উপন্যাস “প্রচ্ছায়া” (৭ম পর্ব)
অতীত জীবনের অনেকটা সময় একাকী কাটালেও টিচার নলিতা দাসের মৃত্ত্যুর পর কেন যেন মিজান নিজেকে ফের একা ভাবতে শুরু করেছে। অস্থিরতা বাসা বেধেছে মনের ঘরে, অস্বস্তিতে ছেঁয়ে গেছে চারপাশ, উঁশখোঁশ উঁশখোঁশ করে মন, সময় কাটতে চাচ্ছে না কিছুতেই, মন বসছে না কোনো কাজে।
সারাদিন রুমে বসে টেলিভিশন দেখা, যখন টেলিভিশন ভালো লাগে না, তখন বেহালায় তাল বিহীন পেঁ পুঁ। আজকাল বেহেলা বাজানো মিজান প্রায় ভুলেই গেছে। যখন বেহালার তারে মন বেধে রাখা যায় না, তখন একাকী এলোমেলো নাচানাচি করা, ধা’ ধিন্’ ধিন্ । আর যখন এসবের কিছুই ভালো লাগে না, তখন ঘুমের টেবলেট খেয়ে লম্বা ঘুম দেয়।
বাড়ির দাড়োয়ানকে ব্যতি রেখে মালি বাবুর্চীসহ বাকী অন্য সব কাজের লোককে সন্ধ্যার আগেই যার যার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। মনিবের নির্দেশ অনুযায়ী চাকর বাকরেরা খুশি মনে সন্ধ্যার আগেই যার যার বাড়িতে চলে যায় এবং পরের দিন যথারীতি স্ব-কাজে যোগ দেয়।
এই কয়দিনে মিজান একেবারেই হাপিয়ে ওঠেছে। অনেক ভেবে চিন্তে মিজান স্থির করেছে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাবে। আবহাওয়া পরিবর্তন হলে হয়ত ভালো লাগবে, সেই ভাবনা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত। যেমন ভাবনা, ঠিক তেমনি কাজ। সবকিছু গুছগাছ করে এক মাসের টোরে বেরিয়ে পড়ল। উড়োজাহাজে করে প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। সেখানে একদিন থাকার পর, সেখান থেকে গেল কক্সবাজার। সারাদিন সমুদ্র সৈকতে ঘুরাফেরা, ইচ্ছে হলে বেহালা বাজায় । আর যখন কিছুই ভালো লাগে না, তখন হোটেলে ফিরে নাক ডেকে ঘুম দেয়, যেন উদ্দেশ্যহীন এক জীবন, যেন এই জীবনে কিছুই কার নেই আর।
দিন কয়েক কক্সবাজারে ঘোরাফেরা করার পর সেখান থেকে টেকনাফ চলে গেল। সারাদিন টেকনাফে সময় কাটানোর পর সোজা সেন্টমার্টিন। যতক্ষণ ভালো লাগা, ততক্ষণ এক জায়গায়। ভালো না লাগলেই স্থান পরিবর্তন। এভাবেই ভাসমান শেওলার মতো বয়ে চলছে জীবন, আজ এখানে, তো কাল অন্যখানে।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ইমরান হাসানের মেয়ে হঠাত করেই নিখোঁজ। ইমরান সাহেবের মেয়ের নাম ফারাহ হাসান রাত্রি। রাত্রি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। রাত্রি কখনো রাত দশটার পর বাইরে থাকে না। এখন রাত পৌনে দুইটা বাজে, রাত্রি এখনো বাসায় ফিরে নি ! রাত্রিকালে হঠাত করেই রাত্রির গায়েব হয়ে যাওয়া, বিষয়টি ডিআইজি সাহেবকে বেশ ভাবাপন্ন করে তুলেছে। হাসান সাহেবের স্ত্রী জোবায়রা বেগম কান্নাকাটিতে মগ্ন। গত কয়েক মাসে ঢাকা শহরে একাধিক তরুনীর মুখশ্রী বিগড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ হেন কারণে ঢাকা শহরের তরুনীদের মায়েরা এমনিতেই বেশ শঙ্কার মধ্যে বসবাস করছেন। জোবায়ারা বেগমও তার উর্ধ্বে নন। তিনি আবার হার্টের রোগী । সামান্য টেনশনেই তার ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর ছেড়ে বারোটার দিকে দৌড় দেয়। একমাত্র মেয়ে হঠাত নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় সেই কাঁটা ইতোমধ্যেই বারোটার ঘর ছাড়িয়ে যায় যায় করছে। দুইবার সজ্ঞাহীন হয়েছেন। ডাক্তার ডাকা হয়েছে। মাথায় পানি ঢেলে সজ্ঞা ফিরানো হয়েছে। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে তাকে নিদ্রামগ্ন করে রাখা হয়েছে। ডাক্তার সাহেব তার আদেশ জাড়িতে হাসান সাহেবকে বলেছেন, ঘুম থেকে জেগে যদি মেয়েকে দেখতে না পাযরলে জাবায়রা বেগমের অবস্থা আরো অবনতি হতে পারে।
ডিআইজি সাহেব তার ক্ষমতার ষোলয়ানা প্রয়োগ করেছেন। ঢাকা শহরের সবগুলো থানায় ফোন করেছেন। থানা খালি করে হম্বিতম্বি হয়ে সব পুলিশ ও ব়্যাব রাস্তায় নেমে পড়েছে। বাড়ি গাড়ী সর্বত্র তল্লাসী চলছে। রাতের গভীরে ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তুলে রাত্রির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে । যদি কারো কথায় কিঞ্চিত পরিমান সন্দেহের রেশ প্রকাশিত হয়, সঙ্গে সঙ্গেই তার বাড়ি সার্চ করা হচ্ছে । রাস্তার প্রত্যেকটি গাড়ী তল্লাসী করা হচ্ছে, বিশষ করে কার, মাইক্রোবাস, সিএনজি একটিও বাদ যাচ্ছে না। পুলিশ হেডকোয়াটারের কন্ট্রোলরুম থেকে ফোন আসছে একের পর এক। থানার ওসি সাহেব তার অধিনস্থ কর্মকর্তাদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছেন। সবাইকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যে পর্যন্ত রাত্রিকে খোঁজে না পাওয়া যাবে সেই অবধি থানায় ফেরা নিষেধ। সাব-ইন্সপেক্টর নিজে নর্দমার নালায় মাথা ঢুকিয়ে উঁকি মেরে খোঁজে দেখছেন। সবগুলো রেস্তুরা, আবাসিক হোটেল তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে ।
রাত বাড়ার সাথে সাথে ঢাকা শহরের আবাসিক হোটেলের প্রায় প্রত্যেক রুমের লোকসংখ্যা বেড়ে যায়। যারা সিঙ্গেল থাকে তাদের বেশির ভাগই ডাবল হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আকস্মাত পুলিশের তল্লাসী, কারো পরনে কাপড় আছে, আবার কারো নেই ! নগ্নতা ঢাকতে অথবা পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেতে কেউ কেউ আশ্রয় নিচ্ছেন খাঁটের নিচে। সেখান থেকে বের করে চেক করা হচ্ছে পুরুষ, না রমনী। ময়লাক্ত ড্রেন, কালবাট, ব্রীজের নিচে, ডাস্টবিন, লেঁক, ঝিল কিছুই বাদ যাচ্ছে না, ছানবিন চলছে সর্বত্র।
আমাদের দেশে যারা পাবলিক সার্ভিস করেন তাদের ভেতরে ভালো কাজ করতে যতটুকু অনিহা দেখা যায়, তার চেয়ে দ্বিগুন তেগুন আগ্রহ দেখা যায় উপর লেভেলের তোষামোদের ক্ষেত্রে। ডিআইজি সাহেবের মেয়ে বলে কথা, যে উদ্ধার করতে পারবে তার প্রমোশন নিশ্চিত। আর সেই নিশ্চিত প্রমোশনের লোভে তোষামোদের প্রতিযোগীতায় কেউ পিছিয়ে নেই। স্যার, ঝিলের জলে কালো কী যেন দেখা যাচ্ছে, কনস্ট্যাবল এমনটি বলার সঙ্গে সঙ্গে সাব-ইন্সপেক্টর ঝাঁপ দিয়ে ঝিলের পঁচা মানিতে নেমে পড়ছেন। যখন দেখা গেল সেই কালো জিনিসটি কাঠোর টোকরা বা এই জাতীয় কিছু, সাব-ইন্সপেক্টর পানি থেকে ওঠে এসে কনস্ট্যাবলের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন । পুলিশের বারোটা বাজুক আর তেরোটা, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দেশের পুলিশকে এর আগে কখনো এত এক্টিভ হতে দেখা যায় নি। ইন্সপেক্টর সাহেব ভেজা কাপড়ে আগে আগে হেটে চলছেন আর শুকনো কাপড়ে পেছনে পেছনে চলছে সিপাহী। এই রকম দৃশ্য ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় দেখা গেল। তবে রাত বলে বিষয়টি কম মানুষের চোখে পড়ল। ব়্যাব তাদের ডগস্কোয়াড থেকে কুকুর নিয়ে এসেছে। কুকুর যেখানে গিয়ে ঘেঁউ ঘেঁউ করছে সেখানে তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে। ডিআইজি সাহেবের নির্দেশ অনুযায়ী তার মেয়ে নিখোজ হওয়ার বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে ।