উটন দাদুর কাহিনী–পর্ব—৮(শিশু ও কিশোর বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
এবার একনাগাড়ে বুনোরা তীর ছুঁড়তে লাগলো। উটন দাদুদের নৌকোর আশপাশে এসে পড়ছিল সেগুলি। তীর ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা জোরে জোরে চীৎকারও করছিল। নৌকোর ওপরেও দু তিনটে তীর গিথে আছে। বুনাই,কুন্তা,নেচু,শমী ওরা সবাই উপুড় হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। ভয়ে ওরা জড়সড় হয়ে আছে।
নৌকো স্রোতের অনুকূলে ছুটে চলেছে। নদীর পার ধরে বুনোরাও ছুটে চলেছে–সে সঙ্গে ওরা তীরও ছুঁড়ে যাচ্ছে। খানিক সময় পরেই শন শন শব্দ করে একটা তীর এসে উটন দাদুর আঙ্গুলে বিঁধে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সে জাগায় চিন চিন করে ব্যথা করতে লাগলো। সে যন্ত্রণা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। উটন দাদুর বুঝতে ভুল হল না যে বুনোদের তীরের ফলায় বিষ লাগিয়ে রাখা আছে। শোয়া অবস্থাতেই উটন ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগিয়ে গেল তার ফার্স্ট এড বক্সের দিকে। সেটা থেকে জড়ি বুটির ওষুধ নিয়ে আঙুলে লাগিয়ে নিলো।
আঙুলের যন্ত্রণা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু বুনোদের তীর ছোঁড়া কমছিল না। ভীষণ রাগ হচ্ছিল উটনের। রাগে এবার সে চীৎকার করে উঠলো,বন্দুক হাতে নিয়ে বলে উঠলো,ওরে বুনোর দল,তোদের যদি মরার ইচ্ছে না হয়–তবে তীর মারা বন্ধ কর !
উটনের চীৎকারে কিছুই হলে না–আগের মতই সাঁ সাঁ শব্দ করেতে করতে তীর এসে নৌকায় ও তার আশপাশে পড়তে লাগলো। আর সহ্য করতে পারল না উটন.সোয়া অবস্থায় হাতে বন্দুক তুলে নিলো আর আকাশের দিকে তাক করে গুলি চালিয়ে দিল। গুড়ুম,শব্দ করে আকাশ চিরে সে গুলি বেরিয়ে গেল।
গুলির শব্দে এবার বুনোরা থমকালো,কিছু একটা আশঙ্কায় ওরা এ দিক ও দিক তাকিয়ে খানিক চুপ করে থেকে কি হল বোঝার চেষ্টা করল। এবার উটন বন্দুকের নল ঘুরিয়ে বুনোদের দিকে গুলি চালিয়ে দিল—গুড়ুম,আওয়াজ করে সে গুলি এবার বুনোদের মাথার ওপরের এক বড় গাছের ডালে গিয়ে লাগল। মড়মড় আওয়াজ করে সে ডাল ভেঙে পড়ল বুনোদের সামনে।
এবার আদিম বুনোরা ভয় পেল–বড় ডাল ভাঙা গুড়ুম আওয়াজের গুরুত্ব ওরা বোধহয় বুঝে গেল। পড়ি মরি করে নিজেদের বাঁচাতে ওরা নদীর পার ধরেই দৌড়াতে লাগলো।
কিছু সময় পার হয়ে গেল। বোঝা গেল বুনোরা ভয় পেয়ে দুরে পালিয়েছে। চার দিক নিস্তব্ধ। নদীর কলকল আর বাতাসের শন শন শব্দই কানে আসছিলি। এখনও যত দূর চোখ যাচ্ছে নদীর দু পার ধরে বালুচর দেখা যাচ্ছে। কিছু দূর দূর বড় দু একটা গাছ আর ঝোপঝাড়। দু তিনতে কুমীর বালিচরে শুয়ে আছে,ওরা বোধহয় দিনের শেষের শেষ রোদটুকু গায়ে মেখে নিচ্ছে ! নদী পথে চলতে চলতে ওরা অনেকবার কুমীরের দেখা পেয়েছে। নেচুর কাছে কুমির বড় ভয়ের ব্যাপার হয়ে গেছে। ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল।
উটন বলল,সন্ধ্যে হতে আর বেশী দেরী নেই। চল নৌকা ভিড়িয়ে আমরা বালুচরের শোভা খানিক দেখে নিই। ওই দুরের বালির ঢিবি থেকে দেখতে হবে ধারে কাছে কোন গ্রাম বা ঘর বাড়ি কিছু আছে কি না। আমার মানচিত্র অনুযায়ী কোন গাঁ তো এখানে দেখতে পাবার কথা !
সবাই ভয় পাচ্ছিল,আবার আনন্দও হচ্ছিল। শরীরে ও মনে ওদের ভয়ের শিহরণ জাগছিল,তবু ভাল লাগছিল,মন বারবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল।
নৌকা ভিড়ল বালির চরে। নেচু বেচারা চারদিকে তাকিয়ে হতাশা নিয়ে সবার দিকে চেয়ে থাকলো।
উটন দাদু ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,ভয় নেই,নেচু,আমরা বেশী দূর যাব না–পারের ওপর উঠে দেখব দুরে কোন লোকালয় আছে কি না !
