বাঘের থাবা (বনজঙ্গলের ডাইরি)
মধ্যপ্রদেশের টাইগার প্রজেক্ট—বান্ধব গড়। এখানকার জঙ্গলে বেশ সংখ্যক বাঘের বাস। টাইগার প্রজেক্টের সরকারী মাপাজোপা অবস্থান থাকলেও সে পরিসীমার মাপ জংলী জন্তু জানোয়ারদের নেই। তাই প্রায়ই দেখা যায়,প্রজেক্ট এরিয়া ছাড়িয়ে লোকালয়ে বাঘেরা এসে পড়ে। আর পেটের জালায় ওরা গ্রামের গরু বাছুর ছাগলের সঙ্গে সঙ্গে এক আধটা মানুষকেও খোরাক বানাবার চেষ্টা করে।
এমনি এক সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা আজের এ গল্প। বান্ধব গড়ের টাইগার প্রজেক্টের পাশেই এক গ্রাম–নাম তার রোহনিয়া। গ্রামের প্রায় লোকেরাই গরীব শ্রেণীর–নিজেদের যৎসামান্য ফসলের জমি ছাড়া আর কিছুই সম্বল নেই তাদের।
নিজেদের সামান্য জমি চাষবাসের পর রোজগারের একটা জরিয়া এখানে আছে—সেটা হল জঙ্গলের তেন্দুপাতা সংগ্রহ। তেন্দু পাতা হল বিড়ি বানাবার পাতা। প্রতিদিনের সামান্য চাষবাসের পর গ্রামের স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে এই তেন্দু পাতা সংগ্রহের কাজে লেগে যায়। এই পাতা কচি থাকতে থাকতে সংগ্রহ করতে হয়। পাতা যোগার করে রোদে শুকোতে হয়। তারপর পাতার ছোট ছোট বান্ডিল বানিয়ে ঘরে রেখে দেওয়া হয়। বিড়ি কোম্পানির লোকেরা বা বিড়ি পাতার ব্যবসায়ীরা কিছু দিন পরপর এসে এই জমানো পাতার বান্ডিলগুলি গুনে গুনে নির্ধারিত পয়সায় কিনে নিয়ে যায়। অবশ্য পাতা ভাঙার বিশেষ একটা সিজেন আছে। সারা বছরের কয়েকটা মাসই মাত্র এ উপরি কাজ ও সে সঙ্গে উপরি রোজগারের ব্যাপারটা চলতে থাকে। সচ্ছল জীবন ধারণের জন্যে গ্রামবাসীদের এই উপরি অর্থের প্রয়োজন হয় বৈ কি !
এই তো দু বছর আগের কথা,পয়সার দায়ে নিজেদের সম্বলের জমির বেশ কিছু অংশ বিক্রি করতে হল রুহণ যাদবকে। দু তিন বছরে তার বেশ কিছু টাকার উধার হয়ে গিয়েছিল। ফলে,বাধ্য হয়ে বেশ কিছু চাষের জমি বিক্রি করে দিল।
বর্তমানে আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল.তাই রুহণ প্রায় দিন ভর গরমের মধ্যেও তেন্দু পাতা তোলার কাজে ব্যস্ত থাকত।
রুহণের একমাত্র ছেলে—ধুনি। মালন,রুহণের স্ত্রী।তিন জনের সংসার। বর্তমানে মালন রুহণের সঙ্গ দিতে পারছিল না। তার প্রধান কারণ কুয়ো তলায় স্নান করতে গিয়ে তার পা গিয়েছিল পিছলে—আর তাতেই সামান্য ফ্রাকচার হয়ে গেল। লেংড়ে লেংড়ে চলতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তারপর থেকে এক মাস তার জঙ্গলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
সে দিন সকালে রুহণ নাস্তা করে জঙ্গলে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল। মালন রুহণের হাতে নাস্তা তুলে দিয়ে বলে উঠলো,হ্যাঁ,গো,আইজ তুমি একটু তাড়াতাড়ি জঙ্গল থেকে চলে আসতে পারবা?
রুহণ স্ত্রীর দিকে তাকাল। বুঝতে পারল না,আজ কেন জঙ্গল থেকে তাকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে! ও বলে উঠলো,কেন,আজ কেন্ তাড়াতাড়ি আইতে হবে ?
–আমি তোমারে বলি নাই,আমার পায়ে দু দিন যাবত রাইতে খুব ব্যথা হয়,ঘুমাইতে পারি না–
–কৈ জানি না তো আমি !
তুমি জানবা কি কইরা? বিছানায় শুইলে তো কোন হুঁশ বোধ থাকে না তোমার ! মালন ব্যথা কাতর মুখ নিয়ে বলে উঠলো।
–কিন্তু কি করব বল–জঙ্গলে সারা দিনের খাটনি !
–তা আমি জানি গো ! মালন বলে উঠে,তোমার দোষ দিই না কোন।
রুহণ বলে,তাহলে চল তোমারে আগে ডাক্তারখানায় লইয়া যাই।
–পার যদি ভালো হয় গো ! মালন বলে ওঠে।
ডাক্তার মালনকে পরীক্ষা করে দেখে রুহণকে বলল,তোমার বৌরে কও কিছু দিন হাঁটা চলা বন্ধ করতে। একে তো পায়ের হাড্ডিতে চোট তারপর ঘরের সব কাজ তো সেই করে হবে–ভারী জিনিস উঠানো নামানোতে এমনটা হয়েছে,বুঝেছ?
রুহণ ঘরের কাম করলেও সে জানে তাদের মত গরীবের সংসারে চুপচাপ বিছানায় পইড়া শুইয়া থাকা যায় না। মালনও জানে, সংসারের কাম ছাইড়া বিশ্রাম নেওয়া তার পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ,ভারী জিনিস উঠানো নামানো যতটা সম্ভব কম কইরতে হবে,না হইলে এই ব্যথা কোনও দিনই ছাড়বো না।
বেলা তখন তিনটা বাজে। রুহণ বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে প্লাস্টিকের বোরা সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াল। সকালের দিকে বেশ কিছু লোক তেন্দু পাতা সংগ্রহ করতে চলে গেছে বনে। একটা একটা করে আস্ত পাতা তুলে যার যার নিজস্ব জাগায় ওরা জড়ো করে। বনের মধ্যে তেন্দুর ছোট ছোট গাছ থেকে কচি পাতা যোগর করতে হয়। এ জন্যে সাধারণত বনের গভীরে যাবার প্রয়োজন হয় না। বনের পাশ ধরেই বিস্তৃত এলাকা নিয়ে ছোট ছোট তেন্দু গাছের সমারোহ। যে হেতু এ এলাকায় বাঘের উপদ্রব আছে তাই ভয়ে গ্রামের বেশ কিছু লোক দল বেঁধে পাশাপাশি থেকেই পাতা সংগ্রহ করে থাকে।
সাথীরা জঙ্গলের কোন্ দিকে পাতা উঠাতে যায় তা রুহণ জানে। গ্রাম ছেড়ে প্রায় এক কিলোমিটারের দূরত্বে ও জঙ্গলের কাছাকাছি এসে দেখল,মাত্র তিনজন লোক পাতা ভাঙছে। ও কোন কথা না বলে নিজের কাজে লেগে যায়। একেবারে ধারে কাছে বেশী পাতা নেই–তাড়াতাড়ি পাতা গুছাতে হলে জঙ্গলের সামান্য ভিতরে তো যেতেই হবে। ওর ইচ্ছে অন্যদের চে অনেক বেশী পাতা ভাঙবে। যে যত বেশী পাতা ছিঁড়ে জড়ো করতে পারবে সে তত বেশী পয়সা রোজগার করতে পারবে। সংসারের দু বেলার খাবারটা অন্তত তার যোগর করতে অসুবিধা হবে না।
বেলা তখন প্রায় পাঁচটা বাজে,গ্রামের তিন চারজন লোক যারা তখনও পাতা ছিঁড় ছিল তারা দেখল,রুহণ জঙ্গলের ভেতর দিকে চলে গেছে। বয়স্ক একজন চীৎকার করে তাকে ডাকল,কৈ চল গো,চল আমরা ঘরে যাচ্ছি।
ওরা ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে হাঁট ছিল। রুহণের কানে ওদের ডাক পৌঁছে ছিল,ও গলায় জোর নিয়ে বলে উঠলো,হ্যাঁ,খুড়ো,যাও, তোমরা যাও,আমি আইতাছি।
এরপর আরও দশ মিনিট কেটে গেল,রুহণ আরও কিছু পাতা তোলার আশায় জঙ্গলের আরও কিছুটা গভীরে ঢুকে গেল। জঙ্গলে তখন তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসছে। ও ঘরে ফিরবে ফিরবে ভাবছিল। ঠিক এমনি সময় জঙ্গল থেকে জন্তুজানোয়ারের হুটপাট ছুটা ছুটির আওয়াজ ওর কানে এলো। ভয়ে রুহণ চটকরে গাছের আড়াল হয়ে গেল। ওর পাশ দিয়ে চার পাঁচটা হরিণ ভীত সন্ত্রস্ত ছুটে গেল। রুহণ ভয় পেয়ে গেল,নিশ্চয় ওদের বড় জন্তু জানোয়ার তাড়া করেছে। আর এই তাড়াবার পেছনে বাঘ বা ভাল্লুকের মত বড় জানোয়ার হওয়াই স্বাভাবিক।
রুহণ দ্রুত পা চালাল–এখনি জঙ্গলের বাইরে বের হতে হবে তাকে–না হলে বাঘ ভাল্লুকের আক্রমণ থেকে ওর আর রক্ষে নেই! এমনি সময় জংলের ভিতর থেকে হরিণের আর্ত চীৎকার শোনা গেল,বোঝা গেল যে বাঘে হরিণ ধরেছে। হরিণের গলা থেকে করুন মৃত্যুর আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিল। বাঘ নিশ্চয় হরিণের গলায় থাবা বসিয়ে দিয়েছে। তাই হরিণের আওয়াজ ক্রমশ ধীর হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। রুহণ ছুটতে ছুটতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল,ও চমকে উঠলো,অন্ধকারের ভিতর থেকে বাঘের জ্বলন্ত দুটো দেখতে পেল। ও ভেবে ছিল যে বাঘের হাতে এখন খাদ্য,পেটের খিদে মেটাবার জন্যে সে নরম হরিণের মাংস পেয়ে গেছে। এখন রুহণের প্রতি তার নজর নিশ্চয় থাকবে না। কিন্তু তার ধারনা ছিল সম্পূর্ণ ভুল,বাঘ একটার জাগায় দুটোও তো হতে পারে! ওর বেলায় এমনটাই হয়ে গেলো–মাত্র মিনিট তিনেক পরেই রুহণের পাশটাতেই মনে হল বাঘ ভয়ঙ্কর গর্জন করে উঠলো। সে ছিল ভয়ঙ্কর কান ফাটা গর্জন। কিন্তু রুহনের মনে হয়ে ছিল,খাদ্যের যোগার হয়ে যাবার পর বাঘের এমনি গর্জন করার কথা না,তবে ?
আবার গর্জে উঠলো বাঘ। ছুটছে রুহণ–জঙ্গল পার করে প্রাণপণে ছুটে চলেছে। এবার ঠিক তার পাশ থেকেই উৎকট চীৎকার করে উঠলো বাঘ–পায়ের নীচের মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠলো! আর রক্ষে নেই,এপাশ ওপাশ,ডান দিক,বাম দিক করে ছুটে চলেছে ও। ঠিক এমনি সময় বাঘ রুহণকে লক্ষ্য করে লাফ দিল। কিন্তু রুহণের ওপরে না পড়ে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে পাশের উঁচু ঢিবির ওপরে পড়ে খানিটা গড়িয়ে গেল বাঘ। ব্যাস,আর মুহূর্ত মাত্র সময়—রুহণ বুঝতে পেরেছিল যে তার বাঁচার আর কোন উপায় নেই। বাঘ এবার শেষ লাফ দেবে আর রোহণের ঠিক গলার টুঁটি থাবা দিয়ে চেপে ধরবে।
রুহণ প্রাণপণে চীৎকার করে উঠলো,বাঘ,বাঘ,বাঁচাও বাঁচাও,দু তিনবার ওর গলা থেকে চীৎকার বের হবার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ লাফ দিয়ে এসে তার ঘাড়ের ওপরে পড়ল। রুহণ ছিটকে পড়ে গেলো দূরে। কিন্তু তার উঠে পরার আগেই নখর বাঘের থাবা এসে চেপে ধরল তাকে। গলা থেকে তার চীৎকার বেরচ্ছিল না,কেবল গোঁঙানির মত আওয়াজ হয়ে যাচ্ছিল। শুরুতে রুহণ মনে করতে পারছিল না যে ও এখন কোথায়? সত্যি কি ওকে তা হলে বাঘে ধরে নিয়েছে? নাকি কোন স্বপ্ন দেখছে ও! চেতন অবচেতনের মাঝখানে তন্দ্রায়িত এক ভাবনায় আটকে ছিল রোহণ। প্রচণ্ড ব্যথায় ওর গলার আওয়াজ আটকে আসছিল—শরীর বেঁকে কুকে যাচ্ছিল। ও অবচেতনে বুঝতে পারছিল,বাঘ ওকে পীঠে তুলে নিচ্ছে,ওকে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে,তারপর…
গ্রামের লোকেদের কানে রুহণের চীৎকার ভেসে এল—তার একটু পড়েই বাঘের গর্জন শুনতে পেল তারা। হৈ হৈ করতে করতে গ্রামের লোকেরা লাঠি-সোঁটা,মশাল নিয়ে ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের ধারেকাছে কোথাও রুহণকে ওরা খুঁজে পেল না। এবার ওরা চীৎকার করে রুহণের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বনের ভিতর প্রবেশ করল।
এর মধ্যে একটা ঘণ্টা পার হয়ে গেল। খুঁজতে খুঁজতে গ্রামবাসীরা এক সময় রুহণের মৃত দেহ খুঁজে পেল। বাঘ ওর পেটের ও গর্দানের অনেকটা জাগা খেয়ে ফেলেছে। মৃত রুনণকে গ্রামের লোকেরা ঘরে নিয়ে গেল।
মালন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো–রুহণের মৃতদেহের ওপর সে লুটিয়ে পড়ল। মালনের করুণ কান্নার সুর গ্রামের আকাশ বাতাস বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দিল। রুহণের ছেলে ধুনি,অনেক সময় ঘরের দোরের গোড়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল।ছোট্ট ছেলে, বয়স চারের মত হবে,সে বুঝল,বাবা তার মরে গেছে। মার চীৎকার কান্নায় ওর চোখ ফেটেও জলের ধারা নেমে এলো।
সমাপ্ত