Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা শীতের পিঠাপুলি উৎসব ।

: | : ০৩/১১/২০১৩

 

সুখী দেশের তালিকায় এখনও আমার বাংলাদেশ শীর্ষস্থানেই । একারনেই আমরা অতিথী পরায়ন বললে খুব বেশী বাড়িয়ে বলা হবে না । ঘরে কিছুই নেই তবুও শীতের দিনে খেজুরের রসের ঝোলা গুড়ের আপ্যায়ন পাবেন না এমন পরিবার মনে হয় আমার গ্রাম বাংলায় নাই । কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমন ধানের উসবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও বাড়ি না যেয়ে থাকতে পারত না ।গ্রাম উসবের রঙে অঙ্কিত হত ।শীত আসলেই পিঠার দাওয়াত খাওয়ার জন্য বাড়ির সব ভাইবোনদের একত্রিত হওয়ার মেলা বসতো । সবাই একসাথে হওয়ার জন্যই যেন সারা বছর স্কুলের কঠোর নিয়ম পালন করা । ভাবতে ভাবতেই এসে যেত ডিসেম্বর । স্কুল বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই কখন ঝাপিয়ে পড়বো গ্রামের বুকে এই চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটানো ।

মনে পরে দাদী ভাপা পিঠা বানাত আর আমরা সবাই আগুন পোহাতে পোহাতে মুখে ভাপ তুলে অমৃত গন্ধে ভাপা পিঠার স্বাদ অবগাহন করতাম । শুধু কি ভাপা পিঠা, এর সাথে দুধের পিঠা, রসের পিঠা ,কুলি পিঠা আরও কত কি ….! চারিদিক হই হুল্লোরে ভরে উঠতো । ভাই বোনদের মধ্যে কেউ কেউ কারাকারি করে পিঠা নিয়ে ছুটোছুটি করত । আবার দেখা যেত পিঠা বানানোর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এ দেখে বাড়ির ছোট্ট ছেলে বা মেয়েটি সেদিন পিঠা খাওয়া বন্ধই করে দিত । সবচেয়ে আকাঙ্খিত মুখটিও পাশে বসে যখন পিঠা খাওয়া ভান করে গায়ে একটু স্পর্শ করে যেত সেই নরম স্পর্শ যেন আজও মনকে শিহরিত করে যায় । শাসন বাড়নের আষ্টে পিষ্ঠে বাধা সেই ক্ষনে তাকে রেখে আগে পিঠে খেয়ে ফেললে তো আর উপায়ই নেই !সেদিন আর হয়ত তার বা আমার কারোরই পিঠা খাওয়া হয় নি । রাতে দূর থেকে উড়ে ভাওইয়া পল্লীগিতি আর বাউল গানের সুর উসবে নতুন ছন্দ যোগ করত ।

মানঅভিমানে ভরা সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে ।তার আধো আধো ভাঙ্গা গলায় বলা ভালোবাসি শব্দটি যেমন শহুরে জীবনে আর জোনাকির আলো ছড়ায় না তেমনি পিঠা খাওয়ার সময় দাদীর আলতো বকুনি, মায়ের বেশী না খাওয়ার শাসন আর বাবার গানে না যাওয়ার বাড়ন ঝাপশা হয়ে আসে চোখের সামনে । বাস্তবতা আর পৃথিবীর এগিয়ে যাওয়া সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেদের বারবারই বেধে ফেলছি হোটেল পার্টি, পার্ক ভ্রমন আর শহুরে বন্ধ জীবনের শীকলে । ইট পাথরে থাকতে থাকতে মনের পরিবর্তনও লক্ষনীয় । গ্রামাঞ্চলে কিছুদিন আগেও একটি মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা শুনলেও শোকে কাটাত সারা গ্রামবাসী ।

 সেই বিখ্যাত উপন্যাস হাজার বছর ধরের কতগুলো চিত্র চোখের সামনে বার বার ভেসে ওঠে ।গ্রামে ওলা বিবি আসার পর সবাইকে নিয়ে ওলা বিবি তাড়ানোর যে প্রত্যয় দেখা গিয়েছিলো মকবুল বুড়া আর মন্তুর মধ্যে তা শুধু গ্রামীন সমাজের মেল বন্ধনই প্রকাশ করেনি প্রকাশ করেছিলো একসাথে বাঁচা মরার প্রত্যয়ও । এরকমই আমার গ্রাম বাংলা ছিলো মায়া মমতা আর ভাতৃত্বের বন্ধনের প্রতিক ।

 কিন্তু দুঃখ যে আমরা আমাদের হারিয়ে ফেলতে বসেছি । মা যদি ফোন করেও বলে বাবা আয় পিঠা খেয়ে যা চেহারায় যেন কেমন বিরক্ত লক্ষ করা যায় সন্তানের মধ্যে । মা অনুরোধ করতে পারলেও সন্তানের অপারগতা প্রকাশে কোন দ্বিধা নেই । তথ্য প্রযুক্তি আর আকাশ সংস্কৃতির নোংরা রাজত্ব অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাপ মানুষের জীবনকে দিনদিনই যেন যন্ত্রিক করে তুলছে । সবাই যেন কেমন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায় ।পারিবারিক বন্ধনের স্বাদে চরম ভাটা পড়েছে বর্তমান সময়ে । দুষতে গেলে দোষা যাবে অনেক কিছুকে । কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে আমরা আমাদেরই আত্নার আনন্দ হারিয়ে ফেলছি তা কি কখনও ভেবে দেখছি ।

নিজেদেরকে বাঁচাতে হলে আমাদের আবার সেই চর্চায় ফিরে যেতে হবে । পিঠা খাওয়ার মর্মার্থ শুধু খাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয় । এখানে যে পারিবারিক বোঝাপড়ার সৃষ্টি হত তা ছড়িয়ে পড়তো সমাজের সব প্রান্তে । বছরে অন্তত একবার হলেও সবার সাথে সবার দেখা হয়ে যেত । ভালোবাসার আকাঙ্খা বাড়তো । পুরনো মুখগুলোর নতুন ভঙ্গি নিজেকে হয়ত জীবনে আবার ছন্দে ফেরাতেও পারতো !

শহুরে জীবনে হতাশার শেষ নেই । ভালোবাসায় হতাশা, ভালোলাগায় হতাশা, হতাশা প্রিয় মানুষের আচরনেও ! এত হতাশার পর নিজেকে ফিরে পেতে সবুজের সঙ্গই আপনাকে দিতে পারে মানুষিক প্রশান্তি । শীতের কুয়াশা ভরা সকালে একদিন মনের আনন্দে সবার সাথে বসে পিঠা খেয়ে দেখুন আপনার সব হতাশা অন্তত ৬০ ভাগ কমে যাবে । বাউল গানের মিষ্টি সুর আপনার হৃদয়কে প্রশান্ত করবে ।

শুধু নিজের স্বার্থেই নয় পরবর্তি প্রজন্মকে নিজের সংষ্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াও আমাদেরই কর্তব্য । পিঠা খাওয়ার আনন্দে শীত বয়ে আনুক সকলের জীবনে নান্দনিক বাঙালী সাংস্কৃতির ছোয়া । শুভেচ্ছা রইলো ।   

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top