পারিবারিক নির্যাতন, আড়ালে হলেও ভয়াবহতা স্পষ্ট ।
বাবা মায়ের প্রচন্ড ঝগড়া হচ্ছে । ঝগড়ার কারন তেমন গুরতর নয় । কিন্তু তাদের ঝগড়ার ধরনে মনে হচ্ছে যেন আর একসাথে থাকাই হবে না তাদের । ঘরের ছোট্ট শিশুটি একবার বাবার কাছে যাচ্ছে আবার মার কাছে । দুজনেই বলছে তুই এখন থেকে আমার কাছে থাকবি । নিচু মনা মানুষের কাছে থাকলে তুই জীবনে মানুষ হতে পারবি না । শিশুটিকে ধরে টানা হেচনা করার পর সে যখন দেখতে পায় ঝগড়ার তীব্রতা আরও বাড়ছেই তখন সে ঘরের এক কোনে লুকিয়ে ভয়ে কাপতে থাকে…………… ।অতঃপর কি হতে পারে ? হয়ত তার বাবা মা দুজন একসাথেই থাকবেন কিন্তু বাচ্চাটার মানুষিকতা ? বা যে স্বামী বা স্ত্রী প্রতি রাতে নির্যাতিত হচ্ছে তার মানুষিক অবস্থা ? আমরা নির্যাতনের ভয়াবহতা অনুভব করতে পারি কিন্তু স্পর্শে পাই না ।
সামাজিক গতিশীলতার কারনে পারিবারিক জীবনও পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত ।কিন্তু এ পরিবর্তন পারিবারিক জীবনে যদি মানুষকে অস্থির করে ফেলে তবে তার প্রভাব সমাজে পড়তে সামান্য সময়ের অপেক্ষা মাত্র । একদিকে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ চলাচল অন্যদিকে মানুষের অর্থনৈতিক কারনে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় আত্নার দূরত্ব কমছে অনেক খানি । যার কারনে পারিবারিক ভাবে শহরাঞ্চলে একটি দূরত্ব তৈরী হয়ে যাচ্ছে একে অপরের মাঝে ।সন্তানেরা বাবা মায়ের খোঁজ রাখতে পারছে না, স্ত্রীকে সময় দিতে পারছে না, হয়ে উঠছে না সন্তানকেও সময় দেওয়া । এভাবেই হয়ত একদিন ভুল বোঝাবুঝি থেকেই কলহ শুরু হচ্ছে । কলহ থেকে নির্যাতন । মানুষিক নির্যাতন, দৈহিক নির্যাতন এবং সর্বপরি জীবন বোধের উপর নির্যাতন । নির্যাতনের হাজারো প্রকার হয়ে থাকলেও যে কোন নির্যাতনের কারনেই মানুষের মৌলিক আত্না ধ্বংশ হয়ে যায় ।আমরা যে নির্যাতনগুলো দেখি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিলক্ষিত নির্যাতনে দেখা যায় নারীদের নির্যাতিত হওয়ার ভাগই বেশী । এমন কি এই নির্যাতনে নারীদের মৃত্যুর ভাগ প্রায় ২০ শতাংশ । আমার নিজের একিট গবেষনায় দেখেছি প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ শতাংশ নারী প্রতিদিন ঘরে কোন না কোন কারনে নিজেদের পরাধীন মনে করে । এটা হতে পারে নিজেদের স্বকীয় কাজে তার স্বামীর বাঁধা বা সন্তানকে লালন পালনে নিজেদের কিছু ব্যর্থতা শুধু স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দেওয়া অথবা যৌতুকের মত ভয়ানক কারন । এছাড়াও একজন স্ত্রীর সবটুকু চাওয়া পরিবারকে দেওয়ার হীনমন্যতাও একটি নারীকে মানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হিসবে বেছে নেয় ।শুধু তাই নয় নারীরা স্বামী হারালেও রক্ষা নেই । একা থাকা যাবে না । আবার বিয়ে দিতে হবে । নইলে সমাজ তাকে ধিক্বার জানাবে, কলঙ্ক দেবে । হয়ত একারনেই একজনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতেও বাঁধা । তাই বাড়ির ছোট বা বড় ছেলের সাথে আবার বিয়ে । নিজের সবটুকু স্বাদ, আরেকজনের আত্নার উপস্থিতি সব বিসর্জন দিয়ে নারীকে ঐ বাড়িতে আরেক জনের সজ্জা সঙ্গী হিসাবে জীবন কাটাতে হয় ।
