অনেক কথা২০
ইসলাম ও শান্তি–
* ইসলাম একটি পরিপূর্ণ নাম এবং পরিপূর্ণ জীবনবিধান। আজ এ-ই পরিপূর্ণ নামের মান ক্ষুণ্ন করছে কিছু সংখ্যক উগ্রকর্মা এবং উগ্রচণ্ডা। ‘ইসলাম’ অর্থ শান্তি ‘ধর্ম’ অর্থ পথ, ইসলামধর্ম ‘শান্তির পথ’। মূল হতে ‘মৌলিক’ অর্থ অনার্য-অকুলীন, মৌলিক হতে মৌলের উৎপত্তি। সম্ভবত অনার্যদের হাতে ইসলাম লাঞ্ছিত আজ? মৌলিকতার হাতে ইসলাম মূলোচ্ছেদ হতে পারে একদিন? কারণ যে দিনের নবি অনেক ত্যাগতিতিক্ষা ও কষ্টের বিনিময়ে দিনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সে দিনের নবি স্বগোত্রের কাছে সোনাচাঁদি অমূল্য ধনসম্পদ টাকাপয়সা কী চেয়েছিলেন? কিছুই ত চান নি, এমনই মৌলিক অধিকারটুকু ছাড়া। কী কামনা করেছিলেন? কী পেয়েছিলেন? সব সময় লাঞ্ছনাগঞ্জনা ছাড়া! আজ তাদের অনুসারীরা কি পৃথিবীতে নেই? নিশ্চয় আছে। তা হলে? সবচেয়ে বড় কথা জানি, যাঁরা ধার্মিক হবে তাঁরা শান্তির বাণী কবে, মানবজাতিকে সরলতার পথ দেখাবে এবং তাঁরাই সব সময় শান্তির উদ্দেশ্যে সরলপথ ধরে চলবে। কিন্তু দুঃখের কথা এই, মানুষের চেয়ে যাঁরা ধর্মমত বড় মনে করে তাঁরা শান্তি বা সরলতার পথ ধরে চলবে কীভাবে? এমন ধার্মিকের মন কখনো উদার হতে পারে না। যেই সত্য প্রচারের জন্যে প্রাণপ্রিয় নবিকে স্বজাতিরা কত কষ্ট দিয়েছিল একদিন, সেই সত্যের কাছে সারা জাহান মাথা নত করতে হল আরেকদিন। এমন মহানধর্ম ইসলাম আজ টেররিষ্ট! ইসলাম শান্তি বয়ে এনেছিল–ধ্বংস নয়। আজ যারা ইসলামের নামে ধ্বংস করছে তারা প্রকৃত মুসলমান নয়। শান্তির মহাতপা মহানবিকে যারা একদিন অশান্তি মনে করে হত্যার প্রচেষ্টায় ছিল ওতপেতে, আজ তাদেরই বংশধরেরা ইসলামকে মূলোচ্ছেদ করতে চাচ্ছে! কিন্তু আল্লাহ্ যার সহায়ক তার ক্ষতি করে কোন্ নাশক।
এত দুঃখকষ্ট এবং অত্যাচারিত হওয়ার পরেও বিশ্বনিখিলের ন্যায়পাল স্বজাতির প্রতি এতটুকু অন্যায় অবিচার করবে দূরে থাক্, কখনো বদ্দোয়া কামনাও করে নি! এই আদর্শের ধার্মিক কে? মানুষের জন্যে ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। আজ যেখানেই দেখ, স্বার্থের লক্ষ্যে ধর্মের ব্যবহার! সত্যিই ইসলামের বড় দুর্দিন আজ। যেই ইসলাম অনেক রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল একদিন, সেই ইসলাম কোনদিন মাথা নিচু করে পৃথিবী থেকে যাবে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম সততার ধর্ম–সরলপথ অবলম্বন করা ইসলামের একটি মহৎগুণ। ইসলাম সংঘাত চায় না, চায় না রক্তের বান। ইসলাম জোরের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, ইসলাম প্রেম দিয়ে প্রতিষ্ঠা চায়। ইসলাম জোরের ধর্ম নয়, ইসলাম প্রেমের ধর্ম–সত্যন্যায়নিষ্ঠ শান্তিপ্রতিষ্ঠার এক মহৎ নাম ‘ইসলাম’। ইসলাম মহান একমাত্র ধর্ম। এমন ইসলামকে কেউ ধ্বংস করতে চাইলে খোদ ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ ইসলামকে প্রসারিত করেছে স্বয়ং আল্লাহ্, ইসলামকে রক্ষা করবে আল্লাহ্। এক আল্লাহ্র দুনিয়ায় এক ইসলাম চলতে পারে। বার হাজার দল গড়ে, বার শ রাজ্যের কথা বলে ইসলামকে কলঙ্কিত হতে দেওয়া যায় না। প্রকৃত মুসলমানগণের দায়িত্ব, ইসলামকে উগ্রচণ্ডীদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনা। তবেই ইসলামে শান্তি–ইসলাম কলঙ্কমুক্ত।
ইসলাম দাঙ্গা চায় না, ইসলাম চায় শান্তি, চায় সৌহার্দ, চায় ভ্রাতৃত্ব। রক্ত দিয়ে হোলিখেলা ইসলামের স্বভাব নয়। ইসলাম করুণা করে, করুণা চায় না। করুণার জন্যে ইসলাম কারও মুখাপেক্ষি নয়। তবে? কোন্ চাঁদোয়া তুমি? ইসলামকে ছায়া দিচ্ছ! কোন্ রক্ষক তুমি? ইসলামকে রক্ষা করে চলছ! ইসলাম শান্তির বাণী নিয়ে এসেছিল পৃথিবীতে। ইসলাম সবকিছু শান্তির মাধ্যমে শেষ চায়। ইসলামের প্রচারক মুহাম্মদ (স) এবং প্রসারক একমাত্র আল্লাহ্। সুতরাং ইসলামকে যুগেযুগে রক্ষা করে আসছে আল্লাহ্ এবং রক্ষা করবেই আল্লাহ্। তা হলে? এক আল্লাহ্র তামাম দুনিয়ায় এক নবির আদর্শে এক ইসলাম চলুক।
* ইসলামধর্মতে কোনো কিছু অসুন্দর নেই, অসুন্দর থাকলে একপ্রকারের অন্ধত্ব।
* মৌলানা এবং মৌলবির মধ্যে অনেক তফাৎ দেখেছি আমি। যাঁরা মৌলানা তাঁরা ইসলামকে আকাশে স্থাপন করেছে। যারা মৌলবি তারা ইসলামের স্থান মাটিতেও রাখে নি? দুর্ভাগ্য তাদের, যারা সুশিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষায় বেশি অর্জন করে।
* মৌলবি আর মৌলোভীর মধ্যে পার্থক্য কী?
