অপেক্ষার আকুলতা…
সমস্ত চোখে মুখে রুক্ষতার চাপ। ছেড়ে দেওয়া এলোমেলো চুল চোখ দু’টিতে দীর্ঘ অপেক্ষা। এই অপেক্ষার চোখ নিয়ে লাবণ্য খুঁজে তার প্রিয় মানুষটিকে। কখন আসবে সে অপেক্ষায় দিন গুনে। দিন গুনতে গুনতে ভুল করে গুনে।তবুও যেন তার দিন গুনার নিভৃতি হয়না। লাবণ্য ভাবে কখন তার দিনার এসে বলবে-লাবণ্য তুমি কেমন আছো? না বলে না দিনার আসে না। প্রতিটি বিকেলে লাবণ্য দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির দোতলার ছাদে। বৈকালী সূর্যের রঙ, মাথার ওপর অসীম নীল আকাশ কুয়াশার ছাদর মোড়ানো এ সময়টা অসম্ভব ভালো লাগে লাবণ্যের। এ ভালো লাগার মুহুর্তে দিনারকে সে প্রত্যেকদিন কাছে পেতে চায়। লাবণ্যের ইচ্ছে করে দিনারের হাতে হাত রেখে পড়ন্ত বিকেলের এই অপূর্ব মূহুর্তে আকাশের বুকে নিজেদের ভালো লাগার অসীমত্ব খুঁজে বেড়াতে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। চারদিকে বিজয়ের উল্লাস। ছেলে বুড়ো,তরুণ-তরুণী সবাই যেন আনন্দে আত্মহারা। সবাই যেন আজ মুক্ত স্বাধীন। আকাশে অসংখ্য পাখি আপন মনে ওড়ে বেড়াচ্ছে। চারদিকে গাছপালারাও যেন বিজয়ের উল্লাসে সজীব হয়ে ওঠেছে। অনেক মা ঘরের বারান্দায় বসে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে। গৃহবধূরা স্বামীর অপেক্ষায় পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে দূরে-বহুদূরে। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে যারা ছিনিয়ে আনতে গিয়েছে স্বাধীনতা,লাবণ্য ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখে সবার আকুলতা। ভাবে আমার দিনার ও ফিরে আসবে কাঁধে ষ্টেনগান নিয়ে। দুটো বলিষ্ট বাহু প্রসারিত করে বলবে লাবণ্য পরিয়ে দাও আমার বিজয়ের মালা। লাবণ্য এসব ভাবে আর মনে মনে বলতে থাকে-তুমি জানো না দিনার আমি রাতের আকাশ দেখি,জ্যোৎস্নায় ঘর বেধেঁছি আর সেই ঘরে তুমি ছাড়া আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন।২৫ মার্চ রাতে দিনার দেখা করে লাবণ্যে সাথে। অন্ধকার রাত গোলাগুলির শব্দে যেন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে। পলকহীন দু’জোড়া চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুতে দিনারের হাত ভিজে গেছে। লাবণ্য বলল- যাও দিনার যাও ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চিনিয়ে আনো বিজয়। ওদেরকে দেখিয়ে দাও আমরা হার মানতে জানিনা। দিনার যাওয়ার আগে লাবন্যর হাত ধরে বলে-‘আমি ফিরে এসে দেখতে চাই তোমার চোখে প্রিয় বিচ্ছেদের অধিক আকুলতা…আমাকে দেখে তুমি দৌঁড়ে ফিরে আসবে ছাদ থেকে…বাতাসে তোমার চুল ওড়বে…শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটে পড়বে…আর আমি গভীর আগ্রহে তা তুলে দেবো…তোমাকে ঘোমটা পরিয়ে ঘরে নিয়ে যাবো…আমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার যে আনন্দ অশ্র“ পড়বে তার স্পর্শে যেন ভিজে যায় আমার ক্ষত বিক্ষত বুক…আমি যেন তাতে পরম শান্তি খুঁজে পাই’।
দিনার বিদায় নিয়ে ফিরে যায় স্বাধীনতার যুদ্ধে। দু’পরিবারের মতানুসারে দিনার যুদ্ধে যাওয়ার আগে বিয়েটা হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু দিনার আর লাবণ্য তা চায়নি। তারা চেয়েছিলো দেশ স্বাধীন হবে, চারদিকে জয়জয়কার ধ্বনি ওঠবে। থাকবে না আর কোন হিংস্র হায়েনার ভয়। এমন বিজয়ের দিনে,আনন্দের দিনে যেন দু’জনার বাসর হয়। যেখানে ইচ্ছে মত দুজনে গল্প করবে-ভালোবাসার গল্প,যুদ্ধের গল্প,ভবিষ্যতের গল্প। যেন হায়েনার দল এসে তাদের গল্পে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। সেজন্য লাবণ্য দিনারকে পাঠিয়েছে যুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হবে, দু’জন পাবে একান্ত করে দু’জনাকে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর।চারদিকে যার যার আত্মীয় স্বজনরা ফিরে আসছে বীরদর্পে। বাইরে প্রচন্ড শোরগোল,আতশবাজি আর ব্রাশফায়ারের আনন্দ ধ্বনি।
লাবণ্য দৌঁড়ে ছাদে ওঠে রেলিং ধরে তাকিয়ে আছে রাস্তায়। হাজারো ভীড়ের মাঝে সে খুঁজে একটি মুখকে। যে মুখটা তার একান্ত আপন। কই দিনারকেতো দেখা যাচ্ছেনা। কখন আসে কখন আসে সে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু না লাবণ্যের মনের মানুষটি আজ আসেনা। লাবণ্যর কালি পড়া চোখে বিষাদের চিহ্ন,অশ্রু প্লাবিত চোখ,অভিন্যস্ত এলোকেশ।সবই ঠিক আছে। কিন্তু দিনারতো আসেনা-তাকে বলেনা লাবণ্য তুমি কেমন আছো। দিনার আর লাবণ্যের পরিবারে সবাই জানে দিনার আর ফিরে আসবেনা। যুদ্ধে দিনার শহীদ হয়েছে। নয়লাখ শহীদের রক্তের সাথে দিনারের রক্তের ও প্রয়োজন ছিলো খুব বেশী। আর সেই রক্তের দামে কেনা এই স্বাধীনতা। কিন্তু যে প্রতিদিন ছাদের ওই উত্তর দিকের কোণায় দাঁড়িয়ে দিনারের অপেক্ষায় দিন গুনে সে কিভাবে মেনে নিবে? এভাবে দিন যায়,মাস যায়-বছর ঘুরে আসে বিজয়ের মাস। কিন্তু দিনার ফিরে আসেনা। দিনারের অপেক্ষায় পাগলিনী লাবণ্য ভিড় ভিড় করে বলে-
কবে আসবে তুমি দিনার?
কবে বলবে লাবণ্য তুমি কেমন আছো?
কবে সমস্ত আনন্দ অশ্রু দিয়ে
তোমার বুকে মুখ লুকাবো?
এই প্রতিক্ষায় এখনো অপেক্ষমান লাবণ্যের দু’নয়ন।