Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ঈদের আনন্দ ও গাঁয়ের সহজ-সরল মানুষেরা

: | : ১৯/১০/২০১৩

ঈদে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়ি। ভূঁইয়া বাড়ি আমাদের। আমার বয়সী ও ছোট বড়ো চাচাতো বোন আছে ৭ জন। পাড়ায় আরো কয়েকজন মেয়ে আছে। বাড়ি গেলেই ওরা আমার সঙ্গী হয়ে যায়। আনন্দই আনন্দ।

আমার ছোট চাচার মেয়ে তানজিয়া। ক্লাস এইটে পড়ে। খুব স্মার্ট। খাঁটি গ্রামের ভাষায় কথা বলে। সে আঠার মতো লেগে থাকবে আমার সাথে। তার কথা শুনলে হাসি পায়, মজাও লাগে। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি আমি।

বিকেল বেলা। তানজিয়া দৌড়ে এসে বলল, ‘সুমাইয়াপু লাইগ্যা গেছে গা।’
‘কী লাইগ্যা গেছে রে?’
‘কাইজ্জা। হুনবানি। হুনলে লও যাই। হ্যারা ক্যামনে যে কাইজ্জা করে দেখলে বুঝবা। হোমানে বকাবকি করে। বকা হুনলে আক্কইরা থাকবা।’
আমি বললাম, ‘হ চল যাই।’

শরমে শরমে গেলাম। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখছি। পুবে একটা ঘর আর পশ্চিমে একটা ঘর। মাঝখানে সাদা একটা উঠোন। দুই ভাইয়ের দুই বউ। এরা মাথার আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে ঝগড়া করছে। একজনের হাতে একটা পাতিল আরেক জনের হাতে একটা ঝাড়ু। বকাবকির সময় হাতের ঝাড়ু-পাতিলও জানি কেমন কথা বলে। লাগছে কাইজা ঠিকমতো। আশেপাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখছে।

এক মহিলা ঝগড়া ফেলে আমার সামনে এসে কেঁদে ফেলল। সে বলছে, ‘ভূঁইয়ার নাতনী আইছেন বালা অইছে। বিচার কইরা দিয়া যাইন। হোনছেননি কামাইল্যার মায় যে আমারে ইত্তা কি কয়? আমার লগে আয়েন আর খালি হোনেন, কি বকাগুলান বকলো আমারে। কামাইল্যার মায় যেই বকাগুলান বকলো এর একটা বকা আমার মুখ থাইকা জীবনেও বারইব না।’ আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল মহিলাটি।

তানজিয়া ঠমক মেরে বলল, ‘আমরা বিচার করতে আইছি কোনো? ঝগড়া হুনতে আইছি। যান, হোমানে ঝগড়া করেন গিয়া। আফনে বকা মারতে পারেন না কামালের মারে?’

মহিলাটি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে, ‘এই যে লোকগুলি খাঁড়ইয়া কাইজ্জা হুনতাছে, কেউনি কইতে পারবে আমি একটা খারাপ কতা কইছি।’ এক মহিলা তার কথা শুনে বিছার মতো লাফিয়ে উঠল। সে চোখ-মুখ চোখা করে বলল, ‘না, এতক্ষন না আফনে খালি ওয়াজ করছেন। আমরা এহানে খাড়াইয়া না খালি আফনের ওয়াজ হুনতে আছি। এহন মলুবি সাজছে, আস্তা মিথ্যুক।’ মহিলা ঠোকর মেরে মেরে কথাগুলো বলল।

মহিলাটি আমার হাতে ধরে টেনে টেনে বলছে, ‘আমার ঘরে আয়েন।’ না করতে করতে তার ছোট বারান্দায় গিয়ে থামলাম। মহিলা ঘরের ভেতরে গেল। একটা জলচকি আঁচলে মুছে ফু দিতে দিতে বলল, ‘চিহার নাই গ, কষ্ট কইরা জলচহিতেই বহেন। চাইরটা মুড়ি অইলেও মুখে দিতে অইব।’

দুই মহিলা যার যার মতো করে কাজ করছে আবার আরেঠারে কথাও বলছে। বকাবকি আর হচ্ছে না দেখে তানজিয়া আফছুছ করে বলল, ‘আয় হায়, সুমাইয়াপু তোমারে কাইজ্জা হোনাইতে নিয়া আইছিলাম, এহন দেহি কাইজ্জা অক্করে পোঁতাইয়া গেছে গা।’