ম্লান হাসল নিচু। ও বেশ সাহসী। নেহাত কুমীরের কামড়ে আজ সে পঙ্গু। তবু সে অনেক অনেক উত্সাহী। ও নিজের চোখে দেখতে চায় সব কিছু। যদিও জীবনের সংশয় এখন তারই সবচে বেশী।
যে বুনোরা কিছু সময় আগে উটন দাদুর বন্দুকের আওয়াজে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল তাদের আবার ফিরে আসার আশঙ্কা তো থাকতেই পারে ! তবু নেচু ভয়কে পেরিয়ে এক চমৎকারী আনন্দ পেতে চায়–সে আনন্দের শিহরণ ও শুয়ে শুয়েও অনুভব করতে পারে। ও নিজের মাথার কাছে বড় বড় দু দুটো ছুরি রেখেছে নিজের আত্মরক্ষার জন্যে।
চাপা আনন্দ,চাপা চীৎকারের মধ্যে দিয়ে উটন দাদু তার সঙ্গীদের নিয়ে নদী তীর ধরে ওপরে উঠে গেল। এদিকে গাছপালা খুব কম। বড় গাছ নেই বললেই চলে। মাঝে মধ্যে ঝোপ ঝাড় গজিয়ে আছে–অনেকটা মরুভূমির মত। এর মধ্যেই নবু,বুনাই,শমী আঙুল তুলে চীৎকার করে বলে উঠলো,ওই যে–ওই যে উটন দাদু,দুরে–অনেক দুরে,দু তিনটে ঘর দেখা যাচ্ছে !
উৎফুল্ল উটন তাড়াতাড়ি নদীর উঁচু পারে উঠে এল। ছেলেদের আঙুল লক্ষ্য করে দেখল,হ্যাঁ,ওই তো দুরে–অনেক দূরে লালাভ ধোঁয়াশার মাঝে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা ঘরের আদল। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় চারদিক রাগিয়ে আছে। দুরের অস্পষ্ট ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু তিনটে ঘর। কোন মায়াপুরির ঘন রহস্যময়তা দিয়ে ঢেকে রাখা সে গ্রাম–পটে আঁকা কোন ছবির মতই মনে হচ্ছিল।
ওদিকে নৌকো থেকে হঠাৎ নেচুর চীৎকার শোনা গেল,ও আঙুল দিয়ে কিছু দেখাতে চাইছিল। উটন ছুটে গেল নেচুর কাছে। উত্তেজিত হয়ে নেচু বলে চলেছে,দেখো দেখো দাদু,ঐ যে দুরে তিনজন লোক ছোটে পালাচ্ছে। মনে হয় ওরাই আমাদের তীর মারছিল।
সবাই নৌকোর ধারে এসে নেচুর কথা মত দুরের দিকে তাকাল। কুন্তা বলল,হ্যাঁ হ্যাঁ,ওই তো ওরা দৌড়াচ্ছে–ওদের হাতে তীর ধনুকও আছে !
উটনের চোখ হয়তো তত দূর ঠাওর করতে পরল না। তবু সবার কথা মেনে নিলো। সে বুঝতে পারল,তাদের বিপদের সম্ভাবনা অনেক কমে গেল। কারণ আক্রমণকারী যারা ছিল–যাদের হাতে তীর ধনুক ছিল তারা খুব ভয় পেয়ে গেছে। আরও একটা জিনিস উটন বুঝতে পারল যে ওই ধনুকধারী বুনোরা ওই বালুচরির দেখা ঘরগুলিরই বাসিন্দা হবে।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছিল। ওদের লক্ষ্যের জাগায় পৌঁছাতে আরও ছয় সাত ঘণ্টা লাগবে। উটন ঠিক করল আরও ঘণ্টা খানেক বালুচরি ঘাটে থেকে রাতের খাওয়া সেরে ওরা রওনা হবে কাসনি গ্রামের দিকে। ওখানে দিনে পৌঁছালে বিপদ–তাই মাঝ রাতের আশপাশে পৌঁছাতে হবে।
রাতে লন্ঠন জ্বলছিল তাতে সামান্য মাত্র জাগা আলোকিত হয়েছে মাত্র–চার দিকে ঘুটঘুট অন্ধকার। জলের কলকল ছলছল শব্দ শোনা যাচ্ছে—আর মাঝে মাঝে জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারের হবে উৎকট সব আওয়াজ ভেসে আসছিল। উটন আবার তার মানচিত্র খুলে ধরল আলোর সামনে। দেখল নোটে লেখা আছে বালুচরি তীরের কথা–তাতে ওই দুরের গ্রামের অবস্থানের কথাও লেখা আছে। এবার আসল যাত্রা শুরু হবার পালা। সেই ভয়ংকর গ্রাম কাসনি–যেখানে উলঙ্গ নরখাদকের বাস।
মানচিত্র দেখে মনে হল আর ছয় থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে যেতে পারবে কাসনিতে। সেখানের কোন জঙ্গলের পারে তাদের নৌকা ভিড়াতে হবে। এমন এক জাগায় নৌকা ভিড়াতে হবে যেখানে সচরাচর বুনোদের আনাগোনা নেই। মাঝ রাতে তেমন জাগা খুঁজে পাওয়াও বড় মুস্কিল।
রাতের খাওয়া সেরে আবার নৌকো ছাড়া হল। এবার যাত্রার উত্তেজনা আগের চে অনেক বেশী—এবার তো ওরা পৌঁছাতে চলেছে সেই কাসনি গ্রামে। ভাবতেই সবার মনে ও শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে!
ক্রমশ…