উটন দাদুর কাহিনী–২ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
বিটেন সাহেবের আর এক দিনের শিকারের কথা বলতে হয়। বস্তারের সেই ঘন জঙ্গল,সঙ্গে সেই তিন আদিবাসী পাণ্ডার দল। সাহেবের দেহরক্ষী বললে চলে। সাহেবের আদিবাসী লোকগুলিকে শিকারের সঙ্গী বানাবার কারণ আছে বৈ কি! এক তো ওরা শক্তিশালী হয়। প্রয়োজনে সাহেবকে বাঁচাতে অপেক্ষাকৃত বেশী বল প্রয়োগ করতে পারবে,আর দ্বিতীয়ত স্থানীয় লোক হিসাবে জঙ্গলের মাঝে মাঝে যে আদিবাসী গ্রামগুলি আছে তার লোকজনের সঙ্গে প্রয়োজনে স্থানীয় ভাষায় কথাবার্তার আদানপ্রদানও করতে পারবে। এ ছাড়া এখানকার জঙ্গলের প্রকৃতি ও জন্তুজানোয়ারদের চালচলন বিষয়েও অনেকটা ওয়াকিবহাল করাতে পারবে।
সে দিনও গভীর জঙ্গলে দলবল নিয়ে বিটেন সাহেব প্রবেশ করেছেন। সাহেবের হাতে সব বারের মত একটা দো-নলা বন্দুক। আদিবাসী রক্ষকদের হাতে রয়েছে সাইজ করা বড় লম্বা লাঠি,আর দাও–রাম দাও যাকে বলে–যেগুলির বেশীর ভাগ পূজাআচ্ছায় বলির কাজে লেগে থাকে–যেমন পাঁঠা বলি ,মোষ বলি। তা ছাড়া দুই রক্ষীর হাতে বাড়টি হিসাবে থাকে,পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। এই টর্চ জ্বালতে হলে বিটেন সাহেবের অনুমতির দরকার হয়।শিকারের ক্ষেত্রে টর্চের একটা আলাদা মহত্ব আছে। এর ব্যবহার ঠিক কোন সময়ে দরকারে আসবে তা ঝানু শিকারীরাই কেবল বলতে পারেন।
বেলা পড়ে আসছিল। দু ঘণ্টার প্রচেষ্টার ফসল বলতে গেলে তেমন কিছুই হয় নি–একটা বন মোরগ মাত্র মারা পড়েছে–ওজন বেশী হলে দু তিন কিলো হবে! হরিণের পাল দূর দিয়ে ছুটে যেতে দেখলেও বিটেন সাহেবের তাক লাগাবার আগেই সেগুলি নিশানার বাইরে হওয়া হয়ে গেছে ! এখন আপসোস করে আর কোন লাভ হবে নয়া। সে সময়টা মোরগের পেছনে না দৌড়ে যদি হরিণের পিছনে দৌড়ান যেত তবে পস্তাবার কিছু থাকত নয়া।
আর বেশী সময় জঙ্গলে থাকা সম্ভব নয়–ঘন অন্ধকার নামতে খুব বেশী দেরী নেই। এখনও বনের তলদেশ দৃশ্যমান। এখনও পায়ে হাঁটা সরু পথ ধরে চলা যাচ্ছে। যদিও এখানে শুধু আলো নয়,আলো অন্ধকার মিলেমিশে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কচিত কোথাও খানিকটা খোলা জাগা পাওয়া যায় যেখানে সূর্যদেব বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারেন। নদীর আশপাশ কিম্বা জলাশয় জাগাগুলিতে দিবালোক অপেক্ষাকৃত বেশী আলোকপাত করতে পারে।
বন থেকে ফিরে যাবার জন্যে হেঁটে চলেছেন বিটেন সাহেব। তাঁর মন সামান্য মেঘাচ্ছন্ন। আর কিছুই বলতে গেলে শিকার করা হল না। সঙ্গীর পীঠে দুলতে থাকা মরা মোরগের দিকে তাঁর চোখ পড়লো। না,দু আড়াই কিলোর বেশী হবে না–কার ভাগে এ প্রসাদ পড়বে–মনে মনে তিনি ঠিক করলেন,আজ তিনি মোরগটা ঘরে নেবেন না। এটা আজ না হয় তাঁর সঙ্গী রক্ষীদের ভাগেই জুটুক–আজের রসাস্বাদের মাংসটুকু না হয় ওদের ভাগেই থাক।
