Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

অনেক কথা১২

: | : ৩০/০৯/২০১৩

চিঠিপত্র

* স্বর্ণা,
তুমি আর ছেলেমেয়ে কেমন আছ? মা কেমন আছে? মায়ের ওষুধাদি ঠিকমতো আনা হচ্ছে ত? নাকি টাকার অভাবে তোমরা খুব কষ্টে আছ? তাই যদি হয় তবে লালুকে বিক্রি করে দিয়ো। মাকে বলো আমি ভাল আছি, তোমরা আমার জন্যে চিন্তা করো না। আল্লাহ্ যার মদতগার তার ক্ষতি করতে পারে না কেউ, এ বিশ্বাস খোদার উপর রাখতে পার। তবে আমাদের অবস্থা এখন ডাঙায় বাঘ জলে কুমিরের মতো। সেদিন আমার চোখের সামনে আমাদের তিন সাথিকে কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে! তা সাধারণজনে দেখার ক্ষমতা নেই। দেখলে নিঃসন্দেহে বলতে পারি, পাগল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। লোমহর্ষ সেই ঘটনা চিঠিতে প্রকাশ করা যাবে না। তুমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পার। একটুর জন্যে আমি বেঁচে গিয়েছিলাম! দলদলার কচুরিপানায় আমাকে লুকিয়ে রেখেছিল! নিশ্চয় মায়ের দোয়া এবং তোমাদের বরাতের জোর। হায়েনারা তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল আমায়। যদি খুঁজে পেত, তা হলে আমার পরিণতির কথা একমাত্র আল্লাহতালা ছাড়া কেউ বলতে পারল না। যেই জোঁককে আমি যমের মতো ভয় করতাম সেই ভয়ঙ্করেরা সেদিন আমার আপাদমস্তকের এমন কোনো স্থান বাকি রাখে নি যেখানে আক্রমণ করে নি–শোষণ করে নি! ভয়ের কথা কী বলব, যমদূতের কথাও মনে ছিল না তখন। দোয়া করো, বেঁচে থাকলে অনেক কথার ঝুড়ি নিয়ে হাজির হব তোমার সামনে। এমুহূর্তে তোমাদের কথা খুব মনে পড়ছে। বড়বেশি কষ্টে আছি প্রিয়। রাতে ঘুম আসে না সাপের ভয়, মশার কামড় ত আছেই। চোরের মতো পথ চলছি অবিরত, এটাই সবচেয়ে বড় কষ্ট। দেশ যে কবে স্বাধীন হবে আল্লাহ্ই জানে। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক সহযোদ্ধা মারা গেছে! আমাদের দলে এখন আমরা কয়জনমাত্র বেঁচে আছি। কে জানে, কে কখন মারা পড়ি। তবে আমরা বিশ্বাসে অটল, আমাদের জয় হবে একদিন। কারণ আমরা জানি, ঈশ্বর সব সময় কমজোরের সহায়ক এবং সত্যের উদ্ধারক। হয়তো অত দিন আমরা নাও থাকতে পারি–নাও দেখতে পারি সেই সুবর্ণদিন। তোমাদের খাস দোয়াই আমাদের ভরসা…

জান কি স্বর্ণা, আসার সময় তোমার আর শ্বেতার যেই ছবিটা নিয়ে এসেছিলেম সেটাই আজ আমার দুঃখদিনের বড় সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য একটা ফটোগ্রাফ যে এত বড় সান্ত্বনার প্রতীক হয় তা আগে কখনো অনুভব করতে পারি নি। যুদ্ধের ময়দানে না এলে বোধহয় এ নিগূঢ় তথ্যটা গোপনই রয়ে যেত। বারবার চুমু খেতে খেতে ছবিটা আজ অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে! মার এবং পাবলুর একটা ছবি থাকলে মনে বোধহয় আরেকটু সান্ত্বনা খুঁজে পেতাম। মাঝেমধ্যে অন্তত ওদেরকেও দেখতে পেতাম। কেন জানি ভুল হল জানি না। তোমাদেরকে দেখলে তাদের কথা খুববেশি মনে পড়ে। তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। একি! তুমি কাঁদছ? কেঁদো না লক্ষ্মীটি। দেশ এবং ধর্মের জন্যে যারা প্রাণ উৎসর্গ করে তাদের একটা বিরাট প্রাপ্তি বিধাতার কাছে থাকে। অতএব, আমি কী পেয়েছি সেটা বড় কথা নয়, আমি কী দিতে পেরেছি সেটাই বড় কথা। হয়তো আর ফিরে নাও আসতে পারি। হয়তো এটাই আমার শেষচিঠি। হয়তো এমন জিন্দেগি তুমি কামনা কর নি কখন। কিন্তু প্রিয়, একটা প্রবাদ আছে–সবুরে মেওয়া ফলে। যদি মেওয়ার আশা কর, তা হলে তোমাকে স্বার্থ ত্যাগ দিতে হবে এবং ধৈর্য ধরতে হবে–চরম ধৈর্য। আর এটাই সবচেয়ে বড় মহত্ত্বের পরিচয়। সবার নসিবে কিন্তু ভাল কর্ম লেখা থাকে না–লিখে নিতে হয়। তাই তোমাকে খুব ধৈর্যশীল হওয়ার হুকুম নয় অনুরোধ করছি। আমার অবর্তমানে সংসারের হাল তোমাকে একাই বহন করতে হবে। তুমি যদি নড়বড় হও, তা হলে গ্লানিসমুদ্র সাঁতারিয়ে আমি কূল পাব না। মানুষ পৃথিবীতে এসেছে সুনাম অর্জনের জন্যে, যে সুনাম অর্জন করতে পারে নি সে মানুষ হতে পারে নি। এ কথাটা স্মরণ রেখে পথ চলো, আশা করি কখনো হুঁচোট খাবে না। আমি ও আমার হৃদয় সব সময় তোমার সঙ্গে আছে–থাকবেই।

