সোহেলীর সংসার
আজ রাতে সোহেলীর বিয়ে। বয়স এখনও বিশ বছর পেরোয়নি। তবুও গরীব মা-বাবা তার বিয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিল। বিয়েটা এনেছে তালেব মুন্সি। আজ তার খুব কদর। গ্রামের কেউ তাকে দেখতে না পারলেও সে এখন তাদের খুব কাছের মানুষ। সোহেলী তার বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানে না।
গরীরেব মেয়ে সুন্দরী হয় না। সবাই বলে দেখতে ভালো। পাড়ার কিছু উঠতি যুবক তাকে কয়েকবার প্রেমের প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু সোহেলী কোন সাড়া দেয়নি। সোহেলী জানে সে গরীবের মেয়ে। খাবে কি সেই ভাবনাতে সারাদিন কাটে। সে জন্য তারা সেই সুযোগ নিয়ে তার কাছে আসে বিনোদন পেতে। প্রেম প্রেম খেলা করতে। কেউ তাকে বউ করে তার দায়িত্ব নিতে চায় না। সে যে কারো বউ হবে সে আশাও সে করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে মাঝে এসে পড়ে। তাকে থামানো যায় না ।
সোহেলী পশ্চিম পাড়ায় বাকীতে চাল কিনতে গেছে। সেই সাথে এ বাড়ি সেবাড়ি ঘুরে আসতে কিছুটা সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। বাড়িতে তালেবের সাথে তার বাবার অন্তরঙ্গভাবে ফিসফিস করা দেখে কৌতূহলী হয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো ঘটনাটা কি? বাবা সোহেলীকে বলল আজ তোর বিয়ে তালেবের সাথে আলোচনা করছি।
সোহেলী হাল্কা প্রতিবাদের সুরে বলল ‘আমার বিয়ে আর আমি কিছুই জানলাম না। আমার পছন্দ কিনা তা একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না?
এ কথা শুনে সোহেলীর বাবা একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। খেঁকিয়ে উঠে বলল, “রাজকন্যা যেন। তার জন্য রাজপুত্ররা সব এসে লাইন দিয়ে বসে থাকবে আর রাজকন্য একটাকে পছন্দ করে নেবে। তোকে যে কেউ বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে এইতো তোর সৌভাগ্য।
-কার সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছো মরা না তাজা একবার দেখবও না।
-যা দেখার তালেব দেখেছে। দেখেশুনেই সে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তোর কিছু দেখতে হবে না।
সোহেলী বাবার উপর অভিমান করে আর কোন কথা বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বলল গরীবের ঘরে জন্ম নিয়েই পাপ করেছি। বিধাতা আগেই আমার ভাগ্য পুড়িয়ে দিয়েছে। শুধু শুধু অন্যের উপর রাগ করে কি লাভ !
রাত সাড়ে আটটার দিকে সোহেলীর বিয়ে হয়ে গেল আনোয়ারের সাথে। টাকা ছাড়া সোহেলীর বিয়ে দিতে পারায় তার বাবা খুশিতে যেন আকাশে উড়ছে। কিন্তু তিনি যে এই মুহূর্তে মেয়ের সবচেয়ে বড় সর্বনাস করলেন সেদিকে তার কোন খেয়ালই রইল না।
আনোয়ার বরের নাম। অতি দরিদ্র পরিবারের যে সব মেয়ে দেখতে মোটামোটি ভাল তাদের খুঁজে বের করে বিয়ে করাটা তার একটা নেশা। এটা তার কাছে সস্তায় একরকমের সহজ বিনোদন। তারপর হঠীৎ একদিন কাউকে না বলে কোথায় চলে যায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিক যেভাবে হঠাৎ এসেছিল সেভাবে সে হঠাৎ চলে যায়। কাউকে কোনসময় প্রয়োজন হলে সে আবার ফিরে আসে। সামান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য সে যে কোন জঘন্য কাজ করতে মোটেও বিচলিত হয় না। বরং এরই মধ্যে সে একটা বিকৃত আনন্দ খুঁজে পায়।
আনোয়ার দেখতে ভালই বলা চলে। হাঁটলে তার মধ্যে একটা ভদ্র এবং বিনয়ের ছাপ ফুটে ওঠে। সে কারণে দরিদ্র মেয়ের পিতা সহজেই তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায়। সোহেলী আনোয়ারের সেই বিনয়ী ভাব দেখে তার বাবার উপর যা রাগ ছিল তা মুছে গেল। স্বামী হিসাবে আনোয়ারকে পেয়ে সে এত খুশি হলো যে তার অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার কোন কৌতূহল তার মনে উদয় হলো না। সবসময় শয়তান আসে ভালোমানুষের মুখোস পরে। সে জন্য মানুষ ভুল করে। যখন তাকে চেনা যায় ততক্ষণে সর্বনাস ঘটে যায়। কিছুই করার থাকে না।
2
সেলিম এখন পার্কের মধ্যে একাকী আনমনে বসে আছে। কত কথা মনে পড়ে যায়। স্মৃতির পাতাগুলো একে একে উল্টে যায়। তাতে শুধু বেদনা আর পরাজয়ের ইতিহাস লেখা। গতকাল মা তাকে মাবাইল করেছে বাড়ি যাওয়ার জন্য। মোবাইল শুধু সেলিমের কাছে আছে। সেলিমের মায়ের কথা বলতে ইচ্ছা হলে বাড়ির পাশের ইদুলের ফোনের দোকান থেকে মিস্ কল দেয়। সেলিম সে মিস কল বেক করে।
বাড়ি গেলে মায়ের আনন্দ দেখে সে নিজেকে খুব অসহায় বোধ করে। মায়ের জন্যও তার অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা হয় অথচ সে কিছুই করতে পারে না। না পারার কষ্ট তাকে কুরে কুরে খায়। তবুও মা যেতে বললে কিছুতেই সে না বলতে পারে না। তার বিশ্বাস মা যদি তার জীবনকেও চাইতো তাহলে সে নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতে পারতো।
সেই ছোটবেলায় পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা গিয়েছে। বাবাকে ভালো করে মনে নেই। সংসারের হাল ধরার মতো কেউ ছিলো না। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি মা কোন রকমে আগলে রেখেছিল। যা রেখে গিয়েছিল তাতেই দু’জনের বেশ ভালোভাবেই চলে যেত কিন্তু সেলিমের মা মেয়ে মানুষ তাই সবকিছু একা সামলাতে পারতো না। বিভিন্ন মানুষের কাছে বারবার যেতে হতো। এই করছি করবো বলে বেশির ভাগ মানুষ সেলিমের মাকে ঠকাতো। সে বুঝতে পারতো তবুও কিছুই তার করার ছিল না।
মানুষ যখন অসহায় বা দুর্বল হয় তখন কিছু মানুষ তার কাছ থেকে সহজে ফায়দা লুটার চেষ্টা করে। দুঃসময়ে আত্মীয়স্বজন কেউ সেলিমদের পাশে ছিল না। মায়ের স্বপ্ন ছিল সেলিম বড় হয়ে সৎভাবে চলে তাদের মত অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করবে। সেলিম তার মাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছে যে নিজে ভালো থাকার জন্য, নিজের আরাম আয়েশের জন্য, নিজের সুখে থাকার জন্য, যাকিছু করা হয় সবগুলোই সৎকাজ। সেটাই হলো মানুষ হওয়া। কিন্তু তার মা এসবের কিছুই বুঝতে চায়নি।
এইসব ভাবতে ভাবতে সে রুমে ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালো। তারপর ধীরে ধীরে চিন্তার বোঝা মাথায় নিয়ে রুমে ফিরলো। খেয়েদেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই সে ঘুমাতে পারছে না। শুধু বার বার মায়ের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। এভাবে এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় সে নিদ্রার কোলে ঢোলে পড়লো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। কিন্তু সেই সাথে মায়ের সাথে দেখা করার একটা তীব্র টান সে অনুভব করল। অবশেষে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গুছিয়ে ব্যাগে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
বেলা বারটার মধ্যেই মালীডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ডে বাস এসে থামল। পাশেই বাজার। সেলিমের মা কাতরা দই খেতে খুব পছন্দ করে। মায়ের জন্য দই কিনলো সে। আর এক কেজি গরুর মাংস। সেলিম গরুর মাংসের ঝোল চালের রুটি দিয়ে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে খেতে খুবই পছন্দ করে।
সেলিমের মা তার জন্য খুব যত্ন করে রান্না করার পর তাকে সামনে বসিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখতে যেন পৃথিবীর সব চাইতে আনন্দ উপভোগ করে। এটা যেন তার মায়ের কাছে একটা স্বপ্নের মত।
বাজার থেকে সেলিমের বাড়ি ভ্যানে যেতে হয়। এখনও রিক্সার প্রচলন হয়ে ওঠেনি। বিশ মিনিটের পথ। একটা মাঠ পেরিয়ে কয়েকটা বাড়ির পর তাদের বাড়ি। বাজারে থাকতেই তার আগমন খবর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল। খবর পেয়েই সেলিমের মা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে সেলিমকে খুঁজছে। অবশেষে দুর থেকে সেলিমকে দেখে যেন তার আত্মা জুড়িয়ে গেল। সাথে সাথে বাধ ভাঙ্গা খুশির ঢেউ তার হৃদয়ের দুই তীরে প্রচন্ড বেগে আছড়ে পড়লো। সমস্ত শরীর একবার কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। খুশিতে মনটা একেবারে ভরে গেলো।
মাকে দেখেই সেলিম বেশ দুর থেকে মা বলে ডাক দিলো। তারপর কাছে এসে ভ্যান থেকে নেমে পড়লো। সে ব্যাগ থেকে দই এবং গরুর মাংস বের করে মায়ের হাতে দিলো। মা বেজায় খুশি। তবুও বলল এসব কি না আনলে হয় না? কেন এতো ঝামেলা করিস। সেলিম হাসিমুখে চুপ করে রইলো। যেন কোন এক গুরুত্বপূর্ন টুর্নামেন্টে ট্রফি জিতে মায়ের হাতে দেখতে দিয়েছে। রাস্তা এবং বাড়ি লাগালাগি। তাদের বাড়ির ভিতরে যেতে দেরী হলো না। বাড়িতে ঢুকেই সেলিমকে খাওয়ানোর জন্য মা ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। তাড়াতাড়ি করে সেগুলো ধুয়ে রান্নায় চড়িয়ে দিলো। সেলিমের মায়ের কাছে আজকের দিনটা ঈদের দিনের মতো লাগছে।
খানিক পর। সেলিম ফ্রেস হয়ে জামা গায়ে দিয়ে বের হতে দেখে মা উদ্বিগ্ন হয়ে মুখে বলল, ‘কোথায় চললি আবার ? রান্নাতো প্রায় হয়ে গেল। খেয়ে যা।
সেলিম বলল, একটু ঘুরে আসি। সেলিমের মা একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেললো যেন কোনদিনই সে ফিরে আসবে না। তারপর সেলিমের যাওয়ার পথের দিকে একবার চেয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলো। বহুদিন পরে আজ মনের আনন্দে সেলিমের মা একমনে রান্না করছে। পরিশ্রান্ত। তবুও ভালো লাগছে।
রান্না শেষ হলে খাবার প্লেটে বেড়ে সেলিমের জন্য সে অপেক্ষা করছে। সময় যেন ফুরাতেই চাইছে না। সেলিম একটু ঘুরে আসি বলে গেলো তো গেলোই। কোন পাত্তা নেই। বাইরে পায়ের আওয়াজ শুনে সেলিমের মা কান খাড়া করলো মনে হয় সেলিম আসছে। সত্যি সত্যি সে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই মা খেতে দাও বলে মায়ের পাশে বসে পড়লো। মা খুশি হয়ে অতিযত্নে তাকে খাবার বেড়ে দিল। ছেলের খাওয়া দেখে সে খুব তৃপ্তি অনুভব করছে।
মাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিম বলল ‘বসে আছো কেন ? প্লেট নেও, খাওয়া শুরু কর।
-থাক পরে খাব।
একথা শুনে সেলিম খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ল। সেলিমকে উঠতে দেখে সেলিমের মা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, কি হলো তোর ? খাবার ভালো হয়নি ?
