প্রিয়ন্তী-১৮ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)
একটি তিনতলা বাসার তৃতীয় তলায় একটি তিন কক্ষ বিশিষ্ট বাসা পাওয়া গেল। দুইটি বেড রুমের সঙ্গেই একটি করে এটাচ্ড বাথ, একটি করে বারান্দা, পুরো বাসার জন্য একটি ড্রয়িং রুম এবং একটি কিচেন আছে। ড্রয়িং রুমটা দুই পরিবারকে শেয়ার করে ব্যবহার করতে হবে, ঠিক ডাইনিং স্পেসটা এবং কিচেনটাও তাই। বাসার ধরণ দেখে যে কেউ মনে করবে যেন বাসাটা শেয়ার করে থাকার জন্য ছোট পরিবারের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। বাসাটা প্রিয়ন্তীর খুব পছন্দ হয়েছে, তিথিরও।
বাসায় থাকতেই প্রিয়ন্তী সুশান্তকে মোবাইল করল, এই শুনছ?
বলো?
একটা বাসা পাওয়া গেছে, বাসাটা আমার খুব সুন্দর লেগেছে, তোমারও খুব পছন্দ হবে।
বেশ তো, তিথির সঙ্গে আলাপ করো।
তিথিরও খুব পছন্দ হয়েছে সে টাকা এ্যাডভান্স করতে বলেছে।
তুমি টাকা নিয়ে গেছ?
না, তিথিই টাকা এ্যাডভান্স দিবে আমাদের পরে দিলেও হবে।
ঠিক আছে কনফার্ম করে ফেলো।
তিথি প্রিয়ন্তীর কাছ থেকে শুনে এক মাসের টাকা এ্যাডভান্স করে করল। ভাড়া আড়াই হাজার টাকা।
দিলীপ ধনী লোকের ছেলে, তার মনটাও বেশ উদার। সে নিজে থেকে বলল, সুশান্ত তোমাদের এক হাজার টাকা দিলেই হবে। আমরা দেড় হাজার টাকা দিব, তুমি কি বলো তিথি?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
প্রিয়ন্তী এবং সুশান্ত কিছুটা লজ্জিত হলো, তারা বুঝতে পারল দিলীপ আর তিথি তাদের করুণা করছে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না।
মাসের এক তারিখে নতুন বাসায় উঠল। দু’জনে তাদের মেস থেকে বিছানা বালিশ নিয়ে গিয়ে বিকেলে বাজারে বের হলো, বাজার থেকে একটা খুব কম দামি চৌকি, কিছু থালা-বাসন আর কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল। নতুন সংসার, হাভাতে সংসার, টাকা-পয়সার অভাবে তেমন কোন জিনিসপত্র কেনা হয়নি কিন্তু তাদের দু’জনের মধ্যে যেন না পাওয়ার কোন অতৃপ্তিওনেই।
তিথি আর দিলীপ বাসায় ফিরল আরো একটু বেশি রাতে। তারা বিয়ের সময় অনেক কিছু জিনিসপত্র পেয়েছে সামান্য কিছু যা কেনার ছিল তাও আজ কিনে নিয়ে এসেছে। সবকিছু কোন রকমে বাসায় তুলতেই তিথি হাঁপিয়ে উঠেছে। সে ডাইনিং স্পেসে সবকিছু এলোমেলো করে রেখেই প্রিয়ন্তীর রুমে এসে হাঁফ ছেড়ে বসল, ওহ্ ক্লান্ত হয়ে গেলাম রে।
বস, এক গ্লাস জল দিই।
না, থাক লাগবে না, একটু বিশ্রাম নিই।
প্রিয়ন্তী মৃদু কণ্ঠে বলল, তোদের তো অনেক কিছু আছে আমরা তো না পেলাম কোন পক্ষ থেকে, না পারলাম নিজেরা কিনতে।
ও নিয়ে তুই কিছু ভাবিস না, আমার সবকিছু তুইও ব্যবহার করবি, এই যে আমাদের ফ্রিজ সেখানে তুইও মাছ-মাংস রাখতে পারবি, আমরা একসঙ্গে বসে টি.ভি দেখব।
কৃতজ্ঞতায় প্রিয়ন্তীরকণ্ঠস্বরবুজে এলো, দু’চোখ ছল ছল করে উঠল, তিথি তুই খুব ভালো রে।
সুশান্ত এতক্ষণ বাথ রুমে ছিল, এবার বের হয়ে বলল, তিথিকে কিছু খেতে দিয়েছ?
