অপ্রকাশিত কষ্ট
আমার স্ত্রী ফারজানাকে চায়ের কথা বলার জন্য রান্নাঘরে গেলাম। দেখলাম সে কোরবানির মাংস বাছতে গিয়ে খুব ঘেমে উঠেছে। কানের পাশের চুলগুলো ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে। আমাকে দেখে সে বললো, কিছু বলবে?
ওর এই ব্যস্ততার মাঝে চায়ের কথা বলতে মন সায় দিল না। বললাম, আমি একটু বাইরে গেলাম।
জিগাতলা গাবতলা মসজিদের পশ্চিমে তিনতলা একটা বাসায় আমার স্ত্রীকে নিয়ে থাকি। আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ফারজানা ইডেন কলেজে ইকোনমিক্সে থার্ড ইয়ারে পড়ে। একবছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে।
একবার ঢাকা থেকে পাবনায় আমাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য গাবতলী গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে গাড়িতে উঠেছিল। বেশ লম্বা, ফর্শা এবং স্বাস্থ্য ভালো। আমার দুই সিট পূর্বে সে বসেছিল। একসময় গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। ঢাকা থেকে যতই দূরে যাচ্ছিলাম ততই মনের মধ্যে মেয়েটার সাথে কথা বলার তাগিদ দানা বেঁধে উঠছিল। কিন্তু কোনো অজুহাত ছাড়া শুধু শুধু একটা মেয়ের সাথে কথা বলাও তো খারাপ দেখায়। তাই অপেক্ষায় ছিলাম। টাঙ্গাইল পার হয়ে এলেঙ্গা গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামলে প্রায় সবাই নেমে পড়েছিল। মেয়েটাও মিনিট দুয়েক পর বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার সিটের বেশি কাছাকাছি একমাত্র আমিই তখনও বসে ছিলাম। সে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরেছিল দেখে প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। সে একটু হেসে রিকোয়েস্টের সুরে তার সিটের পাশে রাখা ব্যাগ দেখিয়ে আমাকে বলেছিল, ভাইয়া আমার ব্যাগটা একটু দেখবেন প্লিজ। একথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বলেছিলাম, ঠিক আছে।
সে ফিরে এসে একটা হাসি দিয়ে আমাকে বলেছিল, থ্যাঙ্ক ইউ। জবাবে আমি শুধু হেসেছিলাম।
আমার গন্তব্যের মাইল তিনেক পূর্বে সে নেমে যাচ্ছিল বুঝতে পেরে তারাতারি উঠে আগ বাড়িয়েই তার ব্যাগ নিয়ে আমিও নেমে পড়েছিলাম। তাকে রিক্সায় তুলে দিতে দিতে সংকোচের সাথে তার নাম, বাবার নাম এবং বাড়ির লোকেশনটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার জন্যই সেখানে আমার নামার কথা শুনে, চার ঘন্টা চলার পথে আমার গতিবিধি লক্ষ্য করে এবং আমার মুখের অভিব্যক্তি যাচাই করে হয়তো আমাকে তার কাছে খারাপ মানুষ মনে না হওয়ায় সে আমার প্রশ্নগুলির জবাব দিয়েছিল। আর তারই সূত্র ধরে আমার বাবাকে দিয়ে তার বাবার কাছে আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। আমার প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয়েছিল, আমি পেয়েছিলাম খুব ভালো একজন মেয়েকে। আগে ফারজানা হোস্টেলে থাকতো। বিয়ের পর থেকে আমরা এখানে আছি।
আজ কোরবানির ঈদ। আমাদের দুজনের মাথায় একটা আজব বুদ্ধি এসেছিল যে আমরা ঢাকায় ঈদ করবো। কথামতো কাজ। এবারই আমি প্রথম কোরবানি দিয়েছি। ঈদের নামাজ পড়ে এসেই মাংস বানানোর ওখানে গিয়েছিলাম। মাংস নিয়ে যখন ফিরেছিলাম তখন ফারজানা খুব খুশি হয়েছিল। কারণ গরুর মাংস ওর ভীষন পছন্দ। কোমড়ে ওড়না বেঁধে ও যখন মাংস নিয়ে বসেছিল তখন আমি ওর ভাবসাব দেখে হেসে ফেলায় সেও আমাকে হাসতে হাসতে মারতে এসেছিল।
চা খাওয়ার জন্য বাইরে যাওয়ার সময় সন্দেহ হলো যে আজ চায়ের দোকান খোলা আছে কিনা। কিন্তু গিয়ে দেখলাম খোলা আছে। তবে রাস্তায় রিক্সা এবং গাড়ি তেমন নেই। বাসায় ফেরার সময় দুজন লোকের কথোপকথন আমার কানে ঢুকলো। একজন বললো, ভাই ওদিকে কোথায় গিয়েছিলেন?