* যে কোনো মৌলানাকে খাটো করা ইসলামের পরিপন্থী। প্রত্যেক মৌলানাকে মান্য করা একজন মুসলমানের কর্তব্য; মনে করি, মুসলিমজাহান সেটা করে। কিন্তু এমন কিছু মোল্লামৌলবি আছে, যারা মৌলানা নামকে কলঙ্কিত করছে; তাদেরকে ব্যাহত করা প্রত্যেক মৌলানাদেরও দায়িত্ব।
* ইসলামের মান ক্ষুণ্ন করতে চায় কিছু সংখ্যক মুসলিম উগ্রকর্মা। তবে একজন প্রকৃত মুসলমান ইসলামের কটাক্ষপাত সহ্য কবরে না।
* নিজের নফসের প্রতি জেহাদ করা যায়, কিন্তু–শরীরের প্রতি নয়।
* একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান কোনো আততায়ীর সঙ্গে আঁতাত করতে পারে না। আর যে আঁতাত করে সে কখনো প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না।
* ধর্মের আঘাতে আমি এক শ’বার রক্ত ঝরাব। এবং একজন ধার্মিকের এটাই করণীয়, কিন্তু অন্যায়ভাবে নয় ন্যায়ের পথে…
* দেশ ও ধর্মের জন্যে জেহাদ করা কর্তব্য কিন্তু স্বার্থের জন্যে নয়।
* প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর কাছে ধর্মের চেয়ে বড় কিছু নেই। আবার এ-ই ধর্মকে আঘাত করছে কিছু সংখ্যক অনুসারী।
* একজন ধর্মপরায়ণ লোক কখনো ধর্মবিরোধিতা কাজ করতে পারে না।
* ধর্ম আমার নিজস্ব ব্যাপার। আমি পালন করলে পুণ্যবান, না করলে গুণাগার। আমার শাস্তির এবং মুক্তির মালিক একমাত্র আমার মনিব। কিন্তু তোমার কী অধিকার, আমাকে আখ্যাত করা অধর্মচারী-মুরতাদ?
* আমি ধর্মদ্রোহীর মনের বাণী শুনতে পাই
বিশ্বকে ভস্মিত করবে তারা দিয়ে ধর্মের দোহাই।
* অধার্মিক রাজার মন্ত্রী হওয়ার চেয়ে ধার্মিক রাজার গোলাম হওয়া অনেক উত্তম।
* জীব হোক অথবা অজীব প্রত্যেক কিছুরই একটি ধর্ম আছে, ধারা আছে, নীতি আছে। স্রষ্টা কোনো সৃষ্টির কপালে লিখে দেয় নি, তুমি এ ধর্মের অনুসারী। একমাত্র মানুষ যা ভাল মনে করছে সেটাই তার ধর্ম হয়েছে। ফুলনদী পশুপাখি যে যার ধর্মমতে চলছে এবং আবহমানকাল ধরে তাদের এধারা অপরিবর্তনশীল হয়ে অব্যাহত আছে। কিন্তু মানুষের ধর্ম যুগেযুগে সংঘাত ঘটিয়ে আসছে। মানুষ ধর্মকে বড় দেখিয়ে ভুলে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব এবং প্রতিটি মুহূর্তে হত্যা করে চলছে মানবতার। তাদেরকে মানুষ বলা যায় কিন্তু ধার্মিক বলা যায় না। প্রত্যেকটা ধর্ম শান্তির কথা বলে, সততার কথা বলে, মানুষের কথা বলে এবং মনুষ্যত্বের কথা বলে। তাই মনে করি, ইনসানিত থেকে বড় কিছু নেই–নাই কোনো ধর্ম। একমাত্র মানবধর্মই সবচেয়ে উপরে।
* রমজান মাস শেষের দিকে ঘনাইয়া আসিতেছে। নুরুদ্দিন কোম্পানির বাড়ির সামনে অতিরিক্ত লোকের ভিড় প্রতিনিয়ত জমিতেছে। প্রতিনিধিরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার বান্ডিল লইয়া বসিতেছে। জন প্রতি এক শত দুই শত হইতে পাঁচ শত করিয়া প্রদান করিতেছে। কাহারও কাহারও আবার হাজার করিয়াও দেওয়া হইতেছে। ইহা তবে দেখিয়াশুনিয়া। ক্রমান্বয়ে লোক বাড়িয়া চলিতেছে। ঠেলাঠেলি ধস্তাধস্তি হইতে গালাগালি ও হাতাহাতি অবধি অবতরণ করিতেছে। পদপিষ্ট হইয়া কতজন আহত হইতেছে, কতকজনের ভুজবাহুচরণ মচকিতেছে–ভাঙিতেছে তাহার হিসাব কে করে। কতজন মরিতেছে একমাত্র তাহার গণনা চলিতেছে! যাকাত প্রদান করিবার এই কেমন প্রবর্তন? ঈমান নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত এই পঞ্চ স্তম্ভে ইসলাম দণ্ডায়মান। নম্রত্ব সততা আখলাক শান্তি উদারত্ব মিলিয়া একজন মুসলিমের পরিচয়। আর এই-ই শান্তির ধর্ম আজ সবচাইতে অধিক অশান্তির রোষানলে জ্বলিতেছে–কেন?
