আজ আমার মন ভালো নেই
কেউ একজন নিজের ব্লগে লিখে পাঠাল, ‘আজ আমার মন ভালো নেই।’ তার বিপরীতে আরেকজন মন্তব্য করলেন। এমনি করেই ব্লগে একজনের সঙ্গে অন্যজনের মিথস্ক্রিয়া হয়। ভাবনার এই আদান-প্রদানের দ্বিমাত্রিক জমিন ব্লগ। এই মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্রে নানা ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতার বিনিময় ঘটে। ১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ব্লগ শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করানোর কাজটি করেন পিটার মেরহোলজ। ব্যস দিন যায় আর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ব্লগের। ব্লগ (ইষড়ম) মূলত উইব্লগের সংক্ষিপ্ত রূপ। যিনি ব্লগে পোস্ট করেন তাকে ব্লগার বলা হয়। ব্লগাররা প্রতিদিন নিজেদের ওয়েবসাইটে কনটেন্ট যুক্ত করেন আর ব্যবহারকারীরা সেখানে নিজেদের মন্তব্য করেন। যারা ব্লগে লিখেন তারা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তাদের লেখা নিয়ে আলোচনা হয়, সমালোচনা হয়। কখনো কখনো লেখক এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের মতামত দেন। এমনি করে সৃষ্টিশীলতার দিকে পথ চলা। প্রথমে সাধারণ বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে তারা শিল্প সাহিত্যের আঙিনায় পা রাখেন। অবশ্য বিষয়টা এমন নয় যে সাধারণ লেখক থেকে সৃষ্টিশীল হয়ে যাওয়া। বরং যার মাঝে সৃষ্টিশীলতা আছে সে লেখার ভুবনে পথ চলতেই থাকবে। এবার একটি ব্লগের উদাহরণ লেখা যাক, ‘কুৎসিত-দর্শন, দরিদ্র প্রৌঢ় সক্রেটিসের দেয়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। শাসকবর্গের প্রিয়পাত্র ছিলেন না তিনি, উঁচু মহলের সঙ্গে ছিল না কোনো যোগাযোগ, কোনো কিছুরই ধার ধারতেন না তিনি। তাহলে? এর একটা ছোট্ট জবাব হচ্ছে, যারাই তার সংস্পর্শে আসতেন তারাই প্রবেশ করতেন এক মহত্তর উন্নততর জীবনবৃত্তে। অন্যদের উন্নত করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। চুম্বকের মতো আকর্ষণ শক্তি ছিল সক্রেটিসের ব্যক্তিত্বের, তার সান্নিধ্যে এলে মোহগ্রস্ত অভিভূত এবং পরাস্ত না হয়ে উপায় থাকত না কারো। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো: মানবজাতির নৈতিক উন্নতি সাধন। এ কাজ তো আর নৈতিক উপদেশ বিতরণ করে হয় না, একমাত্র ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন এবং মানুষকে তাদের নিজেদের মুখোমুখি হওয়ার কাজে প্রবৃত্ত করার ভিতর দিয়েই এটা হতে পারে।’ প্রবন্ধের এই নির্বাচিত অংশ থেকেই ধারণা করা যায় ব্লগের সৃষ্টিশীলতার ধারা কোন মাত্রার। ব্লগে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কবিতা, প্রচুর কবিতা ব্লগে লেখা হয়। তার একটি উদাহরণ দেয়া যায়, নীলাকাশ যতদূর দেখা যায়/ জীবনের এই আঙিনায়/স্বপ্নগুলো এসে ধরা দেয়/ভুল যত করেছি এই জীবনে…
গত ১ জুন দুপুর ১.৪৪ মিনিটে একজন ব্লগার (নামটা লেখা হলো না, পাঠক ব্লগে গিয়ে তার নাম জেনে নিবেন এই আশায়) এই কবিতাটি পোস্ট করেছেন। কবিতার একটি অনুশীলনের ক্ষেত্রও হতে পারে ব্লগ। এটা বলা যায় অনায়াসে যে, ব্লগ কবি নামে একটি অভিধা আছে। এই ব্লগাররা নতুন অভিধার পাশাপাশি কবিতার ক্ষেত্রেও আপন ভাবনার ভূমি তৈরি করেছেন। ব্লগের লেখা নিয়ে গত বছর বইমেলায় বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়াতে চাকরি করেন এমন কবি ব্লগে তার লেখাগুলো পোস্ট করেছেন। পাঠকের মন্তব্য নিয়েছেন, তারপর তার বইটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। ব্লগ যেন তার কাছে নতুন এক আকাশ, এখানে লিখে যাবেন নিজ সাহিত্যের নানা কথকতা। হয়তো এই ইলেকট্রনিক পাতায় লিখতে লিখতে একজন তার বাক্যগঠন, বিষয়বিন্যাস যথাযথ করে নিতে পারবেন। কিংবা ব্লগ খুলেই পাওয়া যাবে বিদেশি কোনো এক সাহিত্যিকের উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ। ব্যস, পাঠক প্রিয় এই লেখককে খুঁজে নিবেন।
তারপর পাঠ করবেন। তাই কোনো কোনো ব্লগ যেন ব্যক্তিগত সাহিত্যপাতা। এখানে লেখক নিজের লেখা লিখবেন, সম্পাদনা করবেন, প্রাথমিক পরীক্ষণের কাজটি করবেন। একে বলা চলে প্রস্তুতির ভূমি। তবে আমাদের ব্লগগুলো যেন সৃষ্টিশীল লেখার ক্লাস, সেখানে কবিতা, গল্প, গান অনুবাদ কিংবা অনু উপন্যাস সবই পাঠকের চোখে ধরা দেয়। আর পাঠক তাৎক্ষণিক মন্তব্য আর মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে লেখকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন।