Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

উটন দাদুর কাহিনী–৪ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)

: | : ০৫/১০/২০১৩

তারপর পঞ্চাশটা বছর কেটে গেছে–এক ছন্নছাড়ার জীবন কাটিয়ে এ গ্রাম,সে গ্রাম,এ বসতি, সে বসতি ঘুরে–কত কত বনে জঙ্গলে দিন কাটিয়ে এখন যেখানে সে এসেছে সে জাগার নাম তিন্তারি। বস্তারের ঘন জঙ্গলের মাঝে এ গ্রামের অবস্থান। বস্তার শহর এখান থেকে কম হলেও পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে !

আজ এ বৃদ্ধ বয়সেও সে একা। স্ত্রী,পুত্র,পরিবার কিছুই তার নেই। দীর্ঘ সময়ের এক ভবঘুরের জীবন কাটিয়ে সে ঠিক করল,আর না,আর এ বয়সে ঘুরে বেড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন চাই স্থিরতা,এক জাগায় থেকে যতটা সম্ভব পরোপকার করে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া।

তিন্তারি গ্রামে সামান্য জমি যোগার করে সে ছোট্ট একটা ঘর বানাল। জীবনের বাকি সময় এই ঘরই হবে তার এক মাত্র আশ্রয় স্থল।

উটনের  মন থেকে কিন্তু খামখেয়ালি ভাবটা তখনও  যায় নি। ঘরের মধ্যে চুপচাপ সে বসে থাকতে পারত না–এ ছাড়া তার সময় জ্ঞান বরাবরই কম। একটা সময় ছিল যখন বিটেন সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর  সঙ্গে থাকত তখন সময়ানুবর্তিতার জ্ঞান তার স্বভাবের মধ্যে ধীরে ধীরে বর্তাচ্ছিল। কিন্তু সেই যখন সে একেবারে একলাটি হয়ে গেল–তখন থেকেই তার মনের মাঝে বিবাগী ভাব জন্ম নিলো–জীবনের এক ছন্নছাড়া অবস্থা তার সব কিছু যেন তছনছ  করে দিয়ে গেল।

এখন খাওয়ার সময় খাওয়া নেই,নাওয়ার সময় নাওয়া নেই,নিজের ইচ্ছে মত খামখেয়ালীর মত সব কিছু চলে। উটনকে কখনও দেখা যেত রাত জেগে  বই পড়ছে। আবার কখনও দেখা যেত দিন ভর সে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে। এ সব কারণেই হবে গ্রামের লোক তাকে আড়ালে, উটল পাগলা, বলত।

ধীরে ধীরে দেখা গেল উটনের সঙ্গে বাচ্চাদের ভারী ভাব জমে যাচ্ছে। বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করা, ওদের সময়ে অসময়ে পড়া লেখা করিয়ে দেওয়া,এটা ওটা খাওয়ানো–এ সব করতে করতে বাচ্চাদের সাথে তার ভাব হয়ে যেতে লাগলো। বাচ্চারা এক সময় ওকে,উটন দাদু, বলে ডাকা শুরু করল।

উটনের নানা রকম বই পড়ার নেশা ছিল–বইয়ের মধ্যে এডভেঞ্চারের বইয়ের ওপরে ছিল তার বরাবরের নেশা। মাঝে মাঝে তার নিজের মনে হয়েছে–বোধ হয় এ কারণেই সারাটা জীবন সে  বন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিয়েছে !

প্রায় দিন উটন দাদুর ঘরে শিশুকিশোরদের আসর বসত। দাদু ওদের প্রাথমিক শিক্ষার জ্ঞান জাগাবার চেষ্টা করত। ওদের অনেক অনেক গল্প শুনাত। মহাপুরুষদের গল্প–তার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা এডভেঞ্চারের কাহিনী। বলা যায় এক ধরনের অবৈতনিক স্কুলই পেতে বসে ছিল উটন তার ঘরে।

বস্তুত এই লোকালইয়ে,বিচ্ছিন্ন আদিবাসীদের গ্রামে কোন শিক্ষার ব্যবস্থা নেই,নেই চিকিৎসালয়,কিম্বা কোন ডাক্তার। এদের জীবন যাত্রা এক অমানবিক দ্বীপান্তর বাসীদের মতই। শিক্ষার আলো এখানে প্রবেশ করে নি। চিকিৎসা বলতে জঙ্গলের জড়িবুটি,লতা- পাতা ছাড়া আর কিছুই নেই। কিছু দিন আগেও এরা পোশাকের ব্যবহার জানত না। গাছের ছাল পাতা দিয়ে তৈরি কোন মত শরীরের অশোভনীয় জাগাগুলি ঢেকে রাখত। এই উটনই তাদের সামান্য সভ্যতার আলোয় আনার চেষ্টা করেছে। আজ ওরা তবু টুকরো কাপড় পরে তাদের লজ্জাটুকু নিবারণ করতে শিখেছে। উটনের জন্যেই গাঁয়ের ছেলে মেয়েরা কাগজ,কলম চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছে। অনেক কিছুই তারা চিনতে শিখেছে,জানতে পেরেছে,এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র তাদের উটন দাদুর জন্যে।

তিন্তারি গ্রামের চারদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। গভীর জঙ্গল। সাল, সেগুন,অর্জুন,শিমুল,মহুয়া,তেন্দু,হরতুকি,বহেড়ার বড়  বড় সব গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় গাছের মধ্যে মধ্যে আমলকী,চারু,চালতা,পলাশ এমনি সব ছোট,মাঝারি গাছেদের সমাবেশ। জঙ্গলের এখানে ওখানে কত ঝর্ণা,নদী,ছোট বড় পাহাড়, পর্বত আছে। প্রকৃতি যেন তার আপন হাতে ঢেলে দিয়েছে এখানকার সৌন্দর্য। সাধারণ মানুষের দর্শনের বাইরেই থেকে যায় এ অতুলনীয় সৌন্দর্যময় সম্ভার।

গ্রামের লোকেরা কৃষি কাজ বলতে কিছুই জানে না–বনের এখানে সেখানে সামান্য ফাঁকা জাগায় ওরা ধান,গম,অন্য প্রয়োজনীয় শস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে আসে। তারপর সে গাছে ফল এলে ওরা তুলে নিয়ে আসে। ওদের প্রধান খাদ্য শিকার করা মাছ,মাংস,বনের ফলমূল,অনেক রকম  পোকা মাকড়ও খায় ওরা।

এই তিন্তারি গ্রামের পাশ দিয়েই চলে গেছে বড় এক নদী –নাম তার উড়ালী। বার মাস  নদীতে অনেক জল থাকে–পাহাড়ি নদী—এতে খুব স্রোত,সব সময় ঘূর্ণিপাক চলতে থাকে। এর গভীরতাও অনেক। এতে অনেক কুমির আছে–উটন দাদু দেখেছে কুমিরদের–শীতের সকালে ওগুলো নদীর বালুচরে উঠে রোদ পোহায়। না,উটন কোন দিন কুমির শিকার করেনি। আদিবাসীরা কুমিরের মাংস খায় বলে ওর জানা নেই।  

উটনের নামের পিছনে পাগল পড়ে যাবার কারণ আছে। গ্রামের বেশ কয়েকজন ছেলেকে সে দিন  পাওয়া যাচ্ছিল না। খুঁজে খুঁজে গ্রামবাসীরা হন্যে হয়ে গেল। এদিকে রাত নেমে এলো– জঙ্গলের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে এল—গ্রামের নিরালা ভেঙে উড়ালী নদীর কলকল, ছলছল  শব্দ রাতের স্তব্ধতা চিরে আসতে লাগলো। ঠিক এমনি সময় গ্রামের এক কোন থেকে হইচই সোরগোল সুনতে পাওয়া গেল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখল,উটন তাদের ছেলেদের দলবল নিয়ে বনভাত খেয়ে  ফিরছে। তার কাছে গ্রামের লোকদের নালিশ, সালিশ সব তুচ্ছ হয়ে গেল। আজ বনে শিকার অভিযান,কাল নৌকো যাত্রা,পরশু বনভাত খাওয়া–ছেলেদের নিয়ে এমনি সব চলতেই থাকলো–তাও কাউকে না জানিয়ে। উটন এভাবে গ্রামের লোকেদের কাছে,উটন বাওড়া(পাগল),বনে গেল। আর গ্রামের কিশোর-যুবকদের কাছে উটন দাদু–সবার প্রিয় দাদু।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে  যাওয়া উড়ালী নদীর কথা উটকে খুব ভাবায় –এ নদী নাকি বহু দূর চলে গেছে–কত দূর সেটা কেউ বলতে পারে না। কত কত অজানা  জাগা ধরে,কত কত লোকালয় পেরিয়ে বয়ে গেছে ভাবতে গেলে সে অবাক না হয়ে পারে না। এ নদীর সম্বন্ধে অনেক গল্প,অনেক কাহিনী শোনা যায়। উটন শুনেছে,এই নদীর পারে–এখান থেকে বহু  বহু  দূরে নাকি,কাসনি,গ্রাম আছে। সেখানকার রোমাঞ্চকর অনেক ঘটনার কথা শুনেছে সে।

কাসনি গ্রামের লোকেরা নাকি বন্য জন্তুজানোয়ারদের  মত জীবন যাপন করে। ওদের একেবারেই জংলী বলা যায়। ওদের পোশাক পরিচ্ছদ নেই–উলঙ্গ থাকে। ওরা নাকি দৈত্য, দানব,রাক্ষসদের পূজা করে। সে পূজায় ভিন দেশী লোকদের ধরে এনে  বলি চড়ায়। সেই বলির মাংস গ্রামের সবাই মিলে খায়। তার মানে হল,ওরা মানুষের মাংস খায় ! ওরা তা হলে নরখাদক !

উটন প্রশ্ন করেছিল,ওরা কি নিজের গ্রামের লোকদের খায় না?

–হ্যাঁ,যখন খাদ্যের খুব অভাব হয়,যখন খিদেতে ওদের পেট জ্বলে ওঠার মত হয় তখন বৃদ্ধ মা,বাবাদের কেটে তাদের মাংস ওরা খায়,এ কথা বলে ছিল এই তিন্তারি গ্রামের একশ কুড়ি বছরের বৃদ্ধ,দুগ্গুরাম।

সেই থেকে উটনের মনের একান্ত ইচ্ছে ,যেটা বারবার তার মনের মাঝে পাকিয়ে ওঠে,সেটা হল জীবনে শেষ বারের মত আরও একবার সে নিরুদ্দেশ হয়ে দেখতে চায়। সে দেখতে চায় সেই নরখাদকদের–দেখতে চায় সেই কাসনি গ্রামটিকে। কেমন সে জাগা–সেখানকার লোকেরা কতটা হিংস্র,কতটা নির্দয় !

                                                                         ক্রমশ…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top