উটন দাদুর কাহিনী–পর্ব-৬(শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
এমনি সময় এক ঘটনা ঘটল। উড়ালী নদীতে অসংখ্য কুমিরের বাস–নদী পথে কুমিরদের থেকে সতর্ক থাকতেই হয়–একটু সময় সুযোগ পেলেই মানুষের মাংস পেতে ওরা বড় লোলুপ।
এক ক্ষুধার্ত কুমির ওদের নৌকোর পিছু নিয়েছিল। ওটা বারবার তাক করছিল–কাকে তাক করে ধরবে ও ভাবছিল। একবার কারো হাত বা পা যদি বাগে পাওয়া যায় তবে এক দুবার চীৎকারের আগেই ও শিকারকে জলে টেনে ফেলতে পারবে। আর জলে ফেলতে পারলে কাম ফতে। সুস্বাদু নরম মানুষের মাংস খাবার এসে যাবে তার হাতে আর জলের গভীরে নিয়ে গিয়ে একান্তে সে ভুরি ভোজ করতে পারবে।
বেশ সময় ধরে কুমিরটা ওদের নৌকোর পিছু নিয়ে ছিল। নাদুস নুদুস চেহারার ছেলেগুলিকে দেখে কুমিরের আরও বেশী খিদে পেয়ে গিয়ে ছিল হবে। এবার কুমির জল ছেড়ে নৌকোর এক কোন বেয়ে উঠে মুখ বাড়াল। সামান্য দূরেই শুয়ে আছে নেচু–ও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কুমির ধীরে ধীরে ওর পায়ের কাছে গিয়ে মুখ দিয়ে খপ করে পাটা ধরে ফেলল। আর সঙ্গে সঙ্গে দিল এক হ্যাঁচকা টান।
নেচুর হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল ও যন্ত্রণায় ও ভয়ে গলা ফাটা চীৎকার দিয়ে উঠলো। ওর চীৎকারে তন্দ্রায়িত উটন দাদুর আচমকা তন্দ্রা ছুটে গেল–দাদু দেখল,নেচুকে কুমিরে ধরে টানছে! কদাকার ভয়ঙ্কর চেহারার বিরাট সে কুমির। দেখতে দেখতে নেচুকে কুমির অনেকটা জলে টেনে নিয়েছে। আর এক টান দিলেই নিচু জলে পড়ে পড়ে যাবে। তা হলে নেচুকে বাঁচান মুস্কিল হয়ে যাবে। উটন দাদু চীৎকার করে উঠল, সাবধান,একশন!
উটনের চীৎকারে ধড়ফড় করে নৌকোর ঘুমন্ত ছেলেরা জেগে উঠলো। কয়েক মুহূর্ত সময় চলে গেল ওদের ব্যাপারটা বুঝে নিতে। তারপর সবাই যার যার হাতিয়ার তুলে নিলো। ততক্ষণে কুমির নেচুকে নামিয়ে জলে ফেলে দিয়েছে।
নেচুর আর্তনাদে চারদিক মুখরিত হয়ে গেছে। উটন তার গাঁদা বন্দুক উঠিয়ে কুমিরের দিকে তাক করল। গুলির গুড়ুম,শব্দ চারিকে ছড়িয়ে পড়ল। জল আন্দোলিত হল,খানিক পরেই বোঝা গেল,না, কুমিরের গায়ে গুলি লাগে নি–নেচুকে টেনে নিতে কুমির ব্যস্ত। নেচু তখনও চীৎকার করে চলেছে। ওর মাথা তখনও ডুবছে,ভাসছে। ওর মুখ থেকে যন্ত্রণা কাতর শব্দ বেরিয়ে আসছে।
জঙ্গলের ছেলে বনুই,নবু,কুন্তা–ওরা সবাই শিকারে বেশ পটু। নিজেকে কি ভাবে আত্মরক্ষা করতে ওরা তা জানে। ওরা নেচুকে বাঁচাতে হাতে ছুরি নিয়ে ঝাঁপ দিল নদীতে।
কুমির তখনও জলের অতলে যেতে পারে নি। ওরা তিনজন কুমিরের তিন দিক ঘিরে তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে লাগলো। কাহিল,অবসন্ন নেচুর মুখ থেকে তখন জলের বুদবুদ উঠছে–পা থেকে রক্তের ধারা বইছে। বনুই ওরা সাহসভরে কুমিরের আরও কাছে এগিয়ে গেল–কুমির এবার নেচুকে ছেড়ে দিয়ে বুনাইকে কামড়ে ধরতে এগিয়ে এলো। বনুই আর মুহূর্ত মাত্র অপেক্ষা না করে তার হাতের চুরি ঢুকিয়ে দিল কুমিরের এক চোখে। এবার কুমিরের চোখ থেকে গলগল করে রক্তের ফোয়ারা ছুটে বুদবুদ হয়ে নদীর জল রক্তাক্ত করে তুলল। এবার ঘায়েল কুমির প্রাণ ভয়ে জলের অতলে ডুব দিল।
উটন দাদু আর বাকি নৌকোর ছেলেরা বৈঠা দাঁড় দিয়ে নৌকোকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল। ওরা দেখল নেচুর পাশটায় জল রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। ওদের ভয় হল–ওদের সাথী,নেচুকে কুমিরে খেয়ে ফেলে নি তো ! উটন দাদুর অভিজ্ঞতাই ঠিক হল। তার মনে হল নেচু বেঁচে যাবে। কারণ তিনজন দুর্ধর্ষ,সশস্ত্র শিকারী ছেলে ঝাঁপ দিয়েছে জলে–কুমিরের কি সাধ্য ওদের মাঝখান থেকে সাথী নেচুকে নিয়ে যাবে!
খানিক সময় পর জলের ওপর সবাই ভেসে উঠলো–জলের মাঝখান থেকে নেচুকে উঁচু করে ধরে বাকি তিনজন নৌকার পাশে এসে গেল। নৌকার সবাই মিলে নেচুকে টেনে তুলল নৌকায়। উটন তার ফাস্টেড বক্স খুলল–নেচুর পায়ে হাঁটুর কাছে কুমিরের খুবলে খাওয়া জাগাগুলি পরিষ্কার করে এন্টিসেপটিক ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। এভাবে ওরা এক বাধা এড়িয়ে গেল। যদিও লেংড়া নেচু পা নিয়ে কবে উঠে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারে না–তাকে নৌকোতেই পড়ে থাকতে হবে ভাল না হওয়া পর্যন্ত। কে জানে আরও কত বাধা বিপত্তি ওদের সামনে পড়ে আছে ! কাসনি গ্রামের বুনোরা এসে যদি ওকে ধরে নিয়ে যায় তবে কারো কিছু করার থাকবে না। কারণ নেচু তো দু পা নাড়িয়ে কোথাও পালাতে পারবে না। বাকি তিনজন যারা নেচুকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ছিল তাদের গায়ের দু এক জাগায় ছোট খাট চোট এসেছে। বনুইয়ের আঙুলে কখন যেন কুমির দাঁত ফুটিয়ে দিয়ে ছিল। তবে ওদের আঘাত বড় কিছু নয়। আগামীতে ওরা দিব্বি নিজেকে বাঁচাবার ভরপুর চেষ্টা করতে পারবে।
আবার সবাই ঘুমে নিমগ্ন। শুধুমাত্র উটন দাদু ঝিম জাগরণ ও নিদ্রার মাঝামাঝি অবস্থায় আছে। তার মনে ভয় লেগে আছে তার মনে–এ ভয়াল ও জঙ্গলের ভয়াবহতার কথা সে জানে। এর পদে পদে লুকিয়ে থাকে বিপদ–কখন যে কার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে তা কেউ বলতে পারে না !
