ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র”-অষ্টম পর্ব
অষ্টম পর্ব
(নয়)
তিমিরের স্বভাবটা বড় একরোখা। মেজাজটা ইদানীং ভীষণ খিটখিটে হয়েছে। সামান্য কিছুতেই রেগে যায়। বুড়ো বয়সে যারা পেনশান নিয়ে বাড়ীতে বসে থাকে ঠিক তাদের মতোই। নিজেকে যেন কোন কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। নিজের প্রতিও কোন খেয়াল নেই। উদাসীন। বৈরাগ্য ভর করেছে। নিজের জন্য যেটুকু ভাবা প্রয়োজন তাও ঠিকমত হয়ে উঠে না। ভাগ্যিস অনন্তদা ছিল। শেভ করা হয়েছে কতদিন। অনন্তদা শেভের জল বাটি দিয়ে বলল-এভাবে আর কতদিন চলবে। মানুষ বলে তো মনে হচ্ছেনা। যেদিন অনন্তদা থাকবে না সেদিন আর ষ্টোভ জ্বলে না। পাউরুটি আর কলা খেয়ে দিব্যি চলে যায়। টিউশানির চা নাস্তা তো আছেই। পাঁচ ছয়টা টিউশানি। নাস্তাটা না খেলেও চা টা ঠিক খাওয়া হয় রীতিমত। তাতে আর তেমন ক্ষুধা থাকে না।
ইদানীং খিটখিটে মেজাজের ছায়াটা মাঝে মধ্যে ছাত্রদের উপরও গিয়ে পরে। ছাত্ররা ভীষণ ভয় করে।
রবি ভয়ে জিজ্ঞাসা করে-
– এই অংকটা বুঝছি না।
– কোন অংকটা।
– সুদকষা তেইশ নম্বর।
– আগে কতবার করা হয়েছে।
– স্যার দু’বার।
– তখন নিশ্চয় বুঝেছিলে।
রবি চুপ করে থাকে। তিমিরের হাতটা লিক লিক করছে। ইচ্ছা করছে এই মুহুর্তে শক্ত করে একটা চড় লাগিয়ে দিই। ক্লাস নাইনের ছাত্র। সংকোচও হচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
– রবি, আমি প্রথম দিনই বলেছি কখনও না বুঝে বোঝার ভান করবে না। এটা খুব খারাপ। এতে পৃষ্টার পর পৃষ্টা উল্টানো যায়। নিজে থেকে কিছুই করার যোগ্যতা থাকে না। তাতে নিজেরই ক্ষতি। আর না বুঝে দিনে দশটা অংক করার চেয়ে বুঝে শুনে একটা অংক করা অনেক ভালো। বুঝতে পেরেছো আমি কি বল্লাম।
– হ্যাঁ স্যার।
পাশে বসে রিমা কবিতা মুখস্থ করছে। আমি হব সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি..কোন দিকে না তাকিয়ে বড় বড় করে পড়ছে। তিমিরের বিরক্ত লাগছে।
– রিমা।
তিমিরের গম্ভীর ডাক শুনে রিমা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়।
– মনোযোগ দিয়ে আস্তে আস্তে পড়ো। পড়ার সাথে বানান, দাড়ি, কমা সব দেখে নাও। শুধু পড়লে হবেনা। পড়ার সাথে সাথে এগুলো খেয়াল রাখতে হবে।
– আচ্ছা স্যার।
রিমা পড়ার গতি কমিয়ে দেয়। তিমির হাসে। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। তিমির রিমার উপর কখনও রাগ করতে পারে না। পরোক্ষভাবে একটা স্নেহের জাল বিস্তার করে চলেছে দিনের পর দিন। এই আদুরে মেয়েটি ঠিক তার ছোট বোনটির মত।
খুব আদুরে ছিল ললিতা। যে কাউকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারতো। ললিতা যখন বড়দের সামনে পাকা কথার ফুলঝুড়ি ছড়াতো তখন বড়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো। তিমিরের অর্ধেক সময় কাটতো এই ললিতাকে নিয়ে। ললিতার ভালোবাসা আদায় করার ধরনটা ছিল সম্পূর্ন আলাদা।
দৌড়ে এসে কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে মেয়েটা। তিমির জিজ্ঞাসা করত-কি হয়েছে লক্ষী বোন আমার। কেউ বকেছে বুঝি। ললিতা চুপ। একসময় ঝাপিয়ে পরত কোলে। তিমিরের বুকে মুখ গুঁজে অনেক অভিযোগ করত। কে কি কিজন্য বকেছে সব…স…ব।
তিমির সান্তনা দিত। বেশ আর বকবে না। আবার যদি কেউ কিছু বলেছে আমি ওর কানটা টেনে দেব। ঠিক আছে। এই বলে অভিমানী বোনটির কপালে অনেক্ষন চুমু খেত। ললিতা হাসত। গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করত চকলেট, চুইংগাম খাওয়ার জন্য। তিমির তাই কিনে দিত।
যে ফুল অকালে ঝড়ে যায় সে ফুল মানুষের ভালোবাসা পায় বেশী। ভালোবাসায় আদরে বাকী জীবনের অপূর্ণতাটুকু যেন এই অল্প সময়ে আদায় করে নিতে চায়। যে ক’দিন বেঁচে থাকে। ললিতার দশ বছর পূর্ণ না হতেই একদিন চলে যেতে হলো। কেউ ধরে রাখতে পারেনি। না দাদা, না মা বাবা।
হাসপাতালের দিকে খুব দ্রুত টেক্সি নিয়ে ছুটছিল তিমির। বাড়ী থেকে অনেকদূর পথ চলে এসেছে। শহরের বড় হাসপাতালও আর বেশী দূর নেই। মাত্র দু’বার পাতলা পায়খানা হবার পর মেয়েটা যে এভাবে নিস্তেজ হয়ে পরবে কেউ ভাবেনি। রাত দশটা। স্থানীয় ডাক্তার ডাকা হয়েছে। দেখে বলল-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাও।
হঠাৎ করে যেন চোখের মনি দু’টো ঘোলাটে হয়ে গেল। এমন গৌরবর্ণ মুখখানা কেমন ফ্যাকাশে। কথা বলতে পারছে না। কাউকেই চিনতে পারছে না। উদাস হয়ে একবার বড় বড় চোখ করে বাবা আর তিমিরের দিকে তাকিয়েছিল।
একটু পরেই গাড়ী হাসপাতালে পৌঁছবে। ললিতা হঠাৎ করে যেন আবার সুস্থ হয়ে উঠল। সেই হাসিতে তিমির ও বাবা কিছুটা ভরসা পেলেও ললিতা ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছিল এটা তার জীবনের শেষ হাসি। সে আর কখনও হাসবে না। তিমিরের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল-দাদা আমরা কোথায় যাচ্ছি।
– ডাক্তারের কাছে।
– কেন।
– তোর যে অসুখ।
জগদীশ বাবু আশ্বস্থ হলেন। মেয়ের পা দু’টি কোলের উপর টেনে নিয়ে উষ্ণতা পরীক্ষা করলেন। চোখ দু’টো জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিছুই বলতে পারছিল না।
– দূর ছাই, কে বলল অসুখ।
– লক্ষী বোন আমার তোর কিছু হবে না। তুই ভালো হয়ে যাবি বলে তিমির ললিতার মুখটা বুকের মধ্যে চেপে ধরল।
– দাদা আমাকে একটু আদর করবে না। আমাকে একটা চুইংগাম কিনে দেবে। আর কক্ষনো কিছু চাইব না। আদরও করতে বলব না।
তিমির ললিতার মাথাটা বুকের কাছে নিয়ে একের পর এক আদর করে চুমু খেল। কান্নায় কিছু বলতে পারছে না। মাঝে মাঝে ললিতার চোখ দু’টো কেমন বিভৎস হয়ে উঠছে। তিমির চোখ মুছে বলল-ছিঃ ওকথা বলে না বোন। আমার লক্ষী বোন।
ইমারজেন্সিতে নাম লিখিয়ে খুব দ্রুত তিমির ললিতাকে কোলে নিয়ে শিশু বিভাগে নিয়ে গেল। কর্তব্যরত ডাক্তার সিট দিলেন। শিরা দেখলেন। চোখ দেখলেন। প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে বললেন-তাড়াতাড়ি ঔষধগুলো নিয়ে আসুন। আমি অক্সিজেন দিচ্ছি। জগদীশ বাবু এসবে অভ্যস্ত নয়। তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। ডাক্তার নিষেধ করলেন। এখানে কাঁদবেন না। আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। তিমির বাবাকে বাইরে দাড় করিয়ে রেখে বললেন তুমি এখানে দাড়াও। আমি ঔষধ নিয়ে আসছি। জগদীশ বাবু কিছু বললেন না। শুধু চোখের জল মুছলেন।
তিমির ঔষধ নিয়ে দ্রুত কেবিনে ঢুকতেই দেখল বিমর্ষ মুখে ডাক্তার দাড়িয়ে আছে। চশমাটি খুলে হাতের তালুতে চোখ মুছে অস্ফুট স্বরে বললেন-আই এ্যাম সরি। তিমিরের হাত থেকে ঔষধগুলো পরে গেল মেঝেতে।
আজ তিমিরের কথাটা মনে হতেই মেঝেতে পরে যাওয়া ঔষধগুলোর ঝন ঝন শব্দ শুনতে পেল। ললিতাকে কতদিন দেখেনি। কর্মহীন বেকার জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও খুব বেশী মনে পরে ললিতার কথা। আজও খুব মনে পরলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। রুমালে চোখ মুছতেই রিমা জিজ্ঞাসা করল-
– স্যার কাঁদছেন।
রবি ফিরে তাকায়। কিছুই বুঝতে পারে না। তিমির নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
– কই না তো। রিমা তুমি কি চুইংগাম খাও ?
রিমা বুঝতে পারল না। স্যার হঠাৎ চুইংগামের কথা বলল কেন। কোনদিন বলেনি। রিমা জবাব দেয়-
– না। মা বলেছে চুইংগাম খেলে অসুখ হয়।
– ও আচ্ছা, তবে খেও না।
তিমির উঠে দাড়ায়। ঝাপসা চোখে দরজা ঠাহর করতে না পেরে চৌকাঠে হোচট খায়। রুমালে চোখ মুছে সামনের বড় রাস্তায় নেমে আসে তিমির।