-আমিও পরে খাব তোমার সাথে।
ছেলের পাগলামি দেখে সে হেসে ফেলল। তারপর মা একটা প্লেট নিয়ে বলল, আর উঠতে হবে না। বস্। খাওয়ার সাথে প্রাণ খুলে গল্প জুড়ে দিলো। যেন দুই বন্ধু।
খেতে খেতে সেলিমের মা বলল, বাবা আমার হার্টের অসুখটা কখন বেড়ে গিয়ে মারা যাই তার ঠিক নেই। তোর বউ দেখে যাব আমার বড় সাধ ছিলো। এবার বাড়িতে যখন এসেছিস, বিয়ে না করিয়ে তোকে যেতে দেব না। বউ হবে ফর্সা। টুকটুকে। যাতে লাল শাড়িতে খুব সুন্দর লাগে। সেলিমের মা মারা যাওয়ার আতঙ্কে একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত সেলিমকে কথা দিতে হলো কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করবে। নিজেকে ক্ষুধার্ত বাঘের কাছে ফেলে দেওয়ার মতো মনে হলো, সেলিমের কাছে। যাই হোক। মায়ের খুশির কাছে তার সব কিছুই তুচ্ছ।
৩
আনোয়ারের ভালোবাসার অভিনয়ে সোহেলী একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে; আনোয়ার ছাড়া আর সে কিছুই দেখে না। কেউ হৃদয় দিয়ে যখন কাউকে দেখে, হৃদয় তাকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না।
সপ্তাখানেক পর সোহেলী আনোয়ারকে বলল, তুমি কি কোন কাজ করবে না ? বসে বসে আর কতদিন খাবে ? শুনে আনোয়ার আমতা আমতা করে বলল, কয়েক দিনের মধ্যেই কাজে যেতে হবে। শুধু সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছি। যেকোন দিন চলে যেতে হতে পারে।
-কাজটা কি ?
-কাজটা অনেক গোপনীয়, তাই তোমাকে বলা যাবে না। বললে কাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
সোহেলী আর কিছুই বলল না। আনোয়ার মনে মনে বুদ্ধি আঁটছে কিভাবে এখান থেকে সটকে পড়ার যায়। নতুন বউয়ের কোমল মন, উষ্ণ ভালোবাসা, ভরা যৌবনে উথাল পাতাল সাঁতার কাটা। সস্তায় এর থেকে আর কি বিনোদন হতে পারে ! আনন্দ ফুরালে দুঃখ আসে। আনোয়ার আনন্দের রেশ থাকতে থাকতে চুপিসারে সোহেলীকে একা ফেলে পালাতে চায়।
দুদিনপর। রাতে খেতে খেতে আনোয়ার সোহেলীকে বলল, ‘আমাকে আগামীকাল কাজে যেতে হবে। খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগিয়ে দিও।
-কোথায় যাবে, কবে আসবে ?
-সপ্তাহ খানিকের মধ্যে ফিরে আসবো। যদি স্থায়ী কোন কাজের সন্ধান করতে পারি তাহলে তোমাকেও নিয়ে যাব। সোহেলীর মন খুশিতে নেচে উঠলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাতে দুজন একই বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু আলাদা আলাদা জগতের স্বপ্নে বিভোর। সোহেলী চিন্তা করছে বাবার সংসারের আর বোঝা হয়ে বেশী দিন থাকতে হবে না। তার একটা ছোট সুন্দর সংসার হবে। চাওয়া পাওয়ার তার কিছুই নেই। শুধু পেট ভরে তিনবার খেতে পারলেই সে সুখি। দুবার খেতে পেলেও তেমন একটা ক্ষতি নেই কারণ এখানে সে অনেকদিন শুধু একবেলা খেয়ে থেকেছে। বাড়তি চাওয়া শুধু স্বামীর ভালোবাসা।
অন্যদিকে আনোয়ার চিন্তা করছে এখানে কয়েকদিন ভালোই চললো। সকালে চলে যেতে হবে। কাজের জন্য যে অঞ্চলে যাচ্ছে সেখানে অবসর সময় পেলে সোহেলীর মতো আবার কাউকে বিয়ে করে কিছু বাড়তি বিনোদন উপভোগ করবে। এরকম সে অনেক বার করেছে। হিসাব কষতে গেলে অনেক হয়ে যাবে। কারো প্রতি কখনও টান অনুভব হয়নি কিন্ত সোহেলীকে ঠকাতে তার মনটা যেন কেমন করছে। তার বিবেক তাকে বার বার দংশন করছে। চিন্তা করলে চলবে না। দয়া মায়া সকলের আছে তবুও সময়ের প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হতে হয়। ভালোভাবে টিকে থাকতে গেলে শুধু সামনের দিকে তাকাতে হয়।
আনোয়ার সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাল পাচার চক্রের সাথে জড়িত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে জানে না কি সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু জানে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে যাচ্ছে পৌছে দিতে হবে জায়গা মতো।
খুব ভোরে সোহেলী ঘুম থেকে উঠে আনোয়ারের জন্য গরম ভাত তরকারী রান্না করে তাকে খাওয়ার জন্য ডাকলো। কেনযেন সোহেলীর কাছে গরম ভাতের গন্ধটা খুব ভালোলাগে। আনোয়ারকে তাড়া দিল তাড়াতাড়ি খেতে বসার জন্য। আনোয়ার যতটা সম্ভব দ্রুত আসলো। কতদিন পর আবার দেখা হবে। তাই সোহেলী আনোরয়ারকে পাশে বসিয়ে পরম যত্ন করে খাবার পরিবেশন করছে। খাওয়া শেষ হলে, আনোয়ার ব্যাগ গুছিয়ে বের হলো। যাবার বেলায় সোহেলীর বুক ভেঙ্গে বার বার কান্না এসে যাচ্ছে। টলোমলো চোখে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় আনোয়াকে বিদায় দিলো। পথের দিকে আর তাকাতে পারছে না সে। চোখ পানিতে ভরে গেছে। উপছে পড়ছে গাল বেয়ে টপটপ করে। সামান্য কয়েকদিনের পরিচয়, কাছাকাছি থাকা। তার জন্য এত টান!
আনোয়ারের বুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস। সে চিন্তা করলো না। তাকে না পেয়ে সোহেলীর চোখে এখন শ্রাবনের ধারা। এ পৃথিবীতে কে কার? শুধু নিজের সুখ আর শান্তির জন্য সবাই ব্যস্ত। নিজের জন্য এই পৃথিবীর সবকিছু। নিজের সামান্য সুবিধার জন্য অন্যের জীবন তিলে তিলে শেষ হয়ে গেলেও তাতে কিছু আসে যায় না। তাই আনোয়ারের সোহেলীকে নিযে কোন ভাবনা নেই। নিজে আনন্দ পেয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
প্রতিদিন সোহেলী আনোয়ারের পথ চেয়ে বসে থাকে এই বুঝি এসে পড়বে। দেখতে দেখতে ছয় মাস পার হয়ে গেল। তবুও আনোয়ার আসে না। সোহেলী আগে গ্রামের মধ্যে সাবলীলভাবে ঘুরে বেড়াত। এখন মনে হয় সব যেন অপরিচিত। সামান্য কয়টাদিন আনোয়ার তাকে যেন ভিন্নভাবে গড়ে দিয়ে গেছে। এসবের সাথে অভাবের তীব্রতা। বিধাতা যেন তার ঘরে বিষাক্ত একদল কেউটি ছেড়ে দিয়েছে। তারা সুযোগ পেলেই দংশন করে তাকে বিষ ঢেলে দেয়। সেই বিষের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে বেঁচে আছে। সময় যেন ফুরাতেই চায় না। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে আনোয়ারকে পাওয়ার তীব্রতা তার মধ্যে বেড়ে যায়। প্রায় প্রতি রাতেই স্বপ্ন দেখে আনোয়ার এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে।
৪
আনোয়ার এখন নিজের কাজে ব্যাস্ত। আনোয়ার কথায কথায় মফিজের কাছে সেহেলীর গল্প করে। সে আনোয়ারকে প্রস্তাব দেয় সোহেলীকে তার কাছে দিয়ে দেওয়ার জন্য। যদি সোহেলীকে তার কাছে তুলে দেয় তাহলে সে মোটা অংকের টাকা পাবে। মফিজ পতিতালয়ের এক দালাল।
আনোয়ার বলল, কতদিন হয়ে গেলো তার কোন খোঁজখবর নেইনি এখন হঠাৎ করে গেলে কোন বিপদের মধ্যে পড়তে পারি। তাছাড়া আমাকে বিশ্বাস করে আমার সাথে আসবে বলে মনে হয় না।
-দেখ্না চেষ্টা করে। জীবনে ঝুঁকি না নিলে কিছুই হবে না। তুই যে নিয়মিত মাল পাচার করিস এগুলো কি ঝুঁকি না নিয়ে হয় ?