* আশা,
জানি তুমি সার্থক। তোমার নগরে আজ চাঁদের হাট। তাই বলে আমাকে নিন্দুক ভাব! তুমি কি মনে কর? আমি খুব সংক্ষিপ্ত–কথা বলি কম, বাড়াবাড়ি করি কম, পথ চলি সোজা, কাজ করি সহজ আমার সবকিছু সংক্ষেপে। তাই ত অতীত ভুলে গেছি সহজে? তা হলে তুমি বোকা। মনে ছিল, জীবনে আর লিখব না তোমায়। তোমাকে লিখাও শোভনীয় নয়। তা হলে চিঠির কী প্রয়োজন? মনে যদি করো, শুরুর কোনো শেষ নেই তবে বলব, তুমি ভুল। আজ থেকে দুজনাতে শতাব্দীর ব্যবধান। মন বলল তোমার অবজ্ঞার জবাব চাই। কিন্তু বিবেক বলল, কাকে আঘাত করে যদি কেউ শান্তি পায় তবে তার চেয়ে সুখী মানব পৃথিবীতে আরেকটা নাই। তাই নিজেকে খুব ধন্য মনে করি আজ। জানি, আমার কোনো প্রেরণা তোমাকে আর উৎসাহিত করবে না–নাইবা করল তবু একবার জিজ্ঞেস করব, কেমন আছ? উত্তর পাব না জানি–এটাই স্বাভাবিক। কারণ মানুষ যখন বিপদে পতিত হয় তখন উদ্ধারকারীর মধ্যে ঈশ্বরের রূপ দেখে আর উদ্ধার হলে উদ্ধারক কে–ঈশ্বরকেও ভুলে যায়। এখানে আমার আফসোস, আমি তোমার উদ্ধারক হতে পারলাম না! এমন দুঃখের অতীতকে মুছে দেওয়া শ্রেয়। তাই…জান কি প্রিয়, পাওয়ার আনন্দে যদি চোখে আসে জল, না পাওয়ার বেদনাই ভাল তাতে বয় যে অনল।

যাই হোক, তোমার সুখের বাসর তোমাকে মুবারক। আমার দরদ, আমার কষ্টভার একান্ত আমার হয়ে আছে–থাকুক। আমি কাকে দুঃখ দিতে আসি নি ধরায়। পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ আমার জন্যে আছে–থাকবে, তার থেকে মুক্তি আশা করি না। বিধাতার কাছে এপ্রার্থনা করি, যেই দারিদ্র্য আমাদের প্রেমের দেয়াল, সেই দারিদ্র্য যেন আমাকে দেয় মুহাম্মদের সম্মান। আমি আর কিছু চাই না–চাই ত সামান্য গরিবির লাঘব। গরিবদের স্বার্থে কিছু করতে পারি ত ধন্য। কারণ গরিবিতে আমার জন্ম হয়েছে, গরিবিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমি যদি অঢেল ধনসম্পদের মালিক হতে পারতাম, তা হলে গরিবদের স্বার্থে একটা তহবিল করে যেতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার আমি ত নিজের জন্যেও কিছু করে যেতে পারলাম না।

চলবে…

এ অর্থহীন চিঠিদুটো ‘একাত্তরের চিঠি’ নামে প্রথম-আলো-ব্লগের চিঠিপ্রতিযোগিতায় জন্যে লেখা…..অনেক কথার একাংশ…..

 

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top