তখন শেষ রাত। চারদিকে যেন আঠালো জমাট অন্ধকার। দিগন্তের ফালি চাঁদ কখন যেন ডুবে গেছে। হাল ছাড়া নৌকো স্রোতের টানে ছুটে চলেছে। ঝিম ঘুমের মাঝ থেকে উটন দাদুর চোখে পড়ল,চকচকে দুটো আলোর গোলা–যেন পাক খেয়ে ঘুরে যাচ্ছে ! উটনের ধরে নিতে ভুল হল না,সে সহজেই বুঝতে পারল,নদীর পারে বাঘ দাঁড়িয়ে আছে–আর তার দু চোখ অন্ধকারে জ্বলছে। বাঘ ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার্ত ওটা,প্রথমটা মনে হয়ে ছিল,বাঘ হয়তো শেষ রাতে জল খেতে নদীর পারে এসেছে। এখানের বাঘ জলে-স্থলে অবাধ চলা ফেরায় পটু। হঠাৎ উটন শুনতে পেল, ঝপাত জলের আওয়াজ,নদীতে ঝাঁপ দেবার আওয়াজ ! হ্যাঁ,বাঘ জলে ঝাঁপ দিয়েছে—ওদের নৌকো থেকে মানুষ শিকার করবে বলে। হিংস্র জন্তুটা সাঁতরে নৌকোর দিকেই এগিয়ে আসছে ! আবার উটন চীৎকার দিয়ে উঠলেন,সাবধান,একশন !
ছেলেরা আবার ভয়ে শোরগোল করে উঠে বসে যার যার অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। শুধু নেচুকে নৌকোর মাঝখানে টেনে নেওয়া হল—দুর্বল,অপারক নেচুকে বাঘ যেন টেনে নিয়ে যেতে না পারে। নৌকোয় তখন হৈ হল্লা শুরু হয়ে গেছে। অন্ধকারের মাঝে বাঘের চোখগুলি শুধু দেখা যাচ্ছিল। ওর মস্ত শরীরটা জলে ও আঁধারে ঢেকে গিয়েছে।
হৈ হল্লা,চীৎকারে বাঘ যেন মাঝ পথে থমকে গেল। ওর নিজেকে নিরাপদ মনে হল না। ও বুঝে গেছে শিকার দল বেঁধে শিকারী বনে গেছে। অনিরাপদ মনে করে বাঘ ফিরে গেল তার নিরাপদ নদীর তীরে। যতই ভয় পাক না কেন,স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল,বাঘ বনের ভেতরে ঢুকে যায় নি–নদীর পারে তখনও দাঁড়িয়ে ওদের নৌকোর দিকে লালসার চাহনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টিপাত মনে মনে শিকারের দেহ লেহন করে যাচ্ছিল !
পর দিন সকাল হল–উটন তার হাত ঘড়িতে দেখল,বেলা আটটা। নৌকোয় সবাই তখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাঘ দেখার খানিক পর থেকে উটনও টের পায় নি যে কখন গভীর ঘুম তাকেও আচ্ছন্ন করে নিয়েছে !
নদীর বালুচরের এক পারে নৌকো ভিড়ানো হল। এক গাছের সঙ্গে নৌকোকে বেঁধে রাখা হল। সকালের নাস্তাইয় শুকনো রুটি আর শুটকি মাছের ভর্তা। খিদের পেটে সবাই মহা তৃপ্তিতে খেয়ে নিলো। সবাই,এক মাত্র নেচু ছাড়া,নদীর পারে উঠে এলো। চারদিক দিনের ঝলমলে রুপালি আলোয় ভরে আছে। সবার শরীরে সুন্দর নাতিশীতোষ্ণ আমেজ লেগে আছে। উটন দাদু নৌকোর আশপাশের সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করে যাচ্ছিল। দূরে বালিচরের দিকে খা খা খালি বালিয়াড়ি–অস্পষ্ট দৃষ্টিতে দূরে,বহু দূরে মনে হচ্ছিল পাথর সাজিয়ে তৈরি করা দু একটা ঘরের আকৃতি। ছেলেরা সামান্য দূরের নদীর আশপাশ ও বালিচর নিরীক্ষণ করে চলেছে। উটন দাদুর নির্দেশ মত ওদের বেশী দূরে যাওয়া মানা আছে।
ক্রমশ…