প্রিয়ন্তী একটু অপ্রস্তুত হলো, ও তাই তো।
তিথি প্রিয়ন্তীর হাত চেপে ধরল, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার রুমে গেল।
সামান্য চাল, ভাগাভাগির চুলো নিয়ে সুশান্তর কিছু গচ্ছিত টাকা নিয়ে প্রিয়ন্তী আর সুশান্তর সংসার শুরু হলো। তারপর সুশান্তর শুরু হলো একটা চাকরি জোগাড় করার পালা, চাকরি তো নয় কাজ বললেই হয়। প্রায় মাসখানেকের মধ্যে একটা কোচিং সেণ্টারে সুশান্তর চাকরি হলো, আগামী মাসের এক তারিখ থেকে যোগদান করতে হবে। বেতন যৎ সামান্য যা দিয়ে না চালানো যাবে সংসার, না বলা যাবে কোন আত্মীয়-স্বজনকে। দুজনেই ইংরেজিতে অনার্স, সুশান্তর একবার ইচ্ছা হলো প্রিয়ন্তীকে কোচিং সেণ্টারে চাকরি করতে দিয়ে নিজে বাইরে একটা বা দু’টা প্রাইভেট টিউশনি করলে তাদের দিন হয়ত কোনমতে চলে যাবে কিন্তু কোচিং সেণ্টারের তাতে আপত্তি না থাকলেও পরক্ষণেই সুশান্ত তার মত পাল্টালো। কারণ কোচিং সেণ্টারের অধিকাংশ শিক্ষক তরুণ, তাদের মধ্যে প্রিয়ন্তীকে চাকরি করতে দিতে তার বুক যেন কেঁপে উঠল।
তাদের বিষয়টা অনেক বন্ধু-বান্ধবকে বলা ছিল। ক’দিনের মধ্যে একটা প্রাইভেট টিউশনি যোগাড় হলো। ক্লাস ওয়ানের একটা বাচ্চাকে বাসায় গিয়ে পড়াতে হবে। বাড়ির কর্তা-গিন্নী দু’জনে পেশায় ডাক্তার, বেতন নির্ধারিত হলো দু’হাজার টাকা। কিন্তু তারা চায় শিক্ষয়িত্রী।
সবকিছু শুনে সুশান্ত খুশি হলো। আগামী মাসের এক তারিখ থেকে পড়াতে হবে। রাতে সুশান্ত আপন মনে হিসেব করতে শুরু করল, তোমার বেতন দু’হাজার টাকা আর আমার বেতন দেড় হাজার টাকা মোট সাড়ে তিন হাজার টাকা।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, কী হিসেব করছ?
আমাদের দু’জনের ইনকাম সাড়ে তিন হাজার টাকা, সাড়ে তিন হাজার টাকায় সংসার চালাতে পারবে তো?
প্রিয়ন্তী ধীর শান্ত কণ্ঠে বলল, পারতে হবে।
আমার তো শুধু একবেলা ডিউটি, আরো দু’য়েকটা টিউশনি পেলে আমি করব। তখন আরো কিছু ইনকাম বাড়বে।
তখন খরচও বাড়বে না?
সুশান্ত বুঝতে পারল না, মানে?
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে আস্তে আস্তে বলল, ঘরে নতুন মুখ আসবে না?
দু’জনে হেসে উঠল।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরল।
তিথি জোরে ডাক দিল, এই প্রিয়ন্তী, এত হাসাহাসি কীসের হচ্ছে রে?
প্রিয়ন্তী নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো, এই ছাড়ো, ছাড়ো।
তিথি আর প্রিয়ন্তীর মধ্যে খুব মিল। প্রায় সব কথা দু’জনে শেয়ার করে। তিথির ডাক শুনে প্রিয়ন্তী ঘর থেকে বের হলো, কী রে ডাকছিস কেন?
টি.ভি’তে একটা ভালো নাটক হচ্ছে, দেখবি আয়।
প্রিয়ন্তী আর সুশান্ত নাটক দেখতে চলে গেল।
তিথি আর দিলীপ প্রথমে প্রেমে পড়ে তারপর উভয়ের বাবা-মা আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দিয়েছে। বিয়েতে একটা বাসার জন্য প্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র দিয়েছে সেগুলো তিথি তার শ্বশুরবাড়ি রেখে এসেছে, এখন যেটা প্রয়োজন পড়ছে সেটা তার শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসছে। তাদের সংসারের এক রকম সব জিনিস আছে। তাছাড়া তিথির মা প্রায় দিনই মোবাইল করে, তার শ্বশুরও তাকে খুব স্নেহ করে মাঝে মাঝে মোবাইল করে খোঁজ-খবর নেয়।
কথায় কথায় তিথি দিলীপকে ধমক দেয়, দেখো কিন্তু আমাকে কিছু বললে বাবাকে বলে দিব।
বাহ আমার বাবার কাছে তুমি কমপ্লেইন করবে আমার বিরুদ্ধে?
হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয়ই জানো তোমার বাবা আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করে। আমি কোন কমপ্লেইন করলে কাজ তো হবেই। তারওপর আমি যদি একটু কান্নার অভিনয় করে মোবাইল করি তবে এসে হাজির হবে।
দিলীপ তিথির কাঁধে হাত দিয়ে আদর করে বলে, লক্মী সোনা কমপ্লেইন করো না, আমাকে একটু ভালো থাকতে দাও।
তিথি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। থাক আর বলতে হবে না।
দিলীপ আর তিথির সুখ দেখে প্রিয়ন্তীর হিংসে হয় না, মনটা জুড়িয়ে যায়। সে এমন একটা জীবন আশা করেছিল। আসলে স্রষ্টা মানুষের সব আশা পূরণ করে না।
সুশান্ত আর প্রিয়ন্তী তাদের ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং স্পেস থেকে তিথিকে ডাক দিল, এই তিথি আসবো?
চলে আয়।
সবাই এক সঙ্গে টি.ভি দেখল।
বাড়িওয়ালা ভালো মানুষ, তাদের একটা চিলাকোঠার চাবি দিয়েছে। দিনের বেলা কখনো কখনো তারা ছাদে কাপড় শুকাতে দেয়। ছাদে উঁচু প্যারাপেট আছে সহজে পড়ে যাওয়ার আশংকা নেই। ছাদের ওপর টবে কিছু গাছ লাগানো আছে। মাঝে মাঝে ফুল ফোটে, সুগন্ধ ছড়ায়।
প্রিয়ন্তী ছোটবেলা গান শিখেছে, তারপর আর প্র্যাকটিস করা হয় না। তবে সে মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গায়। সুশান্তকে দেখে লজ্জা পায়, গান বন্ধ করে। তারপর সুশান্তর শত অনুরোধেও আর গায় না আবার যখন বাসায় একা থাকে তখন গান গায়।
জোৎস্না প্রিয়ন্তীর খুব প্রিয়। মাঝে মাঝে জোৎস্না রাতে দু’জনে ছাদে যায়। গল্প করে, আড্ডা দেয়। কোন কোন দিন তিথি আর দিলীপও ছাদে যায় তবে তিথির ঘুম বেশি, অনেকদিন পর হয়ত একবার যায়। প্রিয়ন্তীদের ঘরটা দক্ষিণ দিকে, দক্ষিণে একটা জানালা এবং একটা বারান্দা আছে। বারান্দায় জোৎস্না খেলা করছে, দেখে প্রিয়ন্তীর খুব ছাদে যেতে ইচ্ছা করছে। সে সুশান্তকে দু’বার বলল, এই চলো না, আজ খুব ভালো জোৎস্না হয়েছে।
সুশান্তরও আগ্রহ আছে কিন্তু সে আজ প্রিয়ন্তীর গান শুনতে চায়। তাই সে বলল, তুমি বারান্দায় গিয়ে জোৎস্নায় স্নান করে এসো, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
প্রিয়ন্তী একটা চিমটি কেটে বলল, এখন কেবল রাত দশটা বাজে, তুমি কোনদিন এত আগে ঘুমাও না। জোৎস্না দেখে আমি ছাদে যেতে চাইবো তাই ঘুমানোর ভাব দেখাচ্ছ, না? ওঠো।
সুশান্ত কৃত্রিম জড়ানো গলায় বলল, বাদ দাও তো, আজ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
তোমার ঘুম পাচ্ছে, না? আমি আজ তোমাকে প্রথম দেখছি, তুমি রাত দশটার সময় ঘুমানো মানুষ? ওঠো।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর একটা হাত টেনে ধরল, উঠবো তবে একটা শর্ত আছে?
বলো।
একটা গান শোনাতে হবে।
আমি গান গাইতে পারিনা তো।
যেভাবে পারো, সেভাবেই গাইতে হবে।
আচ্ছা চলো।
চলবে…