভাতিজাকে কোলে নিয়ে আদর করছে। পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করার জন্য নিজেকে তৈরী করছি। এইরকম একটা উপযুক্ত সময়ে এমন সুন্দর একজন মেয়েকে দেখে হৃদয়ে এক দমকা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। পরে জানলাম, সে আমার ভাবির ফুপাতো বোন। নাম রোজী। তার কাকার সঙ্গে আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। একসময় আলাপ-পরিচয় হলো। তার কাকা পরদিনই চলে গেলেন।

রাতে ভাবি, রোজী আর আমি গল্প করছিলাম। বিয়ে-শাদির কথা উঠলে ভাবি আমাকে বললেন, তোমার তো এখন বিয়ে করার বয়স। আজ আমাদের সাথে গল্প করছো। আর বিয়ের পর আমাদের কথা মনেই থাকবে না। তখন বৌকে নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাবে।
আমি বললাম, আমরা কি আর চাকরি-বাকরি না পেলে বিয়ে করতে পারি? আপনারা এক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। যেমন রোজী এখন ইচ্ছে করলেই বিয়ে করতে পারে।
আমার মুখ থেকে রোজীর কথা বের হওয়ায় ভাবি চমকে উঠে চট করে আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, চাকরি তো অবশ্যই পাবে।

এরপর আমার ভাই ঘরে প্রবেশ করায় গল্প বন্ধ হয়ে গেল।

কয়েকদিন পর ভাই রোজীকে তাদের বাড়িতে রেখে এলেন। আমিও ঢাকা চলে গেলাম।

কিছুদিন পর আবার পাবনায় আমাদের বাড়িতে গেলে ভাবি বললেন, বাড়ি থেকে তোমার বিয়ের কথা ভাবা হচ্ছে।
আমি পুলকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোন মেয়েকে দেখেছে নাকি?
তিনি বললেন, না এখনও দেখেনি।
কিছুক্ষন পর তিনি আবার বললেন, আমার ফুপাত বোন রোজীকে তো তুমি দেখেছ। তোমার যদি পছন্দ হয় তবে তার সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে কথা বলব।

আমি আনন্দিত হয়ে বললাম, আমার খুবই পছন্দ।

এরপর ঢাকায় গিয়ে কিছুদিন পর বেসরকারি চাকরিতে যোগ দিলাম। ঈদের সামনে অফিসের ঠিকানায় একটা কার্ড এল। খুলে দেখলাম রোজী পাঠিয়েছে। বুঝলাম ভাবির কাছ থেকে ঠিকানা পেয়েছে। আমিও তাকে কার্ড পাঠালাম। এরপর আমাদের মধ্যে পত্র যোগাযোগ চলতে থাকল। রোজী তার ছবি পাঠাল, আমিও আমার ছবি পাঠালাম। তার ছবি স্ক্যান করে অফিসের কম্পিউটারে ঢুকিয়ে ইচ্ছা হলেই দেখি। বাসায় তার ফটো দেখি আর ভাবি, সে আমার বউ হলে খুবই ভালো হবে।

আমার বাবা-মাকে রোজীর বিষয়টা জানানো হলে তারা বিয়েতে রাজি হলেন না। কারণ এত অল্প শিক্ষিত মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনতে চান না তারা। তাছাড়া আত্মীয়তার মধ্যে আত্মীয়তাও তারা করতে চান না। সামাজিকতার কারণে রোজীর বাবা-মাও আমার বাবা-মার অমতে বিয়েতে রাজি না।

এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর ভাবি জানালেন যে আমি ভাল চাকরি পাওয়ায় রোজীর কথা ভুলে গেছি। তার এক চাচাতো ভাইয়ের অভিভাবকদের অমতে নিজে নিজে বিয়ে করার কাহিনি শোনালেন। বুঝলাম ভাবি চান যে আমি বাবা-মার অমতে হলেও রোজীকেই যেন বিয়ে করি। কিন্তু সরাসরি না বলে একটু ঘুরিয়ে ইঙ্গিতে তা বুঝিয়ে দিলেন।

আমি জানালাম যে রোজীর কথা ভুলে যাইনি। তাকে ধৈর্য ধরতে বললাম যে আমি যদি অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী না হই তাহলে একসময় বাড়ি থেকে রোজীর ব্যাপারে রাজী হবেই।

এদিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে রোজীর বিয়ে আসতে লাগল। রোজীর বয়স কম বলে সে তার বাবা-মাকে বলতে পারছে না যে তার বিয়ে করতে দেরি আছে।

কিন্তু আমাকে রোজী চিঠিতে জানাল যে ফাল্গুন মাসের মধ্যে আমি যদি তাকে বিয়ে না করি তবে কাশেম নামের একজন তাকে বিয়ে করবে। আরো লিখেছে, আমি কি এমন অপরাধ করেছিলাম?

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। আমি খেয়াল করেছি যে রোজীর কণ্ঠ শুনলে, তার চিঠি পড়লে আমার কোনো মানসিক চাপ থাকে না। একজন পুরুষের কাছে একজন মেয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তেমনি একজন মেয়ের কাছে পুরুষ। কিন্তু সব ফুল যেমন সবার প্রিয় হয় না, তেমনি সব মানুষ সবার কাছে প্রিয় হয় না। যে মেয়েকে একজন পুরুষ ভালোবাসে, সেই মেয়ের এক চিলতে হাসির বিকল্প জগতের অন্য কোনো কিছুই তার কাছে হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের মনের এই টানকে বাধা দিলে বোধ হয় প্রাণশক্তিই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন নানা শারীরিক সমস্যাও হতে পারে।

রোজী নামের একটা মেয়ে আমাকে ভালোবাসে, এটা আমার ভিতরে একটা শক্তি জোগায়। নিশ্চয়ই তার ভিতরেও। তাছাড়া আমাদের বিয়ে হলে হয়তো আমরা কয়েকটা দিন হলেও বেশি বাঁচব। একবার বিদায় নিলে তো আর এখানে ফিরে আসা যাবে না। অনেক অপরাধ তো আমরা করিই। বাবা-মায়ের অমতে রোজীকে বিয়ে করে আরেকটা অপরাধ না হয় করলাম।

গ্রামের একটা সরল, সুন্দর মেয়ে অতদূর থেকে আমাকে একটা ইচ্ছার কথা এবং অন্য কাউকে বিয়ে করার ব্যাপারে তার অনিচ্ছার কথা জানিয়েছে। আমি তার নির্মল মনের এই মহৎ ইচ্ছার মূল্য দিব না?

আমি যদি তার আহবানে সাড়া না দেই তবে সে তার অনিচ্ছা নিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করবে। আমি তাকে সাড়াজীবনের জন্যে হারিয়ে ফেলব। একটু ঝামেলাকে ভয় পেয়ে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে ফেলব যে কিনা আমাকে ভালবাসে? বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক তো থাকবেই। কিন্তু রোজীকে তো আমি আর পাবো না।

এসব ভেবে আমি তাকে চিঠি লিখে জানালাম যে সে যেন নির্দিষ্ট তারিখে তাদের বাড়ির নিকটের বাসস্ট্যান্ডে আসে।

একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া করে আমি যথাসময়ে গিয়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে এসে সেদিনই আমরা বিয়ে করলাম।

সবেমাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছি। ফার্নিচার বলতে গেলে কিছুই নেই। একটা খাটও না। তাই মেঝেতেই আমাদের বাসর হল।

পরদিন অফিসে গিয়ে ঘণ্টাখানেক পর বাসায় ফিরলাম। রোজী আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার?
আমি বললাম, ব্যাপার কিছুই না। তুমি এখানে নতুন। তাই তোমার কথা ভেবে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছি।
সে দুষ্টামি করে বলল, আমার কথা ভেবে নাকি অন্য কোন তাড়নায় ছুটি নেয়া হয়েছে?
আমি বললাম, মানে?
সে মুখ লুকিয়ে বলল, কিছু না।

বাড়ির কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। কিন্তু চিড়িয়াখানায়, বোটানিক্যাল গার্ডেনে কিংবা সংসদ ভবনে ঘুরে এবং একে অপরের কোমল সান্নিধ্যে সুখেই কাটতে লাগল আমাদের দিনগুলি।

ঈদ এল। আমরা বাড়ি যেতে পারলাম না। কারো বাসায় বেড়াতে যাওয়া হল না, আমাদের বাসায়ও কেউ এল না। নিজেদেরকে এতিম এতিম মনে হল।

ঈদের দিন বাড়ির সবাই একসাথে ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে যাওয়ার আলাদা একটা আনন্দ আছে। সেই আনন্দের সময়ে আমি বাড়িতে না থাকায় বাড়ির সবাই আমাকে কিছুটা হলেও হয়তো মিস করেছে। তাই পরের ঈদের আগে বাড়ি থেকে আমাদেরকে নিতে এল। আমরা এ দিনটির অপেক্ষাতেই ছিলাম। তাই আপত্তি না করে বাড়ি গেলাম।

এরপর বহুদিন কেটে গেছে।

বৈশাখ মাস। দুপুর গড়িয়ে গেছে। খুব রোদ উঠেছে। বাতাস বইছে। মাঠে ছোট ছোট ধানগাছ ঢেউয়ের মত বাতাসে দুলছে। কিছু দুড়ন্ত ছেলে এই রোদ্রে মাঠের মধ্যে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আমি বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছি।

ঢাকায় দুই বছর চাকরি করে খুলনায় সরকারি চাকরিতে জয়েন করেছিলাম। ছোটবেলায় যেখানে হেসে খেলে বেড়িয়েছি সেই জায়গার টান ছিন্ন করতে পারিনি। তাই পেনশনের টাকা দিয়ে আমাদের বাড়ির নিকটেই একটা বাড়ি করেছি।

আমাদের দুই মেয়ে এক ছেলে হয়েছে। সবাই বিয়ে করেছে। মেয়েরা দেশের বাইরে থাকে। ছেলেটা ঢাকায়। বড় মেয়ের দুই ছেলে এক মেয়ে। আমাদের একাকীত্বের কথা ভেবে এক ছেলেকে আমাদের কাছে দিয়েছে। তাকে নিয়ে রোজী দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমাচ্ছে।

ওর দিকে তাকালাম। কে বলবে এই মেয়েটাই একদিন সবাইকে ছেড়ে ভালবাসার টানে আমার কাছে চলে এসেছিল। আমি সত্যিই ভাগ্যবান। সে জীবনে অনেক দিয়েছে আমাকে। অনেক পেয়েছি তার নিকট থেকে। আজ ভাবি, সেদিন যদি ওভাবে দুঃসাহস দেখিয়ে রোজীকে বিয়ে না করতাম তবে জীবনে এই পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতাম।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top