আর আধা মাইল খানেক হাঁটলে সেই জংলি সরু রাস্তা পাওয়া যাবে যার ধারে সাহেবের জীপ গাড়িটা দাঁড় করানো আছে। ওরা আর ক’পা এগিয়েছে মাত্র,এমনি সময় হঠাৎ সামনের দিকের জঙ্গল থেকে ঝুপ ঝাপ শব্দ ভেসে এলো–কি হল ? থমকালেন বিটেন সাহেব। সাথীরাও থেমে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল,কি ধরনের শব্দ–কোন বাঘ ভাল্লুক নয় তো ? বা অন্য কোন হিংস্র জন্তুজানোয়ার ? অথবা বাঁদরের দল এ ডাল থেকে সে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে না তো!
সবাই ভয়ে ভয়ে ধীর পায়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল। মনে হল বাঁদর হবে–এ ডাল ও ডাল করে দৌড়াচ্ছে। আরও এগিয়ে গিয়ে সবাই অবাক হয়ে গাছের ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওটা কি দু তিন লাফ দিয়ে গাছের বড় একটা ডালের আড়ালে লুকিয়ে গেল মনে হল না ! বিটেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন না—বাঁদর,না বন মানুষের মত কিছু,তাও ধরতে পারলেন না–মনে হল যেন কুচকুচে কালো একটা ছেলে–বড় ডালের আড়াল হয়ে গেল–মাঝে মাঝে ওটা মাথা উঁচু করে তাদের দেখবার চেষ্টা করছে।
–কেয়া হায় ? কাটা কাটা হিন্দিতে বিটেন সাহেব তাঁর সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ঠিক এমনি সময় গাছের নীচে ধপাস করে একটা শব্দ হল–মনে হল কোন ভারী জিনিষের পড়ে যাবার আওয়াজ হলো। সে সঙ্গে ছোট বাচ্চার কান্নার মত চীৎকার শোনা গেল। কাতরে কাতরে কেঁদে উঠার মতই শব্দ আসছিল অনেকটা মানব শিশু মতই !
সবাই ছুটে গেল,এ কি! কালো,প্রায় পিচের রঙের মতই এক শিশু গাছের নীচে পড়ে আছে। এখন কোন সাড়া শব্দ নেই কেন? বিটেন সাহেব তাড়াতাড়ি নিজের হাতে টর্চ নিয়ে ফোকাস ফেললেন সেই কালো জড় বস্তুর মত পড়ে থাকা শিশুটির ওপর। তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন,এ কি ! এ যে সত্যিকারেরই মানব শিশু! স্থানীয় আদিম বাসীদের থেকেও অনেক,অনেক কালো আর কুৎসিত ! শিশুটির গায়ে আলতো হাত রেখে নাড়া দিলেন তিনি–না,কোন রকম নড়াচড়ার লক্ষণ নেই ? এবার তিনি গায়ে ভাল করে হাত দিয়ে পরখ করলেন–না,মরে নি, তবে সঙ্গিন অবস্থা–মৃত্যু হয়তো তার শিয়রে। আর দেরী করলেন না বিটেন, তাড়াতাড়ি করে তাঁর সঙ্গীদের আদেশ দিলেন,কুইক ! কুইক ! জলদি করো–ইসে কাঁধে মে উঠা লো–আওড় জলদী চলো !
ক্রমশ…