Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

অবরুদ্ধ শহরে একজন কিংবা অনেক পাগল

: | : ০৩/১১/২০১৩

মাঘ মাসের প্রচন্ড শীত। দুই দিন ধরে আবার শৈত্য প্রবাহ চলছে। কনকনে ঠান্ডায় হাত পা জমে যাবে যেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি ঢাকার সায়দাবাদ বাস স্টেশন এলাকার বড় রাস্তার একটি ফুটপাতে। এখানে রাস্তার পাশে রয়েছে সারি সারি বাস কাউন্টার। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় নানা কোম্পানির বাস। আমার গন্তব্য ফেনী। আশেপাশে আরও লোকজন আছেন। তারা কে কোথায় যাবেন কে জানে। ঘন কুয়াশায় খোলা আকাশের নিচে কনকনে শীতে শরীর গরম করার জন্য লোকজন সিগারেট খাচ্ছে অনবরত। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে আমার মাথা ধরে গেছে। বমি বমি লাগছে। কিন্তু ধোঁয়া থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। যেখানেই গিয়েই দাড়াই সেখানেই কেউ না কেউ সিগারেট ফুঁকছে। এজিনিসটা মানুষ কীভাবে যে খায় আমি বুঝতে পারি না। একটা চায়ের দোকান দেখে এককাপ চায়ের কথা বললাম। এসময় এরা খেজুরের গুর দিয়ে এক ধরনের চা বানায়। চা-টা ভালো হয়েছে তবে ঠান্ডা হয়ে গেছে। মনে হয় গুরটা ঠান্ডা ছিল।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। ঘন অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে শীতের রাতের প্রথম প্রহরটা। আমার ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। মনটা যেন তখন কিসের জন্য হাহাকার করতে থাকে। আজও এমন হচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আবার কেমন জানি এক ধরনের অপরাধ বোধ মনের মধ্যে কাজ করছে। মনে হচ্ছে এই জগৎ সংসারের প্রতি আমি অনেক অন্যায় করেছি। কী অন্যায় করেছি জানি না।
আমার এক কলিগ আছেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার। কিন্তু কখনও চেম্বার নিয়ে বসে প্রাকটিস করে নি। তবে প্রাকটিস নাকি তিনি করবেন চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর। তবে এখনও তার কাছে কেউ কোনো রোগের কথা বললে ছোট্ট একটা কাগজে ওষুধ লিখে দেন। একাজে তার বেশ উৎসাহ আছে। অফিসের বড় বড় বসদেরও দেখেছি তার কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র লেখিয়ে নিতে। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী পাইকারী হোমিও ওষুধের দোকান থেকে অনেক কম দামে ওষুধ কিনতে পাওয়া যায়। তো তার কাছে আমার সমস্যার কথা বলি একদিন। তিনি বলনেল ’এটা একটা মানসিক ব্যাধি।’ ছোট্ট একট টুকরা কাগজে ওষুধও লিখে দিয়েছিলন। খাওয়া হয় নি।
সকালেই ঢাকা এসেছিলাম একটা জরুরি কাজে। আমার ধারনাই ছিল না যে এমন একটা বিপদে পড়তে পারি। সেই বিকেল থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। কিন্তু কোন বাসই এখান থেকে ছেড়ে যাচ্ছে না। প্রথমে একটা আশা সবার মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন সবাই নিশ্চিত যে আজ আর বাস ছাড়বে না। ঢাকায় আমার কোনো নিকটাত্মীয়ও নেই যার বাসায় গিয়ে উঠতে পারি। আর যে কারণে বাস চলছে না ঠিক একই কারণে হোটেলগুলোও কোন বোর্ডার নিতে পারছে না। কারণটা হল রিরোধী রানৈতিক দলগুলো আগামি কাল “চল চল ঢাকা চল” নামে এটি কর্মসূচি দিয়েছে। আর সেই কর্মসূচিকে প্রতিরোধ করতে সরকার তার সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। মানুষ যাতে ঢাকয় আসতে না পারে তার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করে দেয়া হয়েছে। বাস, রেল, লঞ্চ কোনো কিছুই চলছে না। মানুষ যাতে আগে থেকে ঢাকায় এসে থাকতে না পারে তার জন্য ঢাকার হোটেলগুলো যাতে কোন বোর্ডার না নিতে পারে সে জন্য যা যা করা দরকার করে রেখেছে সরকার এবং সরকার দলীয় লোকজন।