-মাল আর মানুষ কি এক হলো। মানুষের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা সারা জীবনের জন্য থেকে যায়। মালের ক্ষেত্রে শুধু সামান্য সময়ের।
-এজন্যই তো লাভটা বেশী। দেখনা একবার চেষ্টা করে।
আনোয়ারের বিবেক কিছুতেই সায় দিলো না এরকম প্রস্তাবে সাড়া দিতে। একবার সে বিয়ে করে ফেলে রেখে এসে চরম অন্যায় করেছে। তার জীবনে হয়তো সে নরকের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছে। এবার যদি সে সোহেলীকে দালালের হাতে তুলে দেয় তাহলে তাকে নরকের গভীরে নিক্ষেপ করা হবে। না, সে এ কাজ কিছুতেই করতে পারবে না।
কয়েকদিন পর।
সকালে নাস্তার সময় আনোয়ারের বন্ধু রানা হাজির হলো তার পাওনা টাকার জন্য। আনোয়ারকে বলল, দোস্ত আমার টাকাগুলো তিনদিনের মধ্যে দিতে হবে। ভীষণ দরকার। না হলে বিপদে পড়ে যাব।
খাবে কি এই চিন্তা আনোয়াকে যখন দু:স্বপ্ন তাড়া করে ফিরছিল। তখন রানা তাকে কাজের সন্ধান করে দিয়েছিল। এখনও রানার জন্যই সে এ লাইনে টিকে আছে। রানার সাথে যদি তার কোন গোলযোগ হয় তাহলে তাকে না খেয়ে মরতে হবে অথবা জীবন ও হারাতে হতে পারে।
যাইহোক। রানাকে আনোয়ার বলল, দোস্ত চিন্তা করিস না। আমি তোর টাকা যথা সময়ে ফেরত দেব। মুখে বলল ঠিকই কিন্তু টাকা যোগাড়ের কোন পথ পেলো না। তখন থেকে দালালের দেওয়া প্রস্তাবটা শুধু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। অবশেষে, পরেরদিন সকালে দালালের সাথে দেখা করে সোহেলীর বাড়ির দিকে রওনা হলো।
অনেকদিন পর একটা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছে সোহেলীর কাছে। মনে ভয় আর লোভ একসঙ্গে বুকে বাসা বেঁধেছে। বিকেল গড়িয়ে কেবল সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আবছা আলোয় মানুষের মুখ কিছুটা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। তবু চেনা যায়। গ্রামের লোকজন তাকে তেমন চেনে না। তাই কাউকে কোন প্রশ্নের জবাব দিতে হয়নি। আনোয়ার ভাবল, যাক যাত্রাটা শুভ বলে মনে হচ্ছে। সোহেলীদের বাড়ির মধ্যে ঢুকার আগে পরিবেশটা কেমন আছে খানিকক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে বুঝে নিতে চাইলো।
এখনও রাতের অন্ধকার নামেনি। আবছা আলোয় মানুষকে পরিষ্কার চিনতে পারা যায়। আনোয়ার দেখল, সোহেলী এখনও রান্না করছে। খোলা আকাশের নিচে চুলা। সামান্য উঠানের এককোনে। এক নিবিষ্ট মনে চুলায় ভাত দিয়ে দুই হাঁটুর উপর মুখ রেখে কি যেন বসে বসে ভাবছে। এমনভাবে সে বসে আছে যেন জনমানব হীন কোন এক দ্বীপে তাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। আর সে বসে বসে মুক্তির পথ খুঁজছে। কিন্তু কোন পথ নেই। কোন আশাও নেই। শুধুই অবাধ্য মনের ভাবনা। দেখে আনোয়ারের বুকের মধ্যে সুক্ষ একটা বেদনার টান অনুভব হলো। তারপরই দুষ্ট বুদ্ধিগুলো চোখের তারায় খেলা করে গেল।
সোহেলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বাড়ির মধ্যে আনোয়ার ঢুকে কোন কথা না বলে শুধু শব্দ করল। সাড়া শব্দ না পেয়ে জোরে গলা খাকারী দিল। সোহেলী শব্দের দিকে খেয়াল করতেই আনোয়ারকে দেখে ভূত দেখার মতো করে চমকে উঠলো। সেইসাথে বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কোন কথা মুখ দিয়ে আর বের হলো না। সে যেন স্বপ্ন দেখছে। তারপর চোখে নামলো জলের স্রোত। কিছুতেই যেন আর বাঁধ মানতে চাইছে না। এ অশ্রু ভালোবাসার, এ অশ্রু আনন্দের। যেন সব দুঃখ গলে গিয়ে আনন্দের ঝর্ণা ধারা হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোহেলীর মন যেন বর্ণময় মেঘ হয়ে আকাশের বুকে ভেসে বেড়াতে লাগল এক অনাবিল আনন্দে।
সোহেলীর আনন্দ দেখে আনোয়ারের ভিতরের লোভী কাল কেউটিটা তার বিষাক্ত ফণা মেলে ধরলো। সুযোগ বুঝে ছোবল মারার জন্য। সোহেলী তাড়াতাড়ি করে আনোয়ারকে পানি এনে দিল হাত-পা ধুয়ে বসার জন্য। সে বলল, তুমি বসতে বসতে খাবার হয়ে যাবে। আমি খাবার দিচ্ছি। রান্না শেষ হলে সোহেলী পরম মমতায় তাকে খাবার পরিবেশন করতে লাগলো। আজকে তার সবকিছুতেই ভালো লাগছে। সে আনোয়ারকে বলল, এতদিন দেরী করলে কেন আসতে? আমিতো তোমার আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম বোঝা ভেবে আমাকে ফেলে পালিয়েছ। তবুও মন বলত, তুমি আসবে।
সুযোগ অনায়াসে ধরা দিলো আনোয়ারের হাতে। সে খুব সহজভাবে এক গুচ্ছ মিথ্যা কথা বলল, এতদিন আসলে কোনভাবেই নিজেকে গুছিয়ে উঠতে পারিনি। তাই মনে করেছিলাম যখন দুজনের থাকার ব্যাবস্থা করতে পারব তখনই তোমাকে এসে নিয়ে যাব। তাই আসতে এতো সময় লাগলো। সেজন্য আমার নিজের কাছেই আমি লজ্জিত। এখান থেকে গিয়ে সব সময় তোমাকে মনে পড়েছে। কিন্তু নিজের অক্ষমতার জন্য কিছুতেই আসতে পারিনি। আজ আমি সক্ষম। তোমাকে নিতে এসেছি। তুমি যাবে আমার সাথে ?
সোহেলীর চোখ আনন্দে ছলছল করে উঠলো। একগুচ্ছ রঙিন স্বপ্নের মধ্যে সে হারিয়ে গেলো। আনোয়ার সেটা লক্ষ্য করে বলল, তুমি যদি রাজি থাক তাহলে আগামী কাল তোমাকে নিয়ে রওনা হতে চাই। বাসাবাড়ি সব ঠিক করে রেখে এসেছি। জিনিসপত্র কিছু কেনা হয়েছে। আর কিছু বাকী রেখেছি তোমার জন্য। সংসারে কোনটা দরকার, কোনটার দরকার নেই সেটা তুমি ভালো বুঝবে। তাই কেনা হয়নি সবকিছু।
এতো সুখ সোহেলীর বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ইচ্ছা।
-তাহলে আমরা খুব ভোরে রওনা দেব। তুমি তোমার আব্বার সাথে কথাগুলো সেরে নিও।
-আচ্ছা।
সোহেলীর বাবা জামাইয়ের খাওয়া শেষ হলে সোহেলীর সাথে কথা বলার অপেক্ষায় বসে ছিল। আনোয়ারের খাওয়ার কিছুক্ষণ পর সোহেলী তার বাবাকে খেতে ডাকলো। দেরী না করে গিয়ে বসল তার বাবা। কিভাবে সোহেলী কথাটা বলবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না। খেতে খেতে সোহেলীর বাবা বলল, ওর মতিগতি কিছু বুঝলে ?
সোহেলী ভয়ে ভয়ে বলল, বাসা ঠিক করেছে আমাকে আগামীকাল নিয়ে যাবে। বৃদ্ধ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। সংসারের বোঝা টানতে টানতে সে ক্লান্ত। বিশ্রাম চাই। এখন সে নিশ্চিন্তে মরতে পারবে। সে উজ্জ্বল চোখে সোহেলীর দিকে তাকিয় বলল, দেখিছিস্, আমি তোকে বলেছিলাম না আনোয়ার ভালো ছেলে। সে কখনও বেঈমানী করতে পারে না । এবার দেখলি !
সোহেলী লাজুক হেসে বলল, থাক থাক আর উকালতি করতে হবে না। বৃদ্ধ অনেকদিন পর শান্তি নিয়ে খাবার খেলো। খেয়ে লুঙিতে হাত মুছতে মুছতে বলল, আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকতো তাহলে তোর ভাগ্যে সুখ দেখে কত খুশিই না হতো সে!
মার কথা মনে হতে সোহেলী ছলছল চোখে বলল, বাবা ভাগ্যের কথা বলো না। আমরা গরীব মানুষ। বিড়াল ইঁদুরকে নিয়ে খেলা করে। প্রাণ ভয়ে ছুটতে ছুটতে সে ক্লান্তিতে শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মাঝখানে হঠাৎ করে সে বেঁচে উঠার স্বপ্ন দেখে। তখন বিড়াল মজা পায়। ঠিক সেরকম বিধাতা গরীব মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা করে। জন্ম অবধি দেখে আসছি সুখ আমার কপালে সয় না। এবারও সইবে কি না কে জানে? কপালে যা লেখা আছে তাতো হবেই। গরীব মানুষের অত ভাবতে গেলে কী চলবে। তাছাড়া আমার বোঝা তো তোমাকে আর বইতে হবে না। এই আমার আনান্দ। যত কষ্টই হোক আমি আর ফিরব না। তুমি জেনে থাকবে আমি ভালো আছি। এছাড়া তুমি এর থেকে কিইবা করতে পার? আমি মেয়ে হয়ে জন্মে তোমার আরো কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছি। জীবনে কোনদিন তোমাকে আনন্দিত করতে পারিনি। যদি একবার তোমাকে খুশি দেখি এইবা কম কিসের?
সোহেলীর বাবা চোখ মুছতে মুছতে বলল আমি এক অক্ষম বাবা। সন্তানের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট তুই কি করে বুঝবি?
-আমি সব বুঝি বাবা।
বাতিটা টিমটিম করে জ্বলছে। সে আলোয় দুটি জীব বসে আছে। কাছাকাছি তবু যেন তারা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যৎ তাদের কাছে আবছা অন্ধকারের মতো। আছেমাত্র একফালি আলোর মতো একফালি স্বপ্ন দুজনের অনেক্ষণ এভাবে কেটে গেল। কেহই যেন কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এক অসস্তিকর অনুভুতি।
সোহেলীর বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল যা তাড়াতাড়ি এসব গুছিয়ে শুয়ে পড়। আনোয়ার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপর সে উঠে চলে গেলো। কিন্তু সোহেলী বসেই রইল। কত কি যে মনে হচ্ছে তার। একসময় উঠে অশান্ত মনে জিনিসপত্র একে একে গুছাতে লাগলো। কত স্বপ্ন তার চোখে খেলা করে যায়। ভাবতে ভাবতে তার হাতের কাজ শেষ হয়ে গেলে সে আনোয়ারের কাছে গেল। মনে করেছিল আনোয়ার এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তার মনও যে আজ অশান্ত ঘুম আসবে কি করে।
সোহেলী বলল, কি ব্যাপার এখনও ঘুমাওনি।
আনোয়ার বলল, তুমি আসবে তারপর ঘুমাবো সে আশায় জেগে আছি।
-এইতো আমি এসে গেছি।
গভীর রাত দুজনের ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু কেউ কাউকে জানতে দিচ্ছে না । স্বামী স্ত্রী ভাবনা দুজনের এক হওয়া উচিত ছিল। হাজার বছর পাশে থাকলেও কেউ কারো আপন হয় না। আর তাদেরতো মাত্র কয়দিনের পরিচয়। এটাও ঠিক যে, যে আপন হয় তার জন্য বেশি সময় লাগেনা।
দুজনের মনে ভিন্ন ভাবনা ! একজন চাইছে কিভাবে আরো ভালোবাসা দিয়ে সব দুঃখকে মুছিয়ে দেবে। আরেকজন ভাবছে এই ভালোবাসার ফাঁদ পেতে কিভাবে অন্যকে প্রতিমার মতো বির্সজন দেবে। হায়রে পৃথিবী, তোমার বুকে কেউ কারো আপন নয়! ভালোবাসার কোন মূল্য নেই!! সবকিছুই কচুর পাতার পানির মতো ক্ষণস্থায়ী। স্বার্থটা ধ্রুব তারার মতো স্থায়ী। নিজের স্বার্থের জন্যই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকা, স্বার্থের জন্যই সবকিছু !
৫
সকাল হতেই সোহেলী উঠে পড়ল। গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি। কিছুটা ক্লান্তি লেগে আছে। আনোয়ার বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। জিনিসপত্র রাত্রেই গোছানো ছিল। সকালে শুধু চট করে রান্না করে সোহেলী আনোয়ারকে ডাকলো। আনোয়ার ঘুম ভাঙতেই বলল, তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
সোহেলী বলল, সবকিছু গোছানো হয়ে গেছে। তোমার খাওয়া দাওয়ার পরে আমরা রওনা দেব। আনোয়ার তাড়াতড়ি টয়লেট করে হাত মুখ ধুয়ে আসলো শুভ কাজে দেরী করতে নেই। আজ বিদায়ের সময়ে সবাই এক সাথে খেতে বসল। খাওয়া দাওয়ার পর দু’জনে সোহেলীর বাবার কাছ থেকে বিদায় নিল। সোহেলীর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। গলার স্বর আটকে যাচ্ছে। কোন মতে বলল, বাবা আমার জন্য চিন্তা করো না। ভাগ্যে যা আছে হবে। তোমার দিকে খেয়াল রেখো। সোহেলীর বাবা যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। শুধু চোখ মুছল।
শান্ত সকাল। একটা শালিক উড়ে এসে উঠানে বসল। সবেমাত্র সূর্যটা আকাশের বুকে উঁকি দিচ্ছে। প্রচন্ড বেগে ঝড় উঠার আগে প্রকৃতি যেভাবে প্রকৃতি রকম শান্ত থাকে সেরকম আজ সোহেলীর মনের অবস্থা । তবুও কিসের টানে আনোয়ারের সাথে সাথে চলছে এক অপরিচিত পৃথিবীতে। যেখানে আনোয়ারকে আরো আপন করে পাবে। এতদিনের তপ্ত হৃদয় প্রেমের জলে সিক্ত হবে। সে চলছে আশা বুকে বেধে। স্বপ্ন চোখে নিয়ে। কি যে ভালো লাগছে তার ! ভালোতো লাগবেই স্বর্গের সেতু দিয়ে সে যে নরকের পথে হেঁটে চলছে।
আনোয়ার সোহেলীকে বলল তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে যাওয়ার পথে আমার বন্ধুর বাড়িতে দেখা করে যাব।
‘আমার আপত্তি করার কি আছে ? সোহেলী উত্তর দিল।
বন্ধুর বাড়ি বেড়িয়ে সন্ধার পর তারা যশোরে পৌঁছাল। এখানে আনোয়ার এখন আছে। দুতালায় একটা রূমে আনোয়ার সোহেলীকে নিয়ে গিয়ে বলল, আমি এই এক রুম ভাড়া নিয়েছি। পরে সুবিধা হলে দুই রুমের বাসা নেব।
সোহেলী বলল এই আমার অনেক। তুমি তোমার সুবিধা মতো যেখানে রাখবে সেখানেই আমি থাকতে পারব। কথায় কথায় সময় গড়িয়ে চলল। আনোয়ার সোহেলীকে বলল আমি বাইরে থেকে খাবার কিনে আনি ততক্ষণে তুমি একটু বিশ্রাম করো। বেশি দেরী করলে হোটেলে আর খাবার পাওয়া যাবে না।
-বেশি দেরী করো না।
-আমি যাব আর আসব। আনোয়ার বাইরে বেরিয়ে গেল। এ পৃথিবী শুধু নিজের জন্য, নিজেকে সর্ব স্তরে বাঁচিয়ে রাখায় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। অন্যের কি হলো তা খেয়াল করতে নেই। খেয়াল করা মানে বোকামী করা। আনোয়ার এত বোকা নয়। মিথ্যার চাদরে মুখ ডেকে সে এখন দক্ষ অভিনেতা।
৬
সে সোজা চলে গেল মফিজের কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে সোহেলীর সরল ভালাবাসা তার মনে পড়ে গেল। তাকে থামিয়ে দিতে লাগল। সে দ্বিধাদন্দ্বে পড়ে গেল। শেষমেষ বলল ‘দোস্ত আমিতো নিয়ে এসেছি কিন্তু আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। সোহেলীকে আমি তুলে দিতে আমি পারব না দোস্ত।
-তোমার কি হলো যে হঠাৎ করে বদলে গেলে। গেলে এক কাজে আর একদিনেই ফলাফল উল্টে গেলো। তবে বিশহাজার টাকা কিন্তু কম নয়। মনে রেখো। শুনলাম রানা নাকি তোমার কাছে টাকা চেয়েছে আগামী কালকেই তাকে দিতে হবে মেনেজ হয়েছে?
-সে আমি দেখব। তোমাকে ভাবতে হবে না।
-ঠিক আছে। তবে পথ খোলাই রইল দরকার হলে এসো।
আনোয়ার এক দ্বিধা নিয়ে মফিজের রুম থেকে বের হলো। পথেই রানার সাথে দেখা। আমার টাকার ব্যাবস্থা করতে পারলে ? রানা জিজ্ঞাসা করল।
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। এতক্ষণ আবেগের মধ্যে ছিল। এখন বাস্তবতায় ফিরে এলো। সে রানার সাথে ছিল বলেই আজকে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। তাকে ছাড়া আনোয়ারের তো চলবে না। বাঁচতে হলে তার সাথেই থাকতে হবে। নিজের জীবনের জন্যই তো সবকিছু। আগে নিজে বাঁচা। পরে অন্যের চিন্তা।
আবার আনোয়ার ফিরে গেলো মফিজের কাছে। গিয়ে চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। দেখে মফিজ বলল কী ? রাজি । রাজি থাকলে টাকা নিয়ে যাও।
আনোয়ার দুর্বল স্বরে বলল, দাও । মফিজ টাকা দিয়ে বলল বিশ হাজার আছে গুনে নেও।
আনোয়ার কিছু না বলে কাঁপা কাঁপা হাতে না গুনে টাকাটা পকেটে পুরলো। তার বুকের মধ্যে এখন ঝড় বইছে। প্রথম বারের মতো কোন একটা খারাপ কাজে আনোয়ারের হাত কাঁপছে। ভেবে সে নিজেই অবাক হলো। তারও হৃদয় আছে ! মানুষ্যত্ববোধ এখনও মরে যায়নি !!
-মাল রেডী রাখবা। সময় মতো আমরা দখল নেব। তোমার রুমের পাশেই আমাদের লোক তৈরী থাকবে। ঘুমালে তুমি সময় মতো দরজা খুলে শুধু আমাদের খবর দেবে, তোমার দ্বায়ীত্ব শেষ। কি করতে হবে আর আমরা কি করি তাতো সবই তুমি জান। খবর না দিলেও খুব একটা ক্ষতি নেই। একটু বাড়তি পরিশ্রম আর কি। আমাদের কাছে কেউ এসেছে অথচ ফিরে গেছে এরকম কখনও হয়েছে নাকি ?
আনোয়ার শুধু তার মুখের দিকে চেয়ে থাকল।
-কি ব্যাপার বোবা হয়ে গেলে নাকি ?
কিছু না বলে মফিজের রুম থেকে সে বেরিয়ে আসলো। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। হাঁটছে যেন জীবনের পরাজিত সৈনিক। পৃথিবীর সমস্ত বোঝা তার মাথায়। মানুষের মন এক বিচিত্র জিনিস। সময় অসময়ে শুধু বদলায়। একদিন আগেও সোহেলীকে বিক্রি করার চিন্তায় মন ছিল আনন্দে পূর্ণ। একদিনের ব্যবধানে সেই একই চিন্তায় মনে ব্যথা বাজে। ফেরার পথে হোটেল থেকে গরুর মাংস, ভাত, সবজি, ছোট মাছ আরো কোল্ড ড্রিংকস্ কিনে নিলো।
সোহেলী ক্লান্ত শরীরে অপেক্ষা করছে। অপরিচিত জায়গা। আনোয়ারের দেরী দেখে সে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে। আনোয়ারকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে বলল খাবার আনতে এত দেরী !
আনোয়ার মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে বলল, একটু দেরীই হয়ে গেলো। তারপর খাবারগুলো নিজেই বের করতে করতে বলল বেশ রাত হয়ে গেছে। তোমার মনে হয় অনেক ক্ষিদে লেগেছে। খেয়ে নেও।
-আমার না খেয়ে থাকারও অভ্যাস আছে।
আনোয়ারের ঘর থেকে প্লেট বের করে সোহেলী এগিয়ে দিল। দু’প্লেটে দু’জন নিয়ে খেতে শুরু করল। খেতে খেতে নানা অপ্রাসাঙ্গিক কথা আনোয়ার অবতারাণা করল। যাতে গল্প জমে ওঠে। কোন রকম সন্দেহ সোহেলীর চোখে না জাগে। আনোয়ার চায় সবকিছুই স্বাভাবিক থাকুক। খাওয়া শেষ হলে আনোয়ার বলল, বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়ি। সারাদিনে শরীরের উপর অনেক ধকল গিয়েছে। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে।
বিছানা পেতে দু’জনই শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত শরীর। সোহেলী শুতে শুতে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আনোয়ার এক উত্তেজনায় একটু পরপর ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। বারবার আড়চোখে দেখছে সোহেলী ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা। শেষ রাতের দিকে মানুষের ঘুম খুব গভীর হয়। সে সময় সে দেখল সোহেলী গভীর ঘুমে অচেতন। আস্তে আস্তে ঘুম থেকে উঠে আনোয়ার টাকাগুলো ব্যাগ থেকে নিয়ে দরজা খুলল যেন কোন শব্দ না হয়। ঘর থেকে বের হয়ে দরজাটা আবার ভিড়িয়ে দিল। পাশের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে ভাবছে এখন সে কি করবে ? কোন খবর না দিয়েই কি চলে যাবে ? এরকম সিদ্ধান্তহীনতায় সামান্য একটু পায়চারি করতেই দরজা খুলে গেল।
মফিজের জিজ্ঞাসা ‘ খবর দিতে এত দেরী হচ্ছে কেন ? মাল ঠিক আছে ?
-আছে।
-ঠিক আছে। তুমি যাও।
আনোয়ারের মনটা একেবারে বিষণ্ন হয়ে গেল। কেন বারবার এরকম হচ্ছে। আগেতো কখনও হয়নি। তবুও তার টাকাগুলোর কথা খেয়াল হতেই একরকম তৃপ্তির হাসি হেসে নিল। সামান্য প্রচেষ্টায় এত লাভ। টাকা যেমন মানুষকে মহান করে তেমনি আবার অমানুষ বানিয়ে দেয়। আনোয়ারের কোন বিকার নেই। রাত প্রায় শেষের পথে।
মফিজ এবং তার সঙ্গপাঙ্গ আরো দুজন সোহেলী যে ঘরে শুয়ে আছে সে ঘরে খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল। পায়ের শব্দে সোহেলীর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই তার ঘরে তিনজন অপরিচিত লোক দেখে চমকে উঠল। তাকে কিছু বলার কোন সুযোগ না দিয়ে মফিজ বলল, তোকে আমরা আনোয়ারের কাছ থেকে নগদ কড়কড়ে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। তুই এখন চার দেওয়ালের মাঝে আমাদের সম্পত্তি। তোকে দিয়ে আমরা ব্যাবসা করব। আদিম যুগের ব্যাবসা। বলেই সে একটা তৃপ্তির হাসি দিল।
তারপর ঘটে গেল সোহেলীর জীবনের চরম সর্বনাশ। শুরু হলো জীবনের আর একটি অধ্যায়। সে অধ্যায় কলঙ্ক আর নির্যাতনের। সময়ের হিসাব সোহেলী আর করে না। সময় থেমে গেছে। সে ভোগ করছে নরক যন্ত্রণা। এখানে রাতদিন সব সমান। তবুও কিভাবে দেখতে দেখতে তিন মাস পেরিয়ে গেল। এখন সে নিষিদ্ধ রাজ্যের পোষমানা পাখি। আশ্চর্যের বিষয় সে এখনও বেঁচে আছে। আশাহীন, স্বপ্নহীন। কেন কিসের জন্য সে নিজেই জানে না।
ভরা সন্ধ্যায় বসে আছে কোন একজনের প্রতীক্ষায়। কত কথা মনে পড়ে। সবেমাত্র সন্ধ্যা পার হয়ে রাত্রি নেমেছে। এই সময় সে সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে এসে বাবার জন্য চুলা জ্বালাতো। কোনদিন হয়তো সামান্য ভাতে আধ পেটা করে থাকতে হতো। তবুও সেই স্মৃতি এখন সবচেয়ে মধুর। জীবনের সোনালী অধ্যায়। কত সুখেই না ছিল সে। মানুষ যখন কষ্টে থাকে তার সুখের দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে। তখনকার সাধারণ জিনিসগুলো হয়ে ওঠে কত সুন্দর। এখন তার কাছে সমস্ত জগৎ সংসার যেন মলিন ধোয়ার মতো অস্পষ্ট।
৭
সেলিম ভাগ্য বিড়ম্বিত এক যুবক। যাকিছু করতে চেয়েছে কিছুই হয়নি তার। স্বাভাবিক নিয়মে সবকিছুই হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হয়নি। অজানা কোন এক কারণে সে সফল হতে পারেনি। বারবার ভাগ্যবিধাতা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে পরাজিত। বেঁচে থাকতে তার ভালো লাগে না। তবুও বাঁচতে হয়, অপেড়্গা করতে হয় মৃত্যুর জন্য। মাকে খুশি দেখলে তার ভালো লাগে।
মায়ের চাপাচাপিতে সে বিয়েতে রাজি হয়েছে। সে মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচতে চেয়েছিল অথচ তার জীবন অন্ধকারে ঢাকা সেরকম একজনকে বিয়ে করে ভাঙা পৃথিবী আবার জোড়া লাগাবে। স্বপ্ন দিয়ে রাঙিয়ে দেবে দু’চোখ।
হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত ফাইনাল। সে বিয়ে করবে এক পতিতাকে। যাকে তাকে নয়। যে ভাগ্যের নির্মম আঘাতে পতিতালয়ে এসে পড়েছে। প্রতি মুহূর্ত মুক্তি পেতে ব্যকুল। সেরকম কাউকে। ঐ রকম একজনের খোঁজে সময়ের পরিক্রমায় পতিতালয়ের দালাল মফিজের সাথে তার পরিচয় হলো। সে মফিজকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে এমন কেউ নেই, যে মাত্র কিছু দিন হয় এসেছে।
-একজন হবে কেন বেশ কয়েকজন আছে। যারা নতুন এখনও সম্পূর্ন বশে আসেনি তাদের আলাদা জায়গা আছে। তবে সেখানের জন্য টাকা বেশি লাগবে।
-চলেন যাই দেখি।
সেখানে সোহেলীকে বিষন্নভাবে বসে থাকতে দেখে প্রথমেই তাকে নজরে পড়ল। অন্য সবার চেয়ে তাকে সতন্ত্র মনে হলো। সোহেলীকে সে বেছে নিল এবং সোহেলীর ঘরে গিয়ে সে বলল। ভনিতা না করে বলল, তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।
নিরুত্ত্বর। সোহেলী যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি।
সেলিম আবার বলল একই কথা। সোহেলী যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন মানুষও কি দুনিয়াতে আছে। নাকি লোকটা পাগল, না নেশাগ্রস্ত ? এবার ভালো করে তাকালো সে সেলিমের দিকে। সেরকম তো কিছুই মনে হয় না। তবে কেন ? নাকি এখান থেকে বের করে তাকে অন্যখানে বিক্রি করার ফন্দি করছে।
এই কয়েকদিনে সে পৃথিবীর অনেককিছুই চিনেছে, মানুষের চোখের দিকে তাকালে এখন সে অনেক কিছু বলে দিতে পারে। কোন কিছুর সাথেই সেলিম মেলে না। তার উপর বিশ্বাস এসে গেল। মানুষকে বিশ্বাস করলে ঠকতে হয়, তবুও মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে। কাউকে বিশ্বাস না করলে জীবন চলে না। তাছাড়াও সে দেখল তার হারানোর কিছু নেই। যা হারানোর সব হারিয়েছে। কোনভাবেই সেসব আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
সোহেলী বলল, আমি সমাজের চোখে নষ্ট একটা মেয়ে। আমাকে স্পর্শ করাও পাপ। দিনের আলোয় আমাদের মুখ দেখলেও অমঙ্গল হয়। তবুও রাতের বেলায় আমরা এখানে স্বর্গের দরজা খুলে বসে থাকি। মানুষ টাকা দিয়ে সেই দরজা দিয়ে ঢুকে খানিক স্বর্গ সুধা পান করতে আসে। রাতের অন্ধকারে স্বর্গের দেবী আমরা। দিনের আলোয় কোথাও আমাদের যায়গা নেই। আমাকে বিয়ে করলে রাত দিন সবসময় আমাকে মানুষের সামনে বের করতে পারবেন ?
-এখান থেকে যখন তুমি বের হবে তোমার অতীত সব ঢাকা থাকবে। কেউ জানবে না। আর আমার ওখানে তোমাকে কেউ চিনবে না। সেখানে তুমি নতুন পরিচয়ে নতুন মানুষ।
-আপনি চাইলেই তো আমাকে এখান থেকে বের করতে পারবে না। এখানে যে একবার আসে সে আর বের হতে পারে না। এখানের লোকজন কাউকে বের হতে দেয় না। মাসে মাসে থানায় টাকা দেয়। তাই পুলিশ কিছুই বলে না। যখন বের হতে দেয় তখন আর যাওয়ার মন থাকে না।
-আমি এখান থেকে তোমাকে বের করতে পারলে তুমি যাবে আমার সাথে ?
-এই বন্দী থেকে মুক্ত হতে কে না চায় ? শুধুই মিথ্যা সে স্বপ্ন। আমি কোন কিছুই আশা করি না। শুধু ভাগ্যকে বিশ্বাস করি। ভাগ্যে আপনার সাথে যাওয়া লেখা থাকলে যাব। না থাকলে নাই। আমার আর কি বলার আছে।
-আমি তোমার জন্য সবরকম চেষ্টা করব।
সেলিম সেখান থেকে বের হয়ে থানার ওসির কাছে গিয়ে বলল, আমি এখানকার একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। আপনি ওকে বের করার জন্য আমাকে সাহায্য করবেন।
ওসি, আপনাকে পাগলা কুত্তাই কামড়াইছে নাকি? দেশে এত মেয়ে থাকাতে এখানে বিয়ে করতে যাবেন কেন? আপনার ইচ্ছা হলে করেন। আপনাকে আটকাচ্ছে কে, আর আমার কাছে এসেছেন কেন ? যান যান। বিরক্ত কইরেন না। যতোসব অপদার্থের দল।
-এখানকার কিছুলোক ওকে জোর করে আটকিয়ে রেখে ব্যাবসা করছে। কিছুতেই বের হতে দেবে না।
-এটা মগের মুল্লুক নাকি? যাকে তাকে জোর করে আটকে রাখবে। আর আমরা জানব না। আপনার কি ধারণা আমরা এখানে তামাশা দেখতে আছি।
সেলিম দেখল পরিস্থিতি ক্রমশ তার নাগালের বাইরে যাচ্ছে। তাই সে বলল, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন এতে যে কষ্ট হয় তার মূল্য আমি দেব।
-কয়টাকা দেবেন আপনি?
-পাঁচ হাজার টাকা।
-ঐ টাকায় কি হয়? এত বড় একটা অভিযানে নামবো, কমপক্ষে দশ হাজার টাকাতো দেবেন।
-আমার কাছে এছাড়া আর টাকা নেই।
-তাহলে আমারও কিছু করার নেই।
সেলিমের কাছে মনে হলো তার বুকের মধ্যে ওসি সাহেব একটা তীক্ষ্ণ ছুরি ঢুকিয়ে দিল। হতাশার পাহাড় তার মাথায় এসে পড়ল। তার জীবনে কি শুধু পরাজয় লেখা ! তার কানের কাছে একটা কথা বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো, “ আপনি চাইলেই তো আমাকে এখান থেকে বের করতে পারবেন না। এখানে যে একবার আসে সে আর বের হতে পারে না। এখানের লোকজন কাউকে বের হতে দেয় না। মাসে মাসে থানায় টাকা দেয়। তাই পুলিশ কিছুই বলে না।” তার মধ্যে একটা জিদ চেপে বসল। যেভাবেই হোক চার দেওয়ালে বন্দী মেয়েটিকে আলোর মুখ দেখাবেই। সেলিম উঠে দাঁড়াতেই, ওসি সাহেব খানেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে থেকে বললেন, বসেন। কি করা যায় দেখি। তারপর এক কনস্টেবলকে ডাকল। কনস্টেবল এসে দাঁড়াতেই ওসি সেলিমকে বলল, আপনি কিছুক্ষণ বাইরে গিয়ে বসেন।
সেলিম বসে আছে, সন্ধ্য পেরিয়ে সবে রাতের অন্ধকার নামতে শুরু করছে। রাস্তার লোকগুলো নিজ নিজ ঘরে ফেরার জন্য ছুটে চলছে। ঘন্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেল, কি হলো কিছু জানা গেল না। রাতের আঁধারে শয়তান জেগে ওঠে। মেতে ওঠে তার সর্বনাসা খেলায়। ওসি সাহেব তাকে নিয়ে কোন শয়তানী খেলা খেলছে নাতো ? বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে বিশ্বাস করতে হয় কিন্তু পুলিশকে বিশ্বাস করা যায় না। তবুও কারণে অকারণে পুলিশের কাছে আসতে হয়। সে মনে করে এ দেশের পুলিশ মানুষ না, যেন তারা পৃথিবীর আজব এক প্রাণী। এ সমস্ত ভাবতে ভাবতেই অবাক হয়ে দেখল মফিজকে তার পাশ দিয়ে ওসির রুমে ঢুকতে দেখল। পরপরই তার ডাক পড়ল।
ভিতরে ঢুকলে ওসি সেলিমকে চেয়ার দেখিয়ে বলল, বসেন। মফিজের দিকে তাকিয়ে ওসি বলল, তোদের ওখানে নাকি সোহেলী নামে এক মেয়ে নতুন এসেছে। তাকে এই লোক বিয়ে করত চায়। তুই নাকি তাকে আটকিয়ে রেখেছিস ?
-আমি তাকে আটকিয়ে রাখতে যাব কেন ? আপনাদের সামনে কাউকে কি জোর করে আটকে রাখা যায়, আপনিই বলেন। সে আছে আমার জিম্মায়, আমার কাছে যারা থাকে তারা ভালই থাকে। তারা আর অন্য কোথায় যেতে চায় না। আমি তাদের পিছনে প্রথমে টাকা পয়সা খরচ করি। বিনিময়ে তারা আমাকে কিছু লাভ দেয়। এটাকে যদি জোর করে রাখা বলেন তাহলে সেটা ভারী অন্যায় হবে।
সেলিম বলল, হবে হয়তো। তবে যেতে চাইলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
-যেতে চাইলে আপনি অবশ্যই নিয়ে যাবেন। আমার আপত্তির কি আছে। তবে আমি তার জন্য যে টাকা খরচ করেছি সেটা আমাকে দিতে হবে। হয় আপনি দেবেন না হয় সোহেলী দেবে।
-কত টাকা?
-খরচ করেছি অনেক। তবে বিশ হাজার টাকা দিলেই হবে।
ওসি সাহেব সেলিমের মুখের দিকে চেয়ে বলল, শুনলেন তো সব?
সেলিমের একটা জিদ চেপে গেছে। সোহেলীকে এখান থেকে বের করবেই। সে ওসিকে বলল, ‘আমার কাছে এখন এত টাকা নেই। আমি কাল টাকা দেব। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি সোহেলীর সাথে আরেক বার কথা বলতে চাই।
ওসি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমাকে আপনার ঐ পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যান। আমি মফিজকে বলে দিচ্ছি। ওসি মফিজকে বলল, কাল এসে তোমাকে টাকা দিয়ে সোহেলীকে থানায় বিয়ে করবে। তুমি মেয়েটাকে দেখে রেখ। আর ওকে মেয়েটার কাছে নিয়ে যাও।
মফিজ বলল, আমার কোন অসুবিধা নেই। কেউ থাকতে না চাইলে চলে যাবে । তাতে আমার কি? এ কথা বলে সেলিমের দিকে ইঙ্গিত করে বলল আসেন আমার সাথে।
সবেমাত্র রাত নয়টার মত বাজে। তবুও চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। দুয়েকটি রিকশা, ভ্যান চলছে। মফিজ ও সেলিম দ্রুত সোহেলীর কাছে পৌঁছাল। সোহেলীর কাছে গিয়ে সেলিম বলল, তোমাকে নিয়ে যেতে হলে অনেক টাকা দিতে হবে। এখন আমার কাছে অতো টাকা নেই। আগামী কাল এসে টাকা দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাব।
সোহেলী অবাক হয়ে শুধু সেলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবতে লাগল এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে ! কি বিচিত্র এই পৃথিবী। এই নীল আকাশের নিচে কখন কার ভাগ্যে কি ঘটে কে রাখে তার খোঁজ। গতকালও তার ভাগ্যের আকাশে ছিল ঘোর অন্ধকার। এখন তার ভাগ্যাকাশে সোনালী সূর্য উঠার অপেক্ষায়।
পরের দিন।
সূর্যটা কেবল তার তেজ হারিয়ে দিগন্তের কোলে ঢোলে পড়তে শুরু করেছে। রাস্তায় ব্যস্ত মানুষ যে যার মতো ছুটাছুটি করছে। এর মধ্যে সেলিম বাস থেকে নেমে ভিড়ের মধ্যে জনঅরণ্যে হারিয়ে গেল। সেলিম চলছে বিশাল এক চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে। যেন জীবনের মহাসমুদ্রে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে সে একা। ঝড়ের সাথে তাকে লড়াই করে জিততে হবে। সে রিক্সা নিয়ে থানার পথে চলছে। অমসৃণ রাস্তায় বারবার ঝাঁকি খাচ্ছে। তবুও সে জীবন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে জীবনের পাতা উল্টে যাচ্ছে। সব পরাজয় আর বেদনার ইতিহাস লেখা সেখানে। রিক্সা গড়িয়ে থানার সামনে এসে থামল। সেলিমের কোন খেয়াল নেই। সে অন্যমনষ্কভাবে বসে আছে।
রিক্সাওয়ালা সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল, থানায় এসে পড়েছি নামেন। ততক্ষণে সেলিম যেন পৃথিবীতে ফিরল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওসি সাহেবের খোঁজে থানায় ঢুকে পড়ল। থানায় ঢুকতেই এক কনস্টেবলের মুখোমুখি হতেই নানা অপ্রাসাঙ্গিক প্রশ্নের পর সে বলল স্যার আছে।
সেলিমকে দেখে ওসি রীতিমত অবাক। সে ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত সেলিম পিছু হটে যাবে। ওসি বলল, আমার জীবনে আনেক অবাক হওয়ার মতো ঘটনা দেখেছি কিন্তু আজকের মত নয়। আমার মনে হয় আপনি অনেক বড় মাপের মানুষ নয়তো আপনার মাথায় কোন সমস্যা আছে।
‘হতে পারে , মানুষকে দেখার সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।’ সেলিম বলল।
-সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েকে বিয়ে করে অনেক মানুষের সংসার টেকে না। যাকে সমাজ ঘৃণা করে তাকে নিয়ে আপনি সংসার করতে পারবেন?
-এই পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মের বাইরেও অনেক কিছুই ঘটে থাকে। আর এটা ঘটে বলেই মানুষ আশা করে। স্বপ্ন দেখে, বেঁচে থাকে। কেউ আছে কোন একটি মঙ্গলের জন্য বুকে বোমা বেধে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। এটাই তার সবচেয়ে আনন্দ আর না পারলে দুঃখের সীমা থাকে না। আমি যা করছি সেটাই আমার কাছে আনন্দের বিষয়।
-জীবন আপনার, সিধান্তও আপনার। যাই হোক আমি মফিজকে আসতে বলছি টাকার বিষয়টা ওর সাথে মিটিয়ে ফেলুন। সবেমাত্র সন্ধ্যা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি নিজে আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
সেলিম এতদিন জানত পুলিশ মানুষ নয়, মানুষের মুখশে একটা আজব প্রাণী ওসি সাহেবের কথা শুনে আজ যেন তার ধারনা পাল্টে গেল। মনে হলো তারাও মানুষ। বিবেক, মানুষত্ববোধ কারো কারো আছে।
মফিজ আসার পর সেলিমের সাথে সব লেনদেন মিটে গেল। মফিজ একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিয়ে পকেটে পুরল। ওসি মফিজকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলল ঐ মেয়েটা এবং ওনাকে এইখানে নিয়ে যাও। একটা বিয়ের আয়োজন কর একটু পরে আমি আসছি।
মফিজ সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল আসেন আমার সাথে।
সেলিম মফিজকে অনুসরণ করে ওসির রূম থেকে বেরিয়ে গেল। পথ আবছা অন্ধকার। তবুও সেলিমের হৃদয়ে জ্বলছে মানবতার আলো। সে আলো তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে একটা আনন্দের রেখা ফুটে উঠেছে। কিছু সময় পর দু’জনে সোহেলীর কাছে গিয়ে হাজির হলো। সোহেলীর মুখোমুখি হতেই সেলিম বলল তোমাকে নিতে আমি আবার আসলাম। আজ আমাদের বিয়ে।
সোহেলীর কাছে মনে হলো তার সামনে কোন এক দেবতা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সে হারিয়ে ফেলেছে তার ভাষা। শুধু ঠোঁট দু’টো তার কাঁপছে। আর চোখ থেকে সমস্ত বেদনা গলে গলে আনন্দের অশ্রু হয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে। যেন সে স্বপ্ন দেখছে। সে স্বপ্নকে দুহাতে আঁকড়ে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইছে কিন্তু ঘটনার বিহ্বলতায় তার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। সে আর নড়তেও পারছে না। মফিজ তার স্বপ্ন ভঙ্গ করল।
মফিজ বলল, চল, তাড়াতাড়ি কর। আরও অনেক কাজ আছে।
সোহেলীর জামা কাপড় ছাড়া নেওয়ার মত তেমন জিনিসপত্র কিছুই ছিলনা। মাত্র কয়েক মিনিট সে সময় নিল। তারপর সেলিম ও সোহেলী মফিজের সাথে বেরিয়ে পড়ল। আধঘন্টার মধ্যে নিদৃষ্ট স্থানে তারা পেীঁছে গেল। সেখানে গিয়ে ফ্রেশ হতে না হতেই ওসি সাহেব কাজী ও একজন স্থানীয় মৌলানা নিয়ে হাজির হলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল।
অতি সাধারণ একটা বিয়ে। কোন অনুষ্ঠান নেই, লোকজনের বাহাল্য নেই। কোন আলোকসজ্জা নেই, নেই কোন উৎসব। এমনকি নব দম্পতির জন্য বাসর সজ্জা রচনা করা হয়নি। তবুও দু’জনের মনে সানাইয়ের সুর বেজে চলছে। সেলিম চিন্তা করছে একজন মানুষকে অন্ধকার জগৎ থেকে আলোতে আনতে পেরেছে এটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা। সে সোহেলীর জীবনকে আলোতে আলোতে ভরিয়ে দেবে। মুছে দেবে অতীত দিনের বেদনার স্মৃতি। সোহেলীর মনে পড়ছে প্রথম বিয়ের কথা । কত স্বপ্নতে সাজানো ছিল সে ঘর। কিন্তু সে শুধুই স্বপ্ন| বাস্তবতায় তার ঠাঁয় মিলেছে চার দেওয়ালের অন্ধকার ঘরে। সে কখনও আর মুক্তির আশা করেনি। তবুও আজ সে মুক্ত।
মানুষ যখন হতাশ হয়ে আর কিছুই চায় না তখন কখনও কখনও বিনা চেষ্টায় অনেক বড় কিছু পেয়ে যায়। সোহেলীরও তাই। আজ তার আনন্দের দিন। তারপরও অতীত দিনের বেদনার একটা ছুরি তার হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। তার যন্ত্রণা অসীম। তা কেউ দেখতে পায় না। শুধু নিরবে সহ্য করতে হয়। নিজের যত যন্ত্রনাই থাকুক না কেন সেলিমকে সে কখনই কোন কষ্ট পেতে দেবে না। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও সে সেলিমকে খুশি করার চেষ্টা করবে। এইসব ভাবনার মধ্যে সেলিমের কথায় তার ভাবনায় ছেদ পড়ল।
সেলিম ওসি সাহেবকে বলল ‘আপনারা একটু বসেন। আমি দোকান থেকে কিছু মিষ্টি নিয়ে আসি। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
ওসি বলল আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি দোকানে বলে এসেছি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই একজন মিষ্টি নিয়ে হাজির হলো। সবার মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে ওসি সাহেব বলল রাত বেড়ে যাচ্ছে সবাইকে উঠতে হবে। এখানে আর থাকা যাবে না। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি উঠলাম। সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল আপনারা সুখি হউন।
ওসি সাহেব বের হবার পরপর সেলিম ও সোহেলী বাইরে বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। মফিজের দিকে একসাথে দু’জনই চাইলো কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারল না। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। খানিকটা আসতেই মফিজের ডাকে সোহেলী পিছনে মুখ ফিরালো। দেখল মফিজ কিছু বলার জন্য দু্রত তাদের দিকে আসছে। কাছাকাছি হতেই মফিজ সোহেলীকে বলল, ‘জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছি। অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছি। সেসব করেছি শুধু বেঁচে থাকার জন্য। বেঁচে থাকার মত সামান্য একটা কাজের জন্য মানুষের দারে দারে ঘুরেছি। কোথাও আশ্রায় মেলেনি।
সেলিমের দেওয়া সব টাকা সোহেলীর দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘টাকাগুলো রাখ তোর সংসারে খরচ করিস। জীবনের পাতায় পাতায় শুধু পাপ লেখা। অন্ততঃ একটা পূণ্য লেখা থাক। তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমাকে মাফ করে দিস, দোয়া করি তোরা সুখি হ।’ কথাগুলো শেষ করে সে কারোর দিকে না তাকিয়ে উল্টো পথে সোজা চলে গেল।
যে মফিজ টাকার জন্য সোহেলীকে রেখেছিল অন্ধকার জগতে সে আজ সোহেলীর সুখের জন্য টাকা দিয়ে আর্শীবাদ করে গেল। হায়রে মানুষের মন ! কখন কিভাবে যে বদলে যায় তা কেউ জানে না।
পরের দিন। সেলিমের বাড়িতে।
সোহেলীকে এখানে কেউ চেনে না। এখনে সে নতুন পরিবেশে নতুন মানুষ। তার নতুন বাঁধন, নতুন হাসি। সেলিমের বাড়ি আজ মুখরিত। নতুন বউ দেখে সবাই খুশি। সবাই বলছে সেলিমের বউ খুব ভালো হয়েছে। তাই দেখে সেলিমের মায়ের যেন আর খুশি ধরে না। এই রকমই সে চেয়েছিল।
হাসি আর আনন্দের তলায় চাপা পড়ে গেল সোহেলীর জীবনের অন্ধকার অধ্যায়। শুরু হলো নতুন জীবন। এই জীবনকে সে এক সময় স্বপ্নে কামনা করতো। সেই জীবন আসলো। কিন্তু মাঝখানে চাঁদের কলঙ্কের মতো দাগ রেখে গেল। যখন সে আর কিছুই চায়নি। কোন কিছুর আশা করেনি। সেই সময় স্বপ্ন সত্য হলো। এরকমই হয়। যখন মানুষ কোনকিছু আপ্রাণ চেষ্টা করে পায়না হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দেয়। ভুলে যায় তার কথা। জীবনের কোন এক সময় তা এসে ধরা দেয় বিনা চেষ্টায়। কি বিচিত্র জগতের খেলা।
যার জন্য সোহেলী নতুন জীবন ফিরে পেল সে হলো তার স্বামী সেলিম। সোহেলী তাকে খুশি করার জন্য সারাক্ষণ ব্যাস্ত থাকে। তাকে খুশি দেখলে যেন জগতের সব সুখ সে খুঁজে পায়। সেলিম তার নিয়মিত দরকারি জিনিসগলো সব সময় না চাইতেই হাতের কাছে পায়। সেলিমের কাছে মনে হয় তার জন্য সোহেলী সব রেডি করে নিয়ে বসে থাকে। চাওয়ামাত্র সে হাজির করে। সেই সাথে সোহেলীর উচ্ছ্বাস। এসব দেখে দেখে ধীরে ধীরে ভালোবাসা আর প্রশান্তিতে কানায় কানায় পূর্ণ হলো তার শুণ্য হৃদয়। শেষ পযর্ন্ত সে তার ভালাবাসায় মুগ্ধ হয়ে গেল।
দিন পেরিয়ে মাস আসল। মাস পেরিয়ে বছর গেল। ক্রমে ক্রমে কালের চাকা ঘুরে ঘুরে দু’বছর পেরিয়ে গেল। দিন দিন যেন তাদের ভালোবাসা আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো। দেহের সৌন্দর্য নয়, ভালোবাসা নির্ভর করে পরস্পরকে বুঝার উপর। পরস্পরকে বুঝার গভীরতা যত ভালোবাসার গভীরতাও তত।
তারা একে অপরের মাঝে যেন হারিয়ে গিয়েছে। দুটি দেহে এক মন। এরই মধ্যে অতীতের হতাশার স্মৃতি তারা ভুলে গেছে। তাদের মন এখন ভাসছে সুখের সাগরের শীতল বাতাসে। ছোট্ট একটি সংসার যেন সবকিছুতেই কানায় কানায় পূর্ণ। তাদের চাহিদা তেমন বড় নয় তাই অভাবও নেই। সুখি পরিবার।
সুখ চিরকাল চঞ্চল। স্থির হয়ে বেশিদিন কোথাও থাকতে পারে না। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে শুধু ছুটে বেড়ায়। আর যাওয়ার সময় একটা ঝড় বয়ে চলে যায়। সেই ঝড়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়। তখন দুঃখ আর হতাশা এসে বাসা বাঁধে।
সোহেলী বেশকিছুদিন যাবত শরীর ভালো যাচ্ছে না। কি যে হলো দিন দিন যেন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় কিছুই হচ্ছে না। শেষমেষ ডাক্তার বলল, একবার ঢাকায় গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখে সমস্ত বডি চেক আপ করাতে। সেলিম এখন সোহেলীর জন্য সব করতে পারে। সেলিমের ভুবন জুড়ে শুধুই সোহেলী। সে এখন প্রেমিক।
যে সোহেলী বিনোদনের পসরা খুলে সন্ধ্যায় বসে থাকত, টাকা দিলেই মিলত তাকে। তার জন্য এত টান ! তার জন্য এত ভালোবাসা ! সেই সোহেলী সেলিমের কাছে এখন সম্পত্তি নয় মূল্যবান সম্পদ। বিচিত্র মানুষের মন। মনের চোখ দিয়ে যখন কাউকে দেখে তার মত পৃথিবীতে আর কেউ হয় না।
সেলিম দু’একদিনের মধ্যে টাকার ব্যবস্থা করে সোহেলীকে নিয়ে ঢাকায় ডাক্তারের কাছে আসল। ডাক্তার রাজ্যের যত রকমের টেস্ট আছে প্রায় সবগুলো করতে লেখে দিল এবং বলল টেস্টগুলো করানোর পর টেস্টের রির্পোট জমা দেবেন।
ডাক্তারের রুমে ঢোকামাত্র কি কি টেস্ট করাতে হবে প্রায় সবগুলোই লোখা হয়ে যায়। যে দু’য়েকটা বাকি থাকে তা রোগীর সাথে অর্ধেক কথা বলে ডাক্তার লেখে। যেন তারা সব জানে এত কিছুর শোনার প্রয়োজন নেই।