অন্যজন বললো, কি আর বলবো ভাই, কোরবানি তো দিতে পারিনি। এদিকে জামাই মানে শিউলীর বর এসেছে বাসায়। তাই টেনারির মোড়ে গিয়েছিলাম মাংস কিনতে। কিন্তু পেলাম না। কি আর করা, একটা মুরগি কিনে নিয়ে যাই।
আমি দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। লোকটার দিকে তাকালাম। বয়স পঞ্চান্ন বছরের মতো হবে। হাতে বাজারের ব্যাগ। প্রথম লোকটা বললো, ও-ও-ও। তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হলো না। একটা বিব্রতকর অবস্থা। অবশেষে দ্বিতীয় লোকটাই বললো, আচ্ছা আসি। সে আর দেরী করলো না।
আমি লোকটাকে অনুসরণ করলাম। পূর্বদিকে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে একটা দোকান থেকে একটা মুরগি কিনলো। তারপর পশ্চিম দিকে কিছুটা এসে উত্তরদিকে একটা গলির মধ্যে ঢুকলো। কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে পড়লো।
পুরো বিষয়টা লক্ষ্য করে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাসায় চলে এলাম। ফারজানা দরজা খুলে দিয়েই ওর কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আমি বিছানায় শুয়ে ঘটনাটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আজ ঈদ। যে লোকের কোরবানি দেওয়ার যোগ্যতা আছে সে দিবে, যার নেই সে দিবে না। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু জামাই বাসায় এসেছে অথচ তাকে একজন বাবা কোরবানির মাংস খাওয়াতে পারছে না এটা কি কষ্টকর নয়? আর সেই মেয়েটাই কি তার স্বামীর কাছে লজ্জা পাবে না? তার বাবার অপারগতায় তার ভিতর থেকে নিশ্চয়ই দীর্ঘশ্বাস বের হবে। আমাদের চারপাশে এরকম কত শত মানুষের কত কষ্টই না জানি অপ্রকাশিত রয়ে যায় যা আমরা জানতেও পারিনা কখনো। একজন বাবা এবং একটি মেয়ের কষ্ট ও লজ্জার কথা ভাবতে ভাবতে আমিও কষ্টে নিমজ্জিত হলাম।
আমার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ফারজানা এসে আমাকে ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, টেলিভিশন দেখছো না, কোনো কথাবার্তাও নেই, কি হয়েছে তোমার?
আমি বললাম, না কিছু হয়নি।
ফারজানা বললো, কিছু হয়নি বললেই হলো?
আমার কোমড়ের কাছে বসে আমার দিকে ঝুঁকে সে আবার বললো, আমার স্বামীকে আমি একবছর হলো দেখছি। ভেবেছ তোমাকে আমি চিনি না? প্লিজ, কি হয়েছে বল আমাকে।
আমি বললাম, তোমাকে বলে কোনো লাভ হবে না।
ফারজানা বললো, আমি কিন্তু এবার সত্যিই রাগ করবো।
আমি ঘটনাটা খুলে বললাম। সে কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন চিন্তা করলো। তারপর একটু হাসলো। বললো, এই ঢাকা শহরে আজকের দিনে তুমি যদি মন খারাপ করে বসে থাকো তাহলে তো হবে না! তাই কিভাবে তোমার মন ভালো করা যায় তা তো আমাকে দেখতেই হবে।
আমি বললাম, কি করবে তুমি?
সে বললো, কোন বিল্ডিং-এ লোকটাকে তুমি ঢুকতে দেখেছ?
আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম। সে বললো, আমি ঐ বাসায় মাংস দিতে যাবো।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তারা কি নিবে? অপমানিত বোধ করবে না? তুমি কি কাজটা পারবে?
সে বললো, পারতে হবে। তারপর নতুন শাড়ি পরে মাথায় ওড়না চাপিয়ে হালকা সাজগোজ করে এক প্যাকেট মাংস নিয়ে সে বের হলো। ফারজানা সবসময় সালোয়ার-কামিজ পরে। কিন্তু আজ শাড়ি পরে পাকা গৃহিনীর মতো লাগছে।
বিশ মিনিট পর সে ফিরে এলো। দরজা খুলে দিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, কোনো সমস্যা হয়নি তো?
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে সে বললো, একটু হয়েছিল। কিন্তু আমি সামাল দিয়েছি।
ফারজানা ওড়না খুলে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। শাড়ি পরা এবং খোঁপা করা অবস্থায় তাকে খুব সুন্দর লাগছে। তাই পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। সে ঝড়ে উপড়ানো গাছের মত শরীরের ভার আমার শরীরে দিল। দেখলাম তার চোখ বোঁজা। মুখটা লালচে হয়ে উঠেছে এবং ঢোক গিলছে। লোকটার বাসায় মাংস পৌঁছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ফারজানা আমার কষ্টটা কমিয়ে দিয়েছিল। ওর স্পর্শ আমার মন থেকে কষ্টের কথা পুরোপুরি উধাও করে দিল।