Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

মুক্তি যুদ্ধের গল্প (ছোটদের জন্য)

: | : ২৩/১১/২০১৩

২য় পর্ব

—————-

অনিরুদ্ধ,শুভ দিন গুনছিল, আবার মামা কবে আসবে আর শুনতে পাবে মুক্তি যুদ্ধের গল্প। আসলে মুক্তি যুদ্ধের গল্প যে শুধু ছহোট ছেলে মেয়েরাই শুনতে চায় তা কিন্তু নয়।স্বাধীনতার যুদ্ধের পরে যাদের জন্ম, তাদের একটা অংশ কিন্তু এখন ত্রিশোবর্ধ বয়সে পা দিয়েছে।তাদের মধ্যেও দেখেছি মুক্তি যুদ্ধের গল্প শুনার আগ্রহ অপরিসীম। মূলত স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষেরই একটা মজ্জাগত বিষয়। স্বাধীনতাহীন জীবন বর্তমান যুগের মানুষেরা কল্পনাই করতে পারে না। কাজেই আমরা স্বাদগীন দেশের  মধ্যে পরাধীন ছিলামএবং সেই পরাধীনতা থেকে কিভাবে মুক্ত হলাম তবু সেটা আবার চুক্তির মাধ্যে নয়, রক্ত ঝড়িয়ে। এটা কি করে হল, এই গল্পই তারা শুনতে চায়।  আমিও আজ শুভ ও অনিরুদ্ধকে মুক্তি যুদ্ধর গল্পই শুনাতে এসেছি। অনিরুদ্ধ আমাকে দেখেই বললো-

“মামা আজ কিন্তু—-।”আমি বললাম-

বেশ সবই হবে কিন্তু, আগে এই সপ্তাহে কি কি পড়া লেখা করেছ, তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে তার পর হবে মুক্তি যুদ্ধের গল্প। অনিরুদ্ধ ও শুভ স্বোৎসাহে রাজি হল। আমি বললাম-তাহলে তোমাদের পুরাতন পড়া গুলো একবার রিভিশন হয়ে যাক।

“জি মামা আমরা এখনই পড়তে বসে যাচ্ছি।“ শুভ ও অনিরুদ্ধ পড়তে বসে গেল।আমি ভাবতে লাগলাম আমাদের বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার যুদ্ধতো ১৯৭১ সাল থকেই শুরু হয়। কিন্তু এই যুদ্ধের আগেওতো শত বর্ষ পূবে আরও একবার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তাহলেতো ওদেরকে সেই যুদ্ধের কথাও বলতে হয়। আমাদের জাতির গৌরব গাথা গুলো ওদের জানা দরকার। বাতি নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আমি অনিরুদ্ধ ও শুভকে জিজ্ঞাস করলাম-

আচ্ছা তোমরা কি জান যে, এই স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেও বাঙ্গালীরা আরও একবার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সুরু করেছিল?

“না মামা জানিনা। এখনিতো আমরা স্বাধীন হলাম, এর আগে আবার কবে যুদ্ধ হয়েছিল?

আমি বললাম, তোমরা জাননা। কিন্তু হয়েছিল। আসলে বাঙ্গালীরা স্বাধীনতা প্রিয় জাতি। এরা কখনো পরাধীন থাকতে চায়নি। শুভ বললো-

“মামা তাহলে সেই যুদ্ধের গল্পটিই আগে বলুন।“

হ্যা আমিও তাই ভাবছি।

আমাদের এই দেশ পাকিস্তানীদের শাসনের আগে ইংরেজদের দখলে ছিল। আর তার আগে ছিল মোগলদের অধীনে। মোগলরা যখন এই দেশ শাসন করতো তখন বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা মিলে একটি পরগনা ছিল। মোগল শাসনের সময় এই পরগনার শেষ

সুবেদার হয়ে আসেন মুর্শিদ কুলি খা। মুর্শিদ কুলি খার সুবেদারীর সময় মোগল সম্রাজ্যের পতনের দিন এসে যায়। সম্রাজ্য রক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে মোগল সম্রাটেরা মদ ও আরাম আয়েশ নিয়েই বেশী মত্ত থাকতে শুরু করে। ফলে তাদের শক্তি মত্তা একদমই কমে যায়। সেই সুযোগে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলাকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোসনা করে দেশ শাসন করতে থাকেন। মোগল সম্রাজ্যের তখন এমনই দৈন্য দশা যে তাদের পক্ষে তখন মুর্শিদ কুলি খাঁকে দমন করে সেই রাজ্য পূনরায় মোগলদের অধীন করার সামর্থ ছিলনা। ফলে বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই চলতে থাকে। মুর্শিদ কুলি খাঁর পরে আলী বর্দী খাঁ ক্ষমতায় আসেন। আলীবর্দী খাঁ যখন বৃদ্ধাবস্হায় উপনীত হন তখন তার শাসন ব্যবস্হায় বেশ দুর্বলতা দেখা দেয়। ভিতরে ভিতরে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্র শুরু হয় এবং একটি চক্রান্তকারী গ্রোপ তৈরী হয়। আলীবর্দী খাঁর কোন ছলে ছিলনা। ফলে তার উত্তরাধীকার হিসেবে মেয়ের জামাতাদেরকেই নির্বাচন করা ছারা আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু তার মেয়ের

জামাতারা কেহ বিশ্বাসী ছিলেন না এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত ছিলেন না। ফলে তিনি তার মেয়ের ঘরের নাতি সিরাজউদ্দৌলাকেই উপযুক্ত উত্তরাধিকারী মনে করেন এবং তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী ঘোসনা করেন। নানার মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হিসেবে সিংহাসনে আরোহন করেন। ফলে তিনি পারিবারিক চক্রান্তের স্বীকার হন।তার খালা ঘোসটি বেগম অপর খালু মীরজাফর এলাকার ধনাড্য ব্যক্তি উমিচাদ,জগৎশেঠ রায় দুর্লভ এদের সাথে চক্রান্ত করে সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসন চ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। গোপনে গোপনে ইংরেজদের সাথে মিলিত হয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ দিকে মীরজাফর ছিলেন

সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি। তিনি উমিচাঁদ, জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভদের অর্থে সৈন্য বাহিনীর একটা বিরাট অংশ খরিদ করে ফেলেন।ফলে ইংরেজদের সাথে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয়। যুদ্ধের ময়দানে মীর জাফরের সকল সৈন্য যুদ্ধ না করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে।যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের হাতে বন্ধী হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। যুদ্ধ েক্ষত্রে মোহনলাল ও মীরমদন আমৃত্যু যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করে। ফলে পলাশীর যুদ্ধেই বাংলার সূর্য্যচির দিনের জন্য অস্তমিত হয়।বাংলা বিহার উড়িষ্যা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। যদিও পলাশীর যুদ্ধের পরও মীর জাফর ও তার পুত্র মীর কাসীম স্বল্প কালের জন্য বাংলার সিংহাসনে ছিলেন। কিন্তু তারা ছিলেন ইংরেজদের ক্রীড়নক মাত্র। মীর কাসীম ক্ষমতায় এসে তার বাবার অপরাধের কথা বুঝতে পেরে ইংরেজদের বিরূদ্ধে বোদ্রোহ ঘোসনা করে বাংলার স্বাধীনতা ফিড়িয়ে আনার জন্য

যুদ্ধ ঘোসনা করেন।কিন্তু তিনি যুদ্ধে পরাজিত হলে বাংলার সূর্য চির দিনের মত অস্তমিত হয়। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা দেশে জমিদারি প্রথা চালু করে।দেশের সাধারন নাগরিকদের নিকট থেকে তাদের  জমির মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়া হয়।দেশের সমস্ত সম্পত্তির মালিক

হয় ইংরেজদের প্রবর্তিত জমিদারেরা। তারা নিষ্ঠুর ভাবে  অত্যাচার করে করে এ দেশের চাষীদের নিকট থেকে খাজনা তোলে ইংরেজদের দিয়ে তাদের জমিদারী বহাল রাখতে থাকলো।তারা তাদের জমিদারী বহাল রাখার জন্য সাধারন মানুষের রক্ত চুষা টাকা দিয়ে গড়ে তুললো বিরাট বুরাট লাঠিয়াল বাহিনী। তখন সারা বাংলায় জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠে। তোমরাতো শহীদ তিতুমীরের নাম শুনে থাকব বাঙ্গালীদের অত্যাচারিত হতে দেখে তদানিন্তন যুগের অগ্নি পুরুষ সেই তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাঢীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে  যুদ্ধে  অবতীর্ণ হন।তিতুমীর ১৭৮২ সালে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনার বারাসত মহুকুমার অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন।তিনি হাজী নিয়ামত উল্লাহর কাছ থেকে কুরআন,হাদীস,আরবী ফার্সী ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সুস্বাস্থের অধিকারী ও একজন মল্লযোদ্ধা ছিলেন।

