অনিবার্য কারন
বাংলাদেশে আমাদের জীবন অনেকটা ৮০ দশকের বাংলাদেশ টেলিভিশনের সম্প্রচারের মতই। ধরুন পরিবারের সবাই মিলে এই সব দিনরাত্রি দেখছেন, কোনও একটা শ্বাষরুদ্বকর মুহুর্তে যখন কোলের বাচ্চাটাও কান্নাকাটি বন্দ্ব করে বড়দের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে, হঠাত করেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট মানে লোডসেডিং আর কি! চিৎকার করে বাচ্চাটা কান্না শুরু করে দিল যেনও এতক্ষন নাটক ওই দেখতে ছিল। মাথার উপরে বাড়ীর হয়তো একমাত্র সিলিং ফ্যান বন্দ্ব, সুতরাং গরমে সিদ্ব। যদিও নাটক চলাকালে অতিরিক্ত দর্শকের কারনে একটি মাত্র ফ্যান ঘরটাকে তেমন একটা ঠান্ডা করছিল না তবুও চলছিলতো! মনো্যোগটাও তো একটা গুরুত্বপুর্ন ব্যাপার। অথবা হয়তো লোডসেডিং নয়, হঠাত তীক্ষ টু……………শব্দ, কানের বারটা। কিছুক্ষন পরেই টিভি স্ক্রীনে “বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারনে সম্প্রচারে সাময়িক বিঘ্ন ঘটায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত” অথবা “অনির্বায কারনে…।“
বাংলাদেশ টেলিভিশন কত্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধণ্যবাদ, প্রচার স্বাভাবিক রাখতে না পারুক অন্ততঃ বিজ্ঞপ্তি করে দুঃখ প্রকাশ করার জন্য।
কিন্তু দেখুন, আমাদের প্রাত্যহিক জীবন, আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবন। ঘটনা পুর্ব বা পরবর্তী কোন বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই একের পর এক চমকপ্রদ জীবননাশী ঘটনা ঘটেই চলেছে। আর আমরাও বলতে গেলে একপ্রকার নীর্বিকার। উধাহরণতো একটা দিতেই হয়। দেশে প্রায় দেড় ডজন স্যাটেলাইট টিভি আছে, আছে অসংখ্য প্রিন্ট মিডিয়া যারা নাকি সাধারণ জনগনের কণ্ঠস্বর। আমরা কতটূকু জানতে পারছি রানা প্লাজার মালিকের বিচারের অগ্রগতি যার লোভের কারনে ১১২৭ জন মানুষ রোজ-কেয়ামতের মত এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। মাঝে মাঝে দুএকটি পত্রিকায় তবু বিশ্বজীতের খুনীদের পক্ষে নির্লজ্জ কিছু উকিল কিভাবে জীবন দিয়ে লড়ে যাচ্ছে তা জানা যায়। আসলে কোন এক জনকে দায় দেয়া মুশকিল। সহজ ভাবে যে কোন ভাবে উন্নয়নের ফলাফল এরকমই হয়। আর আমরা যারা সাধারণ মানুষের তকমা বুকে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি তাদের কাছে এখন যে কোনও ঘটনাই সাধারণ ঘটনা তা দুর্ঘটনাই হোক আর আনন্দের ঘটনাই হোক। তবে আনন্দের ঘটনাতো আর তেমন একটা নেই যাও ছিল তাও আবার আমাদের ঊদীয়মান ক্রিকেটারদের জন্য ধীরে ধীরে নাই হয়ে যাচ্ছে। আগে কদচিত জিততো আর এখন নিয়মিত জিতা শুরু করেছে, জিতার বিষয়টাকেও একেবারে সাধারন পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছে।
