এক ভাষা শহীদের আত্মসপ্ত সুপ্তকাহন কথোপকথন
কৃষ্ণচূড়ার ফুলে ফুলে –
মায়ের ভাষায়,
তোমার আমার নিজের ভাষায়-
বাংলা ভাষায়,
একটি নির্দিষ্ট দিবসকে কেন্দ্র করে
বছর ঘুরে, ফি বছরে, বারে বারে আসে ফিরে,
একুশে ফেব্রূয়ারী।
এদিন, এদেশ ও এদেশের মানুষ এবং আর সবকে নিয়ে
কবিতা পড়া হয়, গান গাওয়া হয়,
ভাবতে মন্দ লাগে না।
কিন্তু কেন জানি মনে হয় কোথায় কী যেন নাই। তারপরও-
আমরা হাতে গোনা গুটি কয় জন
তাদের কেউ সহপাঠি কেউবা সহোদর কেউবা আত্মীয় বন্ধু স্বজন,
নেতা বা ক্ষমতা লোভে নয়, শুধুমাত্র
আমজনতাকে জাগানোর জন্য বোঝাতে-
পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায়
মিছিলে মিছিলে শ্লোগানে- শ্লোগানে
চেতনা শাণিত করতে এবং করাতে
তোমার আমার মুখের ভাষা
বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা
তোমার আমার মায়ের ভাষা
বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা
বাংলা ছাড়া উর্দু ভাষা
মানি না মানব না—-এরপর দেখলাম
দুই থেকে একাধিক্রমে শত হাজার ছাড়িয়ে লক্ষ কোটি
অত:পর সারা বাংলাদেশ-
আমাদের সাথে, আমাদের পথে —
নেমে আসল চির সবুজের পথে
দাবি স্বীকৃতের, অধিকার বাস্তবায়নের দাবিতে রাজপথে ।
অত:পর চিরাচরিত নিয়মের মত
প্রথমে বিসর্জন , তারপর অর্জন
মাহেন্দ্রক্ষণ।
এই যে দেখছ , আজকের সাজানো গোছানো রমনা-
রমনার বটমূল – টিএসসি চত্বর বা মধুর ক্যান্টিন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ;
মনে রেখ, এই রমনা সেদিনের সেই রত্নগর্ভার রমনা ,
এই এখান থেকেই সেদিন প্রথম সূচনা করেছিলাম –
ভাষাকে নিয়ে যত্তসব আলোচনা, সমালোচনা, মিছিল-মিটিং এবং
এখানকার সবুজের গর্ভের পথেই সেদিন জন্ম দিয়েছিলাম
বাংলাদেশি বাঙালীদের রক্ত বিসর্জনে জন্ম দেয়া
প্রথম রক্ত লালে লাল টকটকে তরতাজা ফুল।
এখানকার সবুজই সেদিন, প্রথম বুকে বরে ধরে
মাথা উচু করে গর্বিত হয়েছিল –
দেশ মাতৃকার্থে ভাষা শহীদের বুলবুল।
এই এখানেই সেদিন, মায়ের মুখের ভাষার জন্য,
নিজের ভাষা অধিকারের দাবি আদায়ের জন্য,
এক কথায় – আমাদের বাংলা ভাষার জন্য
মৃত্যুঞ্জয়ী চিরঞ্জীব বীরদের জন্য রচনা করেছিলাম অখণ্ডিত ইতিহাস ।
তোমরা শহীদদেরকে মৃত বলো !
আচ্ছা,শহীদ কারে বলে জানো কী!
শহীদরা কি কখনো মৃত হয় ?
আমি দেখি তাঁরা দিব্যি বেঁচে আছে ।
তোমরা মরে যাবে-পঁচে যাবে-গলে হারিয়ে যাবে চিরতরে। আমরা !
দিনে দিনে আরো হীরন্ময় হয়ে বেঁচে থাকবো
চিরটা কাল ধরে মহাকালের অন্তরে ।
আমরা বেঁচে আছি এবং থাকব
আমাদের বাংলা ভাষায়,
তোমাদের কান্না হাসি সুখ দুখ তথা সর্বাঙ্গীন জীবনের সবখানটাতেই
আজ কাল পরশু
আদরে সোহাগে মমত্বে বেঁচে থাকব
অবিনশ্বর ইতিহাসের চায়াপথে
শ্বাশত সার্বজনীনে ।
জানো কী,ভাষা শহীদদের কথা ? শোন তবে-
তুখোড় মেধাবী ছাত্রনেতা আবুল বরকত ,
তখন পড়ত সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতোকোত্তরে ।
আবদুস সালাম ! তখনকার সরকারের সরকারী পিওন ছিল সে , তা বলে কিন্তু –
ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসায় আত্মত্যাগের বিন্দু বিসর্গ কমতি ছিল না, সেজন্যই তো সে –
স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী পাকি সরকারের ঘোষণাকৃত উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে নেমেছিল রাজপথে ।
শফিউর ছিল হাইকোর্টের কেরানী ।
আব্দুল জব্বার ! সে ছিল রিয়াঙ্গুন ফেরত যুবক,
শাশূড়ীতে চিকিৎসা করাতে ঢাকাতে এসেও
ভাষার দাবীতে মিছিলে শামিল হয়ে উৎসর্গ করেছিল নিজেকে ।
রফিউদ্দিন ছিল প্রেস মালিক মানিকের ছেলে,
সে ও এসেছিল মায়ের ভাষার প্রতি প্রগাঢ় টানে জীবন সম্প্রদানে। এদেরকে সেদিন
পাকি হায়েনারা নির্মমভাবে গুলি করে মেরেছিল । আর,-
আব্দুল আওয়াল’কে ! শকুনেরা মেরেছিল ট্রাকের পায়ে পিষ্ট করে ।
ওহ ! কী সাংঘাতিক নির্মমতার মৃত্যু।
অহিউল্লাহ ! সে ছিল রাজমিস্ত্রী বাবার ক্লাস থ্রি-তে পড়া মাত্র ৮ বছরের শিশু।
সেদিন হায়েনারা তাকে ও ছাড়েনি ; ওহ! কী ভীষণ নির্মমতা !