এত টেস্ট দেখে সোহেলী ভড়কে গেল। সেলিমকে জিজ্ঞাসা করল তার কি কঠিন কিছু হয়েছে। সেলিম উত্তরে বলল, ঢাকার সব বড় বড় ডাক্তারতো তাই বেশি বেশি টেস্ট।
-কিজানি আমার কিরকম লাগছে। মনে হচ্ছে আমার বড় ধরনের কিছু হয়েছে।
-তোমার যতসব ফালতু ধারনা।
তখনও সেলিম জানে না তার জন্য ভয়ংকর দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। সব টেস্টের রির্পোট জমা দেওয়ার পর দেখে ডাক্তার বলল, আগামীকাল আসবেন। এবং রক্তের আরো কয়েকটি টেস্ট করাতে হবে। টেস্টের কথা শুনে সেলিমের ডাক্তারের উপর প্রচন্ড রাগ হলেও মুখে কিছুই বলল না। ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে সেলিম রাগের সাথে বলল, যতসব টাকা নেওয়ার ধান্দা।
বিপদের গন্ধ পেলে মেয়েদের সিক্স সেন্সথ প্রবলভাবে কাজ করে। ‘আমার কিন্তু কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে বড় কিছু হয়েছে। সোহেলী আবারও বলল। সেলিমকে এবার কিছুটা চিন্তিত দেখা গেল।
পরের দিন রির্পোট জমা দিয়ে দুরু দুরু বুকে ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বেঞ্চে বসে ডাকের অপেক্ষা করছে। ডাক পড়ল। দুজন ভিতরে বসলে ডাক্তার তাদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। যেন কত দিনের চেনা। ডাক্তার সম্পর্কে তাদের আর কোন ক্ষোভ রইল না। এক পর্যায়ে ডাক্তার সোহেলীকে বলল আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন। আমি উনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। সোহেলীর বুকটা ধক্ করে উঠল। ডাক্তার কি তার অতীতের কথা জানতে চাইবে ? নাকি তার কঠিন কিছু হয়েছে তার সামনে ডাক্তার বলবে না। মনে একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে সোহেলী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো।
ডাক্তার বলল কিছু কিছু কথা আছে সহ্য করা কঠিন। তবুও শুনতে হয় এবং আমাদের বলতে হয়। আপনার স্ত্রীর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। হয়তো আগামী ছয় মাসের মধ্যে তাকে হারাতে হতে পারে। এর কোন কার্যকর চিকিৎসা নেই। তবে বারবার ব্লাড চেইন্জ করে দেখতে পারেন।
ডাক্তারের মুখ থেকে ব্লাড ক্যান্সার শব্দটা শুনার সাথে সাথে সেলিমের কানের কাছে যেন একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটল। আর কিছুই সে শুনতে পেল না। চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখল। তারপর আস্তে আস্তে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসল। তখন বুঝল জলে চোখ ভর্তি হয়ে গেছে তাই সে কিছু দেখতে পারছে না। আর বারবার কানের কাছে একই কথার যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় নিল। কিছু পরামর্শ নিয়ে বেরিয়ে আসলো। নিজেকে সোহেলীর কাছে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো এবং সোহেলীর ব্লাড ক্যান্সারের কথা গোপন রাখল।
– তোমাকে কি বলল ডাক্তার ? সোহেলীর জিজ্ঞাসা।
-তেমন কিছু নয়। ডাক্তারের ভিজিটের ব্যাপারে কিছু কথা বললেন। জীবনের প্রয়োজনে সময় অসময়ে মিথ্যা কথা না বললেই নয়। সেলিম মিথ্যা বলল।
তিনমাস কেটে গেল। ডাক্তারের কাছ থেকে আসার পর সেলিম যখন একা থাকে তখন অন্যমনস্ক থাকে। সোহেলী সেটা লক্ষ্য করছে। তার সিক্সথ সেন্স বলছে তার বড় কিছু একটা হয়েছে। সেলিম সেটা এড়িয়ে যাচ্ছে। একদিন সে সেলিমের সাথে জোরাজুরি শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সেলিম বলতে বাধ্য হলো। শুনামাত্র সোহেলীর মনে হলো পৃথিবী যেন কেঁপে উঠলো। চোখের তারায় যে রঙ ছিল একটিমাত্র সংবাদে সব মুছে গেল। সে আর কিছুই দেখল না। চোখে অস্পষ্টভাবে ভেসে উঠলো সেলিমের মলিন মুখের ছবি।
আর মাত্র কদিন পর এই মুখ আর সে দেখবে না। সকালে চোখ মেলে যখন এই মুখ দেখত তখন প্রাণে এক আবেশী শিহরণ জাগিয়ে দিত। সারাদিন হেসে খেলে কখন কিভাবে সময় চলে গিয়ে আবার সকাল আসত। ছোট্ট এই ঘরে ঠাসা ছিল মুঠো মুঠো স্বপ্ন।| সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল। নিজের চেয়ে সেলিমের ভাবনা তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। সেলিমের শুন্য বুক সে এক ফোঁটাও খালি থাকতে দেয়নি। সে যখন থাকবে না তখন সেই শুন্যতা নিয়ে কি করবে সেলিম ?
চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল। বাম হাতে চোখ মুছতে মুছতে সেলিমকে বলল আমি মারা গেলে তুমি আবার বিয়ে করো। দেখো, হয়তো সেও তোমাকে আমার মত করে দেখবে। তার মধ্যে আমি তোমার কাছে বেঁচে থাকব।
সেলিমের কানের মধ্যে যেন কিছুই ঢুকছে না। সোহেলী থাকবে না একথা মনে হলেই সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কি যেন ভাবে। একেবারে ভাবনার তলদেশে হারিয়ে যায়। সোহেলী তা দেখে সমস্ত কষ্টকে চেপে রেখে বলল, ‘অনেক দিনতো কোথাও বেড়াতে যাইনি, চল আমরা সমুদ্রসৈকত দেখি আসি। কোনদিন দেখিনি। হয়তো আর তোমার সাথে বেড়ানোর সময় নাও পেতে পারি।
সেলিম সোহেলীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘খুব একটা ভালো কথা মনে করেছ। সমুদ্র দেখার আমারও সখ ছিল। কিন্তু দেখতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।’
দু’দিন পর।
নীল সমুদ্র কি বিশাল জলরাশি! দুজনে সমুদ্রের কিনার ধরে হাঁটছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে তাদের পা ধুয়ে আবার চলে যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে এসে দুজনই যেন কিশোর কিশোরী হয়ে গেল। তাদের উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। সোহেলী আচমকা একগাদা পানি সেলিমের গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে সেলিমের মুখের দিকে চেয়ে রইল। সেলিম তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে সেলিমের নাগালের বাইরে আরো বিপরীত দিকে ছুটে গেল।
সেলিম সোহেলীকে ধরার জন্য তাড়া করল সেই সাথে একটা মিষ্টি হাসির কলরব তাকে মোহবিষ্ট করে দিল। একটু যেতেই সে সোহেলীকে ধরে ফেলার উপক্রম করতেই সোহেলী জলের মধ্যে নেমে গেল। সেলিমও নামতে কোন দ্বিধা করল না। কোমর পানি হতেই তাকে ধরে ফেলল। সোহেলী হাঁপাচ্ছে কিন্তু তার হাসি থামছে না। দুজন পানি নিয়ে খেলা শুরু করে দিল।
সমুদ্রের একটা নিজেস্ব ভাষা আছে। সে ভাষাতে মানুষকে কাছে ডাকে। সে ডাক কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। মনের অজান্তেই জলে নেমে পড়ে। যে একবার তার বুকে পা রাখে সে অনেক দুরে গেলেও সেই সমুদ্রের ডাক সে শুনতে পায়। আবার যেতে ইচ্ছা করে।
এক সময় দু’জনই থামল। সোহেলী দুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন উদাস হয়ে গেল বলল, ‘দেখ কি সুন্দর পৃথিবীর রূপ ! অথচ কয়দিন পরে আমি আর থাকব না। চিরদিনের মত তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে।
কথা শুনে সেলিমের বুক হু হু করে উঠল। মনটা ভারী হয়ে গেল। সেলিম বলল’ চলো উঠি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।
সোহেলী বলল আর একটু থাকি না। এখানে বেশ ভালই লাগছে।
সেলিম আর বাধা দিল না। নিরবে সোহেলীর উচ্ছ্বাসে ভরা ছেলেমানুষি দেখতে লাগল। যেন তার চোখের ক্যামেরা দিয়ে সব দৃশ্য একে একে ধারণ করে হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছে একটা একটা করে। আর কোনদিন হারাতে দেবে না।
সমুদ্র দেখে ফিরে আসার কয়েক দিন পর সোহেলী অসুস্থ হয়ে পড়ল। সোহেলীর উচ্ছল সমুদ্র ভ্রমনটা ছিল প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠার মতো। সেলিম জানে তার চেষ্টায় আর কোন লাভ হবে না। তবুও ডাক্তারের কাছে নিয়ে প্রাণপনে চেষ্টা করল কিন্তু সোহেলী সেলিমের বুক খালি করে দিয়ে তাকে রেখে চিরদিনের মতো চলে গেল চির অচেনার দেশে।
সেলিমের জীবন সোহেলী কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছিল। সে যাবার সময় সব নিয়ে গেল। খালি করে দিয়ে গেছে সব। অসীম শুন্যতা সেলিমের বুকে। সোহেলী ছাড়া শুন্য এ ঘরে সে একা। ঘরের প্রতিটি জিনিসে ছিল সোহেলীর স্পর্শ। যেদিকে তাকায় সেদিকেই সে দেখে সোহেলীর ছবি। আনমনা হয়ে বসে থাকে। ভুলে নাম ধরে ডেকে ওঠে। আবার বাস্তবে ফিরে দেখে কিছু নাই। না পাওয়ার তীক্ষ্ণ বেদনার একটা ছুরি এসে তার বুকে বিঁধে। ছটফট করে অসহ্য যন্ত্রণায়।
রাতের আঁধার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে সে ব্যথা। কাটতে চায় না রাত। হায়রে মানুষের মন ! এক সময়ের অন্ধকার জগতের এক মেয়ের জন্য তার এই ব্যথা, এতো ভালোবাসা ! সে নেই তাই সেলিমের পৃথিবীতে কিছু নেই ! সব ফাঁকা ! গভীর রাত। যতই সোহেলীকে মনে পড়ছে ততই তার কাছে অসহ্য লাগছে এই পৃথিবী। একটার পর একটা স্লিপিং পিল খেয়ে তার ঘুম আসছে না। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটার পর একটা জীবনের ব্যর্থতার পাতা তার সামনে খুলে যাচ্ছে। আনন্দ দিয়ে ভরিয়েছিল সোহেলী তার জীবন। এখন সে নাই। আবার বুকে বেজে উঠল হাহাকার। ঘুমাতে চেষ্টা করল। সে আর পারছে না। শেষে তিরিশ-চলিশটা স্লিপিং পিল একটা গ্লাসের মধ্যে গুলে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল।
পরের দিন দুপর হয়ে গেলে এক প্রতিবেশী সেলিমের সাড়াশব্দ না পেয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখে দরজা খোলা। ভিতরে ফ্যান চলছে। সেলিম চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেল না তখন চাদর সরিয়ে গায়ে ধাক্কা দিতেই চমকে উঠল। কোন চেতনা নেই। মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আতঙ্কে ছুটে গিয়ে লোক ডাকাডাকি করে সবাই মিলে অতি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল। সবাইকে নিরাশ করল ডাক্তার। বলল আমাদের কিছু করার সুযোগ সে দিল না। আমরা দুঃখিত। আপনারা লাশটা নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করুন।