Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

উটন দাদুর কাহিনী–পর্ব—১১(শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)

: | : ২৯/১১/২০১৩

অসুস্থ বৃদ্ধ লোকটা চুক চুক পরে কলা চাটছিল। মনে হল কিছুটা কলা ও চিবিয়ে নিলো। উটন দাদু নেচুকে বাচ্চাদের কলা দিয়ে আসতে বলল। নিচু এত সাহস পাবে কোথায় ! দুটো কলা নিয়ে ও মাথার ওপরে তুলে ধরল। আর ওই পুরুষ আর মেয়ে লোকটাকে ইশারায় ডাক দিল। মেয়ে লোকটা ভয়ে ভয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে এলো। পরুষ লোকটা তার পিছে পিছে এগোচ্ছিল। দেখা গেল,ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে বাচ্চাগুলি ভাল করে লক্ষ্য করছিল ওদের দিকে।

শত্রু মিত্র বুঝতে দেরী হয় বৈকি ! আজ ওরা  এমনি মানুষ–এমনি কাপড় প্যাঁচানো মানুষ দেখেনি কখনো–জঙ্গলে জঙ্গলি জানোয়ারদের ওরা চেনে ভাল। কিন্তু এরা কোথাকার! কাঁধে ঝুলছে ঝোলা, আর তাও তার ভিতর থেকে বের হচ্ছে নতুন ধরণের চিজ –কোন জংলী বস্তু বলেই মনে হয় ! কিন্তু ওই আধ বুড়াটার হাতে বিরাট ডাণ্ডাটা–তাতে আবার দড়ি লাগানো–কি ধরনের মারণ অস্ত্র বাবা ! ওদের ভাবনা ওদের মতই ছিল। কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তার বেড়া জাল ভাঙতে ওরা ভয় পাচ্ছিল খুব।

দূরে যাদের দেখা যাচ্ছিল ওরা সাহস করে কাছে ভিড়তে পারছিল না। কারণ ওরা সংখ্যায় ছিল বড় কম। কিন্তু উটন দাদুর অভিজ্ঞতা বলছে,যারা নদীর পারে ওদের খুঁজতে বেড়িয়েছে সেই জংলীদের সংখ্যা নেহাত কম হবে না। ওরা যখন ফিরবে তখন নিশ্চয় উটনদের ওপর আক্রমণ করতে ছুটে আসবে। তেমনটা হলে উটন ছেলেদের বলবে তারা যেন নেচুকে নিয়ে আগে ভাগে পালায়। উটন বুনোদের আক্রমণ ঠেকিয়ে পালাবার চেষ্টা করবে। নেচুকে নিয়েই ওদের ভাবনা বেশী। ওর ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশী। আর  ধরা পড়লে তার পরের কথা ভাবতে গেলে উটন দাদুর শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়!

অসুস্থ বিমার লোকটা বেশী সময় বাঁচবে বলে মনে হয় না। ও চোখ বুজে পড়ে আছে। উটন দেখেছে লোকটার শরীর হাড় জিরজির কংকাল সার। অনেকদিন যাবত অসুখে ও ভুগছে মনে হয়।

উটন দূরে দাঁড়ানো মেয়ে ছেলে আর লোকটার দিকে তাকিয়ে কলা সাধল। ওরা তাকিয়ে থাকলো–বাচ্চাগুলি ভীত দৃষ্টি নিয়ে কলার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সাহস করে ওদের কেউ এক পাও এগোচ্ছিল না। এমনি সময় দূর থেকে হই হই রই রই শব্দ শোনা গেল–উটন ওরা দেখল,দশ বার জন লোক,ওদের বেশীর ভাগ উলঙ্গ,ওরা ওদের দিকেই ছুটে আসছে। হাতে তাদের লাঠি সোঁটা আর অদ্ভুত আকারের সব অস্ত্র শস্ত্র !

উটন তার ছেলেদের বলে উঠলো,হুঁশিয়ার সবাই,তৈরি থাক–তোদের ছুরি চাকু সব বের করে ওদের দেখা। উটন নিজেও তার গাঁদা বন্দুক হাতের ওপর উঁচিয়ে ধরল।

এবার তেড়ে আসা জংলীগুলি থমকে গেল। ওরা বোধ হয় অপেক্ষা করতে লাগলো দল ভারী করার।

কি করা যায় উটন ভাবছিল,চারদিকে তাকাল সে। এক জাগায় দেখা গেল মস্ত উঁচু এক ঢিবি—তার ওপরে পাথরের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চাঁই দিয়ে তৈরি ঘর। সাধারণ ঘর থেকে সেটা কম হলেও একশ গুণ বড়–অনেকটা গির্জা ঘরের মত। উচ্চতাতেও ওটা বিশাল। ওটা কি হবে ? হতে পারে ওটা ওদের ভক্তির স্থান –যেমনটা আমাদের মন্দির বা গির্জা হয়।

দুগ্গলের কাছে শুনেছে উটন ওদের গ্রামের সর্দার আছে,তার কথায় গ্রামবাসীরা চলে। তার বিচার সবার ওপরে–তার কথা সবাই মেনে চলতে বাধ্য। সেই সর্দার কোথায় ? সে যদি উটনের কথা কিছু বুঝতে পারত,তবে কত না ভাল হত ! যুদ্ধের বিরতি চলছিল মনে হয়।

খিদেতে উটনের পেট চোঁ চ্যাঁ করছিল। সে ঝোলা থেকে তাড়াতাড়ি খাবার বের করে ছেলেদের হাতে দিয়ে বলল,আর সময় পাবি না,তাড়াতাড়ি এগুলি খেয়েনে তোরা !

ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে ওরা সবাই কিছু খেয়ে নিলো। সঙ্গে সামান্য জল ছিল–সবাই এক ঢোক,এক ঢোক গিলে নিলো। ওদের খাওয়া বাচ্চা বুড়ো সবাই অবাক চোখে দেখছিল। উটন বলল,চল আমরা ওই উঁচু ঢিবির বড় ঘরটার দিকে যাই। ওরা সবাই  ওই ঘরের দিকে চলতে লাগলো,সবার ভীষণ সতর্ক হয়ে এগোচ্ছিল কারণ জংলীরা যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে। উটন জানে দৌড়ে পালাতে গেলে ওরা পিছে দৌড়ে আসবে–ভাববে উটনের দলের সবাই  ভয় পেয়ে গেছে।

উঁচু বড় পাথর ঘরের কাছে এসে উটন বলল,তোরা এখানে অপেক্ষা কর,সবাই সব সময়ের জন্যে সতর্ক থাকবি,যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে বুনোরা। জানবি,ওরা ওই ঘরেও থাকতে পারে—হঠাৎ বেরিয়ে এসে আমাদের আক্রমণ করতে পারে!

উটন একা পাথর ঘরের দ্বারের দিকে এগিয়ে গেল। ওর কানে কোথাও থেকে যেন বড় বড় শ্বাস ও চাপা কান্নার আওয়াজ আসছিল। ঘরের দেওয়ালে কান পাতলো উটন। হ্যাঁ,তাই তো এই ঘরটায় মনে হচ্ছে কেউ আছে ! কারো কান্না এবার স্পষ্ট কানে আসতে লাগলো।

কেউ তো এই ঘরে আছে। আবার কান পাতল উটন,না,এখন কোন শব্দ নেই–বড় বড় শ্বাস আর আওয়াজের শব্দ থেমে গেছে। যাই হোক না কেন–মন্দির গির্জা বা বন্দী ঘর। এতে বেশী লোক থাকবে না।

বিরাট প্রবেশ স্থান,কিন্তু দরজা নেই। ধীরে ধীরে উটন পা বাড়াল ভেতরে। ভেতরে বিরাট চওড়া মত চত্বর বেশ কিছুটা জাগা জুড়ে। দূরে আর একটা বিরাট পাথরের তৈরি ঘর–বেশ বড় হবে ভেতরটা  দূর থেকে কেমন অন্ধকার মত মনে হল। ধীর পদক্ষেপে এগোল উটন। সামনে পঞ্চাশ হাতের মত উঁচু ঘর,চওড়ায় তিন চার শ হাত তো হবেই ! গম্বুজ নয় ওই ধরনের বিশাল পাথর চাঁই ঘরের মাঝখানে মাঝখানে খাড়া করিয়ে দাঁড় করানো। একটা লোকেরও দেখা নেই। আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে ঘর। উটন একবার ভাবল,ঝোলাতে রাখা টর্চ বের করবে কি না–কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল না,এখন না–দেখে নেওয়া যাক না আর কিছুটা। ভেতরের লোকজনকে আলো জ্বেলে আগে থেকে সতর্ক না করাই ভালো। কয়েক পা এগোবার পর সয়ে যাওয়া চোখে  অন্ধকার হালকা হতে লাগলো। হঠাৎ চমকে উঠলো উটন, একটা আওয়াজ আসছে না ! এ ঘরের শেষ দিক থেকে। এবার দেখা গেল পাথরের খাম্বা পার হতেই  দূরে কোথাও ক্ষীণ একটা আলোর আভাস আসছিল। আলো অনেকটা প্রদীপ শিখার মত–বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তার মানে,গুমট ভাব থাকলেও এখানেও হওয়ার  প্রবেশ আছে !

উটন আলোক শিখা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। আরে ! একটা লোক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে না ? হ্যাঁ,লোকটার হাত,পা  আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আর সব চে আশ্চর্যের ব্যাপার হল লোকটার গায়ে সভ্য সমাজের পোশাক পরা ! উটন লোকটার কাছে গেল,ভাল করে লক্ষ্য করার জন্যে তার ওপর ঝুঁকে পড়ল। লোকটা ভয়ে হবে,আচমকা চাপা চীৎকার দিয়ে উঠলো। উটনের কেন যেন মনে হল,হতে পারে লোকটা তার কথা বুঝতে পারবে। উটন জিজ্ঞেস করল,কে তুমি ?

লোকটা আচমকা পরিচিত ভাষা শুনে হবে মুখ ফিরিয়ে দেখল–ও ভীত গলায় বলল,আমায় বাঁচাও ! খুব ক্ষীণ স্বরে আর কেটে কেটে কথাগুলি বলছে ও। কথা বলার ক্ষমতাও ওর বেশ কম মনে হল। উটন তার ঝোলা থেকে টর্চ বের করে লোকটার ওপরে মারল। এবার দেখা গেল লোকটার হাত পা মোটা মোটা লতার দড়ি দিয়ে বাঁধা। ওর গায়ে ছেঁড়া শার্ট