কী করব ভেবে ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছি না। এদিকে ঠান্ডার সাথে ঘন কুয়াশা যেন আস্তে আস্তে বাড়ছে। পর্যাপ্ত শীতের কাপড়ও সাথে ছিল না। সিগারেটের ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য হাঁটতে হাঁটতে সায়দাবাদ থেকে মানিক নগরের দিকে অনেক দূর চলে এলাম। একটি চায়ের দোকান দেখে আর এক কাপ চায়ের কথা বললাম। এসময় একটি লোককে দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে কথা বলছে আর শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। লোকটির পরনে ময়লা প্যান্ট আর ময়লা জেকেট। লম্বা চুল দাড়িতে জট ধরেছে। চা খেতে খেতে লোকটিকে দেখছিলাম। নির্ঘাৎ রাস্তার পাগল। একটি কুকুর দেখলাম লোকটির সামনে কুৎ কুৎ আওয়াজ করছে আর মাঝে মাঝে লোকটরি গা ঘেষছে। মনে হয় ক্ষিধে পেয়েছে। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে লোকটি বলে উঠল, ‘ঐ বেটা কুত্তা গেলি না। তুইও তো দেখি শালা মানুষের মত শুরু করলি।’ লোকটার কথাটা আমার মাথায় ঢুকে গিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল অনবরত। চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে গেলাম লোকটার দিকে।
এদিকটায় মানুষজন তেমন একটা নেই। একেতো ঠান্ডা তার উপর উত্যপ্ত পরিস্থিতি। একটা দুইটা রিকসা টুং টাং শব্দ করে চলে যাচ্ছে। ‘চা খাবেন?’ জিজ্ঞেস করলাম লোকটিকে। প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে আছে মধ্য বয়সের পাগল মানুষটি। মনে হয় খাবে, যদিও মুখে কিছু বলছে না। রুটি,কলা আর চা নিয়ে দিলাম লোকটির হাতে। দুটি বন রুটি আর দুটি কলা দিয়েছিলাম। একটি রুটি নিজে খেল আর একটি রুটি কুকুরটিকে দিয়ে দিল। কলা দুটি নিজেই খেল। কে জানে কুকুর হয়ত কলা খায় না। কুকুরের হয়ত ভিটামিনের দরকার হয় না। রুটি কলা খাওয়া শেষ হলে হাতে থাকা পানির বোতলটি এগিয়ে দিলাম লোকটির দিকে। সবটুকু পানি খেয়ে বোতলটি ফেলে দিল। তারপর চা’টা খেল বেশ আরাম করে।
কাপ হাতে নিয়ে বিল দিতে গেলাম। চা ওয়ালা জিজ্ঞেস করে ‘ভাইজান কি বাস ধরতে আসছিলেন? বাড়ি কই ভাইজানের?’ ‘বাড়ি তো ভাইয়া ফেনী। বাস না পাইয়া তো ভাইয়া বিপদে পড়ে গেলাম’ – আমি উত্তর দিলাম। লোকটি খুশি হয়ে বলল, ‘আরে আমার বাড়িও তো ফেনী। ফেনীর ছাগল নাইয়া থানা।’ সে আরও বলে, ‘ভাইয়া এক কাজ করেন, বিশ্বরোড জনপথ মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান। দেখবেন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
চা দোকানদারের কথামত জনপথ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আস্তে আস্তে বাসের কাউন্টারগুলো সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আজ এবং কালও কোনো বাস ছাড়তে নিষেধ করা আছে তাই অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে কর্মচারিরা উৎসবের আমেজে আছে। রাত বাড়তে থাকায় এখন লোকজনও কমে এসেছে। ফলে সিগারেটের গন্ধও আর নেই। একদল টোকাই দেখলাম আগুন জ্বালিয়ে ঘিরে বসেছে। আমিও তাদের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। বেশ ওম পাচ্ছি। এত কষ্টের মধ্যেও পাগলের কথাগুলো মাথা থেকে যাচ্ছিল না। আমার মাথায় কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘ঐ বেটা কুত্তা গেলি না। তুইও তো দেখি শালা মানুষের মত শুরু করলি।’ ‘পাগলে কী না বলে’ এই ভেবে পাগলের কথাগুলো মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে চাইলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আমার মাথায় ঢুকে গেল আর একটি বাক্য, ‘আসলে কে পাগল, সেই লোকটি নাকি আমরা?’

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top