উটন দাদুর কাহিনী–৩(শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
এক সপ্তাহ পরে হসপিটালের লোকরা সেই কালো কুচকুচে বাচ্চাটিকে বিটেন সাহেবের বাংলোতে দিয়ে গেল। খুব কান্নাকাটি করছিল ছেলেটি। ওর বাপ,মা,ঘর-গ্রামের কথা সে কিছুই বলতে পারছে না। বিটেন ও তাঁর স্ত্রী ছেলেটিকে নিয়ে ভাবনায় পড়লেন। আদিবাসী দারোয়ান রক্ষীরাও ওর ভাষার বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারছিল না। এখন কি করা যায়–এমন ছোট,অবুঝ ছেলেকে নিয়ে বিটেন মুস্কিলে পড়ে গেলেন। শেষে ঠিক হল যতদিন না ওর ঘর বাড়ির হদিস পাওয়া যাচ্ছে ততদিন ও রক্ষীদের কাছেই থাকবে। সে জন্যে বাচ্চাটির ভরণ পোষণ ব্যাপারে আলাদা টাকা বরাদ্দ করে দিলেন বিটেন।
রক্ষীদের পরিবারের সঙ্গে বাচ্চাছেলেটি থাকতে লাগলো। ওদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলাধুলা, ঘোরাফেরা করতে করতে আজকাল বাচ্চাটা ওদের ইশারা আর হু,হ্যাঁ এমনি ধরনের টুকটাক কথাগুলি কিছুটা রপ্ত করে নিয়েছে।
এমনি ভাবে একটি বছর কেটে গেল–কালো ছেলেটির বয়স আট,ন বছর হবে তখন। ওর চেহারার কুৎসিত ভাবটা অনেক কমে গেছে। পিচ কালো রংটা যাবার নয়–তবে কালোর মাঝে তেল চকচক একটা ভাব এসেছে ওর শরীরে।
বিটেন সাহেব নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ওই ছেলেটিকে দেখেছেন বটে কিন্তু এত কালো, কুৎসিত ছেলেকে তাঁদের মত লোকদের ভাল লাগার কথা নয়। তবু ওই কালো ছেলেটি বারবার তার মনের কোনে,তার চোখের সামনে মাঝে মাঝেই ভেসে আসে। আহা,বাচ্চা ছেলে—মা হারা। হোক না কালো–এখন ওকে দেখলে আর কুৎসিত মনে হয় না। বিটেন সাহেবের স্ত্রীর মনে ক্রমশ যেন মাতৃত্বের ভাব জেগে উঠতে থাকলো। একদিন তিনি বিটেনকে মনের কথা বলেই ফেললেন,আচ্ছা আমরা ওই ছেলেটিকে রাখতে পারি না?
সাহেবের আপত্তি ছিল। ওমন ব্ল্যাক পার্সনকে তিনি দয়া করতে পারেন কিন্তু ঘরে রাখতে পারেন না।
সাহেবের স্ত্রী শেষে বললেন,লাইক আওয়ার সার্ভেন্ট,আমরা ওকে রাখতে পারি না কি?
অগত্যা তাই হল। সেই কালো ছেলেটি বিটেনের ঘরে জাগা পেল। সার্ভেন্টের মত থাকলেও বিটেনের স্ত্রী তাকে স্নেহ করতেন। বিটেন সাহেবও ওকে লাইক করতে লাগলেন।
এদিকে দেখতে দেখতে আরও কটা বছর কেটে গেল। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। এবার সাহেবদের ঘরে ফিরে যাবার দিন এসে গেল। ঘর মানে ইংল্যান্ডর সলিহলে তাঁদের পৈত্রিক বাড়ি। সেখানেই তাঁদের যাবার কথা,কিন্তু সমস্যা হল ছেলেটিকে নিয়ে–ছেলেটি এখন পনের বছর বয়সের হয়ে গেছে। ঘর বাইরের সমস্ত কাজে সে পারদর্শী,বড় অবিডিয়েন্ট। উটন–উটন ওর নাম,মেমসাহেব আদর করে নাম দিয়ে ছিলেন। তাঁদের দেশী ঢঙ্গের নাম !
সে আদিবাসী ছেলেটির চালচলন এখন একেবারে পাল্টে গেছে।চেহারা যাই থাক নয়া কেন–উটন না হয়েছে ভারতীয়,না ইংরেজ ধরনের।মাঝা মাঝি এক ধরনের চালচলন,শিক্ষাদীক্ষা তার মধ্যে এসে গেছে। সব কাজেই ও খুব তৎপর। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি জানে আর বিটেন সাহেব ও তাঁর স্ত্রীকে খুব শ্রদ্ধা করে। সাহেবের স্ত্রী তাকে একেবারে সন্তানের জাগা না দিলেও তারই কাছাকাছি ছিল সে স্থান।এক জাগায় এসে নারী জাতি মা হয়ে যান–সেখানে জাত-ধর্ম, দেশ-বিদেশ বলে কোন বাধাই থাকে না। স্নেহ,ভালবাসার ফল্গুধারা তাঁদের গভীরতম জাগা থেকে ছেপে ওঠে–আর শিশুরাও সে স্পর্শ নিজের প্রবণতায় বুঝে নিতে পারে–নারীর সেই মা সুলভ ভাব-ভাষা পড়ে নিতে শিশুদের খুব বেশী দেরী লাগে না।উটন ও মেম সাহেবের মাঝেও অনেকটা তেমনি সম্বন্ধ জুড়ে গিয়ে ছি। মেম উটনকে ছেড়ে যেতে চান নি।
তবু চলে যেতে হয়। যাবার সময় মেম তো কেঁদে ভাসিয়ে ছিলেন।বিটেনও মনের কোথাও কেটে যাওয়া সুরের মত দুঃখ অনুভব করছিলেন।একবার তাঁর মনে হয়েছিল উটনকে নিয়ে গেলে কেমন হয়? তার পরক্ষণেই অনেক কিছু ভেবে তিনি ক্ষান্ত হয়েছেন।সংসারে বাবার ক্ষেত্র পরিধি মার অপেক্ষা অনেক বিশাল–তাঁর সমস্ত ভাবনা পরিসর বৃহৎ–বেশির ভাগটা ঘরের বাইরের হলেও ভূত ভবিষ্যৎ মিলিয়ে বিশাল তার বিস্তার ক্ষেত্র।তাই তাঁকে ভাবতে হয়,মনের কথা আড়ালে রেখে হলেও কিছু কিছু যন্ত্রণা বুকে ঢেকে রেখে চলতে হয়।
শেষে উটনকে ভারতে ছেড়েই ওঁরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ছিলেন। যাবার আগে বিটেন বস্তারে উটনকে অনেকটা জমি জাগা কিনে দিলেন,সে সঙ্গে একটা ঘরও তৈরি করিয়ে দিলেন।
উটন এবার একা হয়ে গেল–তার কেউ নেই–না মা,না বাবা,না ভাই,বোন–কেউ নেই–ও সম্পূর্ণ একা! উটনের খুব রাগ হয়েছিল। যাঁদের সে এত শ্রদ্ধা করত–এত ভালবাসত—সেই তাঁরা কি না তাকে ছেড়ে চলে গেল! মা,বাবার ভালবাসা কেমন জানে না সে তবে এমনি এক ধরনের ভালবাসায় সে মেমসাহেব,মমকে ভাল বেসেছিল। তবু ওঁরা তাকে একা ফেলে চলে গেল! ভীষণ রাগ হচ্ছিল উটনের।
কোন মত দিন কাটছিল উটনের।টাকা পয়সার অভাব ছিল না। এক জনের পেট চলে যাচ্ছিল স্বছন্দে।কিন্তু রাগ আর অভিমান তাকে বারবার অশান্ত করে তুলচ্ছিল।তাই এক দিন সে ঘর, জমি- জাগা সামান্য পয়সায় বেছে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
ক্রমশ…