বিজ্ঞপ্তির কথা বলছিলাম। ধরুন আপনি কোন একটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, সামনে কোথাও হয়তো কাটা-কাটি-খড়াখুড়ি উন্নয়ন কাজ চলছে। কতৃপক্ষের যদি দয়া হয় তাহলে হয়তো ঐ পর্যন্ত পৌছানোর পরেই দেখতে পাবেন, “ঊন্নয়নের কাজ চলিতেছে, সর্ব সাধারনের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত”। আসলে ততটা আন্তরিক আমার মনে হয়না কারন আন্তরিক হলে বিজ্ঞপ্তিটা রাস্তার শুরিতেই দেয়া যেত, আরও কত ভাবে মানুষকে জানানো যেত, যাতে তাকে এই পর্যন্ত এসে হাবিয়া দোজখের যন্ত্রনায় পড়তে না হয়।
আগামীকাল হয়তো আপনার সন্তানের সমাপনী পরীক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা আজ কোনও মহিরুহকে পুলিশ আটকালো বা মারামারি করে কেঊ খুন হয়ে গেলো ব্যাস অনিবার্য কারন বশতঃ পরীক্ষা স্থগিত। পরবর্তী তারিখ পরে জানানো হবে। আজকাল অবশ্য মূঠোফোনের কল্যানে খবরটা চাউড় হতে বেশী সময় লাগে না। তবে আবার কোন কোন অধিকারী এতই কঠিন যে কোন অবস্থায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা পিছাতে একদমই রাজী নন। কিভাবে তুমি আসবে বাছা তা তোমার বাবামায়েরই দায়িত্ব, পথে তোমার গায়ে কেউ আগুন দিলেও শ্রদ্বেয় অধিকারীর কিছুই যায় আসে না। আর এই অনিবার্য কারন গুলি হতে পারে যে কোন কিছু… তবে অবশ্যই ধন্যবাদ মুঠোফোন।
আপনি হয়তো মটর সাইকেল চালান, কখনও সখনও তাড়াহূড়া করে সকালে ঘর থেকে বের হয়েছেন। কিন্তু বিধিবাম! আপনার মোটরসাইকেলটি স্টার্ট নিচ্ছে না, রাতেও কিন্তু সুন্দর স্টার্ট নিয়ে ছিল।তবুও ভাল, দ্রুতলয়ে পথে নেমে কোনও সি এন জির হাতে পায়ে ধরে পাচ গুণ বেশী ভাড়া দিয়ে কিছুটা দেরী করে আর পকেটের বারটা বাজিয়ে অফিসে পৌছলেন। আজকালতো অফিসে দেরী করার জন্য চোখ রাংগানীর সাথে মাস শেষে বেতন কাটার ব্যাবস্থাও বেশ আধুনিক আর ডিজিটাল। । তার সাথে বসের কাছে বিরাগভাজন হওয়া এক্কেবারে ফ্রি। এই সবই শুধু নিজের প্রানপ্রিয় মোটরবাইকটা ঠিক সময়ে স্টার্ট না নেবার জন্য। কিন্তু যদি পথে বের হয়ে চেন ছিড়ে তাহলে কি অবস্থা হবে বুঝুন।
ব্যাক্তিগত জীবনে সামান্য দেরী হলে তার ফলাফল যদি এতোটা ক্ষতিকারক হয় তবে ভাবুন রাষ্ট্রীয় বিষয়ে এই রকম কার্যক্রমের ফলাফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
কিছু ছাত্র আছে বেশ মেধাবী, কিন্তু পড়ে না। পড়া লেখা নিয়ে সময় নষ্ট করার চেয়ে আরো অনেক গুরুত্বপুর্ণ বিষয় তাদের জীবনে বিদ্যমান। তবে মাথায় বাজ পড়ে পরীক্ষার মাস দুই আগে। তখন খালি সিলেবাস আর সাজেসন খোঁজা। প্রথম প্রথম ভেবেছিলো এই পড়া আর কি! দুই মাস পড়লেই স্টারমার্ক না হোক ফার্স্ট ডিভিশন তো চক্ষু বুজিয়া নিশ্চিত। দিন কাটতে থাকে আর সেই আত্ববিশ্বাষ কোনরকম পাশ মার্কে গিয়ে ঠেকে অবশেষে। একেক সময়তো মনে হয় পলাই, পাশ না করলে মুখ দেখাবো কি করে!! কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী কিছুটা সময় যদি সময়মত দেয়া যেত পলানোর চিন্তা হয়তো করতে হতো না।
দেখুন আমাদের রাজনীতি, যেন সব খেলা শেষ তিন মাসে। আজকে আমরা যে সমস্যার মাঝ দিয়ে দিনাতিপাত করছি সেটা কেন গত তিন বা চার বছরে মীমাংসা করা হয়নি? কিসের জন্য আলাপ-সালাপ আটকে ছিল? নির্বাচন কিভাবে হবে তা কেন এতদিন ধরে ঝুলে ছিল? নাকি দিন-ক্ষন সব হিসাব করেই সব পক্ষ চুপ করে ছিল? কারন পাচ বছর ব্যাবসা বানিজ্যের সময়, আমদানীর সময়, দুঃখিত মিলে মিশে আমদানীর সময়! শেষ সময়ে জিম্মি সাধারণ মানুষ। এদেরকে পুড়িয়ে মারা যাবে, গুলি করে মারা যাবে, একে অপরকে বেশ জুতসই গালি দেয়া যাবে। আর একটু যদি মনযোগ দিয়ে দেখা যায় যে মারছে আর যে মরছে সবাই সমাজের মোটামুটি কাছাকাছি শ্রেণীরই নাগরিক, সে আপনি পুলিশের বলুন আর পিকেটারদের কথাই বলুন বা সাধারণ নাগরিকের কথাই বলুন। প্রত্যেকেই এই ডামাডোলের মধ্যে বাধ্য হয় পথে নামতে। একেকজনের কারন একেক রকম। লাশ যত পড়বে ততই লাভ। লাশ পড়ছে তাই আরও বেশী শক্তি ব্যাবহার করার সুযোগ পাচ্ছে এক পক্ষ আর লাশ কেনও পড়ল আর এক পক্ষ তাই নিয়ে করছে জিম্মি। গোজামিল যত বেশী তৈরী করে রাখা যাবে তত বেশী লাভ। তার পর আমাদের এইযুগের বিনা শুল্কে আমদানীকৃত পীর সাহেবরা যারা আবার প্রায় আমাদের প্রভু সমান নিজেদের সব হিসাব কিতাব মিলিয়ে কোন এক সন্দ্ব্যায় চায়ের দাওয়াত দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সবার দিকে ফু দিয়ে বললেন, “ বৎস, এত চাঞ্ছল্য কেন হৃদয়, অতীব লিপ্সা হানিকারক” আর সব ঠিক হয়ে গেল। স্বাধীন দেশে তামাশা আর কি!!
আমাদের সন্তানেরা যখন হাসতে-খেলতে বা সকাল বেলায় চোখ ডলতে ডলতে আনন্দের স্কুলে যাওয়ার কথা, তখন তাদেরকে আমাদের যক্ষের ধণের মতো রাখতে গিয়ে শৈশব-কৈশোরের সব দুরন্তপনা আমরা বাবা-মায়েরা প্রতিনিয়ত গিলে খেয়ে ফেলছি। তীক্ষ দৃষ্টিতে রাখতেই হচ্ছে পাছে পথে না গাড়ী চাপা পড়ে, না আবার স্কুল বাসে কেউ পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, রিক্সাটা না আবার বাসে ধাক্কায় উলটে যায় আরও জানা-অজানা শঙ্কা। এতও সাবধান তারপরও প্রায় প্রতিদিনই কোথাও কোন বাবা-মায়ের বুক খালি হচ্ছে।মাতম চলছে। কিন্তু কেনো?? কেন আমাদের সন্তানেরা প্রতিদিন রাতে তার বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করবে “মা কাল কি হরতাল?”
যখন তখন কেন অনিবার্য কারনে জীবন থেমে যাবে?
২০ নভেম্বর ২০১৩