তিনি কিছুদিন এক জমিদারের অধিনে কাজ করেন। তখন এক বিবাদে জড়িয়ে তিনি জেল হাজতে যান। পরে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পবিত্র হজ পালন করতে যান।

মক্কায় হজ্জ পালন কালে তার মুক্তি সংগ্রামের পথ প্রদর্শক সৈয়দ আহম্মদের সাথে পরিচয় হয়। তিতুমীর তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেন।১৮২৭ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে সমাজ সংস্কারে আত্ন  নিয়োগ করেন।তিনি হিন্দু মুসলমান কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে  অস্র ধরতে উৎসাহিত করেন। প্রথমে তিনি বাঙ্গালীর মুক্তির জন্য নারিকেল বাড়ীয়ায় সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার মূলক আন্দোলন শুর করেন। চব্বিশ পরগনা ও নদীয়ার অনেক কৃষক এই আন্দোলনে অংশ গ্রহন করে। অল্প দিনের মধ্যেই তিতুমীরের এই আন্দোলন গন আন্দোলনে রুপ নেয়।তিতুমীরের জনপ্রিয়তা দেখে পূর্নিয়ার জমিদার কৃষ্ণদেব মুসলমানদের দাড়ির উপর আড়াই টাকা করে কর ধার্য্য করেন। কেহ কর না দেওয়ায় জমিদার কৃষকদের বাড়ি ঘর লুট করে এবং মসজিদ পুড়িয়ে দেয়।এই বিষয়ে তিতুমীর থানায় গেলে থানা কোন অভিযোগ গ্রহন করে না।ফলে তিতুমীর কৃষকদের মুক্তির জন্য অস্রধারন করতে বাধ্য হন।তিনি বারাসতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। কোম্পানীর বিরুদ্ধে ভারত বর্ষে এটাই প্রথম বিদ্রোহ। তিনি চব্বিশপরগনার কিছু অংশ, নদীয়া ও ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে এক স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষনা করেন।তাকে দমন করার জন্য বারাসতের ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রেরিত ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের নিকট শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়।এ বিদ্রোহ বারাসতের বিদ্রোহ নামে পরিচিত। কথিত আছে এই যুদ্ধে ৮৩ হাজার কৃষক তিতুমীরের পক্ষে যোগদান করে।

 

বারাসতের বিদ্রোহের পরে ইংরেজদের সাথে তিতুমীরের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পরে।ফলে তিনি নিজ বাহিনী সংগঠনের জন্য ১৮৩১ সালে নারিকেল বাড়িয়ায় বাঁশের  কেল্লা নির্মান করেন।তিতুমীর তার শচর গোলাম মাসুমকে তার প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করেন। তার বাহিনী নিয়ে তিনি নীলকরদের কুঠি আক্রমন করলে ভীত সন্রস্ত নীলকরেরা স্বপরিবারে কলিকাতা পালিয়ে যায়।

 

 

অবস্হার অবনতি দেখে কোম্পানী সরকার ১৮৩১ সালে কর্নেল ষ্টুয়ার্টের নেতৃত্বে তিতুমীরকে দমন করার জন্য এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করেন। ১৯ শে নভেম্বর ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরকে আক্রম করে। নারিকেল বাড়িয়ায় তিতুমীরের শিত ইংরেজ বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। ইংরেজদের কামানের গোলা বর্ষণে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তার ৪০ জন সহচর শহীদ হন। বিচারে বন্ধীদের বিভিন্ন মেয়াদের কারা দন্ড হয়। তিতুমীর এক জন স্বাধীনতা কামী বীর যোদ্ধা ছিলেন। তার এই যুদ্ধ পরবর্তী কালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রানিত করেছে এবং শক্তি যোগিয়েছে।

 

তাহলে তোমরাই বলো আমরা কি শহীদ তিতুমীর ও তার সঙ্গীয়দের মুক্তিযোদ্ধা বলবো না? জি মামা। আমরা  অবশ্যই তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান দিব। শুভ এবং অনিরুদ্ধ একি সাথে বলে উঠলো। হ্যা এভাবে যুগের পর যুগ অনেক দেশ প্রেমিক বাঙ্গালীরা দেশের মানুষের মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে , জীবন দিয়েছে। আমি অন্য আর একদিন তোমাদের সে সব গল্প বলবো।

 

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top