কণ্যা শিশু, যে জন্মগ্রহনের পাঁচ থেকে ছয় বছরের মাথায়ও পরিবারের কোন নিকট আত্নীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয় । শিশু সুলভ আচরনের বিপরীতে সে দেখে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ যা জীবনে তাকে ঘর বাঁধতে বার বার নিজের কাছে প্রশ্নের সম্মুখ্খীন করে । এভাবেই একটি শিশুর মনে সারা পুরুষ জাতির উপর ক্ষোভ চলে আসে । তেমনি কোন মেয়ে বিয়ের পর যদি শ্বাশুরী বা ননদী দ্বারা নির্যাতীত হয় তবে …………। তখন সব মেয়ে জাতিকেই মনে হয় এরা বুঝি শুধু নির্যাতন কারি-ই । এজন্যই নির্যাতন যেভাবেই, যার দ্বারাই সংগঠিত হোক তার ভয়াবহতা, ফলাফল সমাজের জন্য অনেক ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায় ।
প্রথম যে নির্যাতনের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তা ছিলো একটি শিশুর বাবা মায়ের দ্বারা মানুষিক নির্যাতন । শেষে দেখা গেলো পরিবারের যে কেউ যে কোন মানুষের মানুষিক বা শারীরিক নির্যাতনের কারন হতে পারে । আর এই নির্যাতন গুলোর সুস্পষ্ট ফলাফলের কারনে মানুষ পরিবার মুখীতা হারাচ্ছে । স্বামীরা বাইরে সুখ নিতে গিয়ে অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্কে জরাচ্ছে, স্ত্রীরা সময় কাটানোর জন্য বা নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য ঘর ছাড়ছে বা নতুন স্মপর্কে জরাচ্ছে, সন্তানেরা হয় নেশা গ্রস্থ হচ্ছে বা একা একা থেকে জীবনকে হতাশ করে আত্নহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অথবা সন্ত্রাসী হিসবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে । সব কিছুর ফলাফল একটিই তা হলো ভেঙ্গে চুরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সমাজের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান পরিবার প্রথা।
পারিবারিক নির্যাতন আক্ষরিক অর্থে বলা যেতে পারে-কোন মানুষ যে ঐ পরিবারের সদস্য সে পরিবারে কোন কারনে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং তার স্বতস্ফুর্ততা বিনষ্ট হয় অথবা নিগৃহিত হয়, তাই পারিবারিক নির্যাতন ।
কিন্তু কখন এই সঙ্গার বাইরে আমরা যেতে পারি । যখন আমরা একে অপরে বুঝতে পারবো যে পরিবার একটি সবচেয়ে বড়, গ্রহনযোগ্য, শক্তিশালী এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ।আর এজন্য যৌথ পরিবার কাঠামো বড় ভূমিকা পালন করতে পারে । যদি একে অপরের বোঝা পড়া, একসাথে থাকার মন মানুষিকতা এবং পারিবারিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা যায় তবে সুশিক্ষিত যৌথ পরিবার কাঠামো সমাজে পারিবারিক নির্যাতন কমাতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে । আমাদের এই পথে আগাতে হবে । বিকৃত মানুষিকতা গুলো দূর করতে ধর্মীয় মূল্যবোধ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে । বৃদ্ধদের পরিবারে অনেক বেশী প্রয়োজন । কারন তারা আমাদের চেয়েও অনেক জ্ঞানী । তাদেঁর সারা জীবনের বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পরিবার প্রথাকে আরও শক্তিশালী করা আমাদেরই দায়িত্ব । আমরা পারিবারিক নির্যাতন থেকে মুক্তি চাই । কারন এর প্রভাব পারিবারে নির্দিষ্ট না থেকে সারা দেশে প্রতিফলিত হয় । যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে । তা আমাদের কখনই কাম্য নয় ।
আসুন যত্ন করি পরিবার,
দেশের মেধা হবে উর্বর ।