উপন্যাস “প্রচ্ছায়া” (৩য় পর্ব)
৩
বেহালা এখন আর ভালো লাগছে না । মিজানের চরিত্রের এই এক বৈশিষ্ট এক কাজ সে দীর্ঘ দিন ধরে করতে পারে না । আর বেশি দিন কোনো কাজে মন লাগাতে পারে না বলে এই পর্যন্ত কোনো কাজই পরিপূর্ণভাবে শিখতে পারে নি । মিজানের হঠাত বাসনা জাগল সে নৃত্য শিখবে । নৃত্যের প্রতি হঠাত তার কেন এই ঝোঁক তা কেউ বুঝতে পারল না । আর বুঝবেই বা কি করে, মিজান তো কারো সাথে তার কোনো কিছুই শেয়ার করে না ।
মিজান ঢাকা শহরের প্রায় সবগুলো ড্যান্স স্কুলে গেল কেউ তাকে নাচ শেখাতে রাজি হল না । সবার একই অভিযোগ মিজানের বয়স বেশি, এই বয়স নাচ শেখার অনুকূল নয় । সকলের না, মিজানকে নাচের প্রতি আরো বেশি আগ্রহী করে তুলল । ড্যান্সস্কুলের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে সে মনে মনে দৃঢ় পণ করল, নাচে ভেতরে কী আছে সে তা দেখে ছাড়বে । পরিপূর্ণভাবে নাচ না শেখা পর্যন্ত নিস্তার নেই । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কেউ তাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করতে চাচ্ছে না । সবাই বয়সের দোহাই দিয়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছে !
ধারে ধীরে নিজের বয়সের প্রতি তার এক ধরনের চাপা ক্ষোভ জন্মাচ্ছে, কেন যে সে এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল ? নাচ শেখার ব্যাপারটি কেনই বা তার মাথায় আরো আগে এল না ? মিজান কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজি নয় । যেখানে শোনতে পারছে নাচের স্কুল আছে, সেখানে গিয়েই ধর্না দিচ্ছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না ।
অনেক খোঁজাখোঁজি করার পর আশুলিয়ার বাইপালের কাছে একটি ড্যান্সস্কুল খোঁজে পেল । নলিতা ড্যান্সস্কুল । এই স্কুলটির একটি বৈশিষ্ট হল, এটি মোটামোটি নির্জন জায়গায় অবস্থিত । আশাপাশের এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যে বাড়িঘর নেই বললেই চলে । দেখে মনে হচ্ছে স্কুলটি নতুন প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে । দুইটি টিনের ঘর । তন্মধ্যে দক্ষিনের ঘরটি মোটামোটি বড়, এবং পশ্চিমের ঘরটি সেই অপেক্ষায় বেশ ছোট । উত্তর দিকে রাস্তা সংলগ্ন ছোট গেইট ।
গেইটের সামনে দাড়াতেই মিজানের ভেতরে এক ধরনের শান্তির স্রোত বয়ে গেল । এখানে কাজ হবে বলে, কেন যেন তার মনে হচ্ছে । আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরাতেই মিজান অভিভূত হল । অজানা কারণেই জায়গাটি তার কাছে অনেক ভালো লাগছে । প্রধান ফটক পেরিয়ে মিজান ভেতরে ঢুকল । ভেতরে সুন্দর একটি ফুলের বাগান । বেলি চামেলী জবা হাস্নোহেনা থেকে শুরু করে এমন কোনো ফুলগাছ নেই যা এখানে রোপন করা হয় নি । এসবের অধিকাংশেই এখনো ফুল ধরে নি । বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে । দক্ষিনের অর্থাত বড় ঘরটিতে নাচের ক্লাশ হচ্ছে । মিজান আঙ্গিনায় দাড়িয়ে দেখতে পাচ্ছে, একজন মহিলা নাচ শেখাচ্ছেন । শিক্ষিকার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ অনুমেয়, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা । ছাত্রদের উপর চোখ পড়তেই মিজানের মন খারাপ হয়ে গেল । এখানে যে কাজ হবে তা মনে হচ্ছে না । কারণ এখানে যারা নাচ শিখছে তাদের কারো বয়স পনেরো উর্ধ্ব হবে না । হঠাত শিক্ষিকা মহোদয়ার চোখ পড়ল মিজানের দিকে । মিজান নিরাশ ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। ম্যাডাম বারান্দায় দাড়িয়ে জিজ্ঞাসিলেন, কে আপনি ?
মিজান অপ্রতিভ স্বরে নিজের নাম বলল ।
কী চান ? ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ম্যাডাম তার দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন ।
মিজান কিঞ্চিত ইতস্ত স্বরেই বলল, নাচ শিখতে চাই।
ম্যাডাম খানিকক্ষণ মিজানের মুখের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিজানের সব চেয়ে বড়গুন তার চেহারা সোন্দর্য। কঠিন থেকে কঠিন হৃদয়ও এই চেহারা দেখে সদয় হতে বাধ্য।