মহিলা একটা বাটিতে মুড়ি আর খেজুরের গুড় এনে দিতে দিতে বলল, ‘নিজের হাতে ভাজা মুড়ি। খাইয়া খালি দেহেন, কি যে মজা। খাইন।’ আমরা একটা দুটো করে মুখে দিচ্ছি। মহিলা মাথায় কাপড় টেনে ঘোমটা দিয়ে আমার সামনে এসে ভালো মানুষটি হয়ে বসল। তারপর ওই মহিলার বিরুদ্ধে রাজ্যের বদনাম করতে লাগল। কিছু কথা বলে জোরে জোরে, কিছু বলে ফিসফিস করে।

তানজিয়া বলে, ‘চলো যাইগা, ‘কাইজ্জা মনে অয় আর অইত না, অনাফুত আইছি।’ বিদায় নিয়ে উঠোন দিয়ে চলে আসছি অমনি অপর ঝগড়াটে মহিলা দুহাত বাড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘কই যাইন? আমরা কি মানুষ না? হের ঘরে বেড়াইছেন আর আমার ঘরে যাইবেন না-এইডা ত অইবে না। আমি ওই আদেল্লার মতো হুগনা মুড়ি খাওয়ামু না, ছাগলের হাঞ্জো (টাটকা) দুধ খাওয়ামু’-বলেই মহিলা আমাদের বসিয়ে রেখে একটা ছোট ঘরে গেল। একটা ছাগল টেনে এনে খুঁটিতে বাঁধলো। ছাগলের তলে একটা বাটি ধরে দুধ দোহাতে লাগল। একটু পরে একটা ছাগলছানা লেজ নেড়ে ম্যা ম্যা করে ছুটে এসে দুধ খেতে লাগল। একটু খাওয়ার পরেই মহিলা ছানাটির মুখে থাপ্পড় মেরে সরিয়ে দিল। একটি উদোম শিশু ছটফট করা ছানাটিকে কোলে নিয়ে আদর করছে। মহিলা আবার দুধ দোহাতে লাগল। আমি অবাক হয়ে দেখছি আর ভাবছি, ‘এই দুধ নি আবার আমাকে খাওয়ায়!’

তানজিয়া আমার অবস্থা দেখে কানে কানে বলল, ‘সুমাইয়াপু, দেইখনে, এহন এই ছাগলের দুধ তোমারে খাওয়াইবে। যেই বয় (গন্ধ) ছাগলের দুধে!’ আমার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি এই দুধ খাব না। তানজিয়া বলল, ‘খাইবা না? আইয়ো ত পলাইয়া যাইগা।’ আমি বললাম, ‘ধ্যাত, পলায় আবার ক্যামনে, ফাজিল।’ সে বলে, ‘তাইলে এই ছাগলের দুধ খাইতে অইব কইলাম।’

মহিলা চুলায় দুধ বসাল।

‘আমরা গরিব অইতে পারি কিন্তুক ভূঁইয়ার নাতনিরে যেইডা মোল্লয় হেইডা দিয়া সমাদর করতাতাম না। গুড়মুড়ি কোনো সমাদরের জিনিস অইল? পেটকামড়ানির যোগাড়।’ এসব বলতে বলতে মহিলা দুটি গ্লাসে ছাগলের গরম দুধ এনে সামনে ধরল। তানজিয়া নিল কিন্তু আমি হাত-পা ছুড়ে সমানে না করছি। আর বলছি, ‘আমি গরুর দুধ খাই, ছাগলের দুধ খাই না।’ মহিলা বলল, ‘ছাগলের দুধ পাইবেন কই? খাইয়া খালি দেহেন, কী জিনিস, গরুর দুধের বাবা।’ আমি হাতে গ্লাস নিয়ে তানজিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তানজিয়া কানে কানে বলল, ‘নাকে চিপ দিয়া ধইরে বায়ে বায়ে খাইয়ালাও। এই মহিলা যেই ঝগরাইট্টা, না খাইলে দাদীর কাছে এক্ষণ গিয়ে বিচার দিবে। পরে?’

হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। মুখে হাসি এনে বললাম, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক খুশি হয়েছি টাটকা দুধ পেয়ে। মাত্র মুড়িগুড় খেলাম তো তাই এ দুধ এখন খাবো না। নিয়ে যাই, বাড়ি গিয়ে খাবো নে।’ খোদার কি রহমত, মহিলা না করল না। সে খুশিতে পাতিলের বাকি দুধটুকু এনে দিল। আমাদের এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভূঁইয়ান্নিকে কইয়েন, কামালের মায় ছাগলের হাঞ্জো দুধ দিয়া দিছে। খাইয়া দেইক্কেন-বাঘের শক্তি!’

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top