* …অবাঞ্ছিত কিছু কথোপকথন নিয়ে একটু বোধহয় সমালোচনা করে ফেললাম? তাই উপরোক্ত অংশটুকু পাঠান্তে কোনো সুহৃৎবান্ধব আমাকে ধর্মবিদ্বেষী ভেবে চিহ্নিত করলে আমার প্রতি অবিচার হবে। কারণ আমি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। উচ্চবংশীয় সম্ভ্রান্ত এক মুসলিমপরিবারে আমার জন্ম। তাই ইসলামকে আমি খুব ভালবাসি এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। এটাই একমাত্র সত্য ও শান্তির ধর্ম মনে করি। তা হলে? এপ্রশ্নের ভিত্তিস্থাপন গড়তে গেলে অনেক নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। আমি মূর্খ–শেষপ্রান্তপথিকের দ্বারায় সেই আর সম্ভব নয়। এটুকুতে শুধু আমি মানবের কথা বলছি, মানবতার কথা বলছি, মানবসভ্যতার কথা বলছি এবং মানবধর্মের কথা বলছি। ধর্মের নামে রক্তারক্তি করে, জেহাদের আখ্যা দিয়ে মানবতাকে হত্যা করা সত্য বা শান্তির কর্ম হতে পারে না। আল্লাহ্র কসম–আল্লাহ্কে যে মেনে চলে, প্রকৃত ভালবাসে সে ধর্মের নামে দাঙ্গা বাঁধাতে পারে না। সরল মানুষদেরকে হত্যার কাজে লিপ্ত করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়। মানবাজ্ঞতার ইতিহাস দেখলেই দেখা যাবে, ধর্ম নিয়ে মানুষ কমবেশি বাড়াবাড়ি করে নি এবং ধর্ম নিয়েই মানুষের রক্ত পৃথিবীতে কমবেশি ঝরে নি। মানুষ শিক্ষাদীক্ষায় শিক্ষিত হয় অন্ধকারকে আলোকিত করতে–অন্ধকে পথ দেখাতে। তা হলে? ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা করা কোন্ ধরণের জেহাদ? আজ জঙ্গিবাদ বলে ইসলামকে খাটো করে দেখা হচ্ছে! এটি কি কম অপমানের বিষয়? কার দোষে আজ আফগান, ইরাক, বশনিয়া, ফিলিস্তিন সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে? বার দিনের শিশু থেকে আরম্ভ করে বার বছরের কিশোর-কিশোরী পর্যন্ত কেউ হত্যা হতে বাদ পড়ে নি! এ নিষ্পাপ সন্তানগুলোর কী অপরাধ ছিল? আবালবৃদ্ধবণিতা–এমন কোনো স্ত্রীলোক নেই ধর্ষণ হয়নি! হত্যা হয়নি! এ অবলা নারীদের কী অপরাধ? বাবরিকে ঘিরে হিন্দু-মুসলিমের এত ডাঙ্গার কারণ কী? মন্দির যদি আরাধনালয় হয়, মসজিদ কি তা হলে খোদার ঘর নয়? কার দোষে আজ ধর্ম বিতর্কিত? নিশ্চয় আমার মতো ধার্মিকের মুদ্রাদোষে? নাহলে চারি দিকে ইসলামের পতন কেন আজ? মুসলিমজাহান কেন আজ দলিত?
চলবে…