হতভাগ্য বাবা পায়নি সেদিন অহিউল্লাহ’র লাশটি পর্যন্ত ।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ,
তমুদ্দিন মজলিশ ,পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু,
ছয় দফা দাবী, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ,
বাংলা ভাষার দাবী সম্বলিত বিভিন্ন পুস্তিকা প্রকাশনা–
–এসব করেছিলাম কেন জানো ?
শুধুমাত্র এবং একমাত্র বাংলা ভাষার জন্য ,
বাংলা ভাষার স্বাধীনতার জন্য ।
আমরা প্রথমে স্বাধীন করেছিলাম আমাদের ভাষাকে,
তারপরে দেশকে ।
সেদিনের সেই একুশ,
তোমাদের কাছে আজ সে শুধুমাত্র ছোট্ট এক টুকরো অংকুর তো নয়-ই,
বরং রীতিমত সে তো বাংলা মায়ের দামাল ছেলে , কিংবা
কৃষকের মুখে ফসলের হাসি ।
তোমরা আমাদের তাদেঁর স্মরণ করো
দানে প্রতিদানে ত্যাগে সর্বান্তকরণে,জেনে রেখো-
তবু পরিশোধ হবে না সে ঋণ কোন ও সম্প্রদানে অথবা সনে ।
এ একুশে ফেব্রূয়ারী একটি আন্দোলন ।
এ একুশে ফেব্রূয়ারী এক আন্দোলনে দুই দুটি ফসল ।
যেদিন ওরা জীবন দিয়েছিল আমার মায়ের ভাষার জন্য।
এই খানে রমনার বটমূলে কিংবা দেশের বিভিন্ন শহীদ মিনারে মঞ্চে
তোমরা যারা স্মরণ করো বক্তৃতায় কবিতায় গানে অথবা অন্যভাবে
কোন অভিযোগ নেই । তবে—
আমাদেরকে মৃত বলোনা । মৃত্যুঞ্জয়ী বীর হয়ে জিতেন্দ্রীয় অপরাজেয় হয়ে
আমরা জেগে আছি, জেগে থাকব তোমাদের মাঝে;
মরম থেকে মনে রেখো ।
হয়ত সেদিন তোমরা কেঁদেছিলে , দেখেছিলে কী ?
রাজপথ রক্ত হাসিতে হাসতেছিল। কেন হাসতেছিল জানো ?
কারন,- সেদিনের সে রক্তলাল হাসির ভেতরে লুকিয়ে ছিল
আজকের এই বাংলাভাষা । এবং আরো লুকিয়ে ছিলো-
আজকের এই বাংলাদেশ ;
শির দাঁড়া টান টান করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এই বাংলাদেশ;
বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন দেশ;
বাংলাদেশ ।
একুশে ফেব্রূয়ারী বা আমরা ভাষা শহীদরা- কী দিয়েছি আর নিয়েছি কী,
কিংবা কতটুকু নিয়ে বিনিময়ে কতটুকু দিয়ে গেছি? – এসব হিসেব কষে
দেখবার সময় কী এখনো আসেনি ! হে বাংলাদেশী বাঙালী,
বলবে – কেন ভেদাভেদ ?
কেন বর্ণ বৈষম্য ?
কেন এত এত্ত লোভ ?
আমরা একুশ হয়ে তোমাদের করে আসি ফিরে
বছর ঘুরে বারে বারে
বাঙালী হৃদয় দুয়ারের চির চেনা মন্দিরে ।
আজ এত দিন – এত রাত – এত মাস – এত বছর পর
তোমরা কেন বলতে পারো না? হে একুশ !
তোমাকে আমাদের করতে কতটুকু পেরেছি কি পারিনি
সে প্রশ্ন করো না কক্ষনো আমাদেরকে । শুধুমাত্র জেনে রাখো–
তুমিই আমাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের ভীত;
তোমার সত্যিকারের ইতিহাসই আমাদের আজ কাল পরশুর সূচনা সংগীত ।
—-বন্ধু, এ স্বান্ত্বনা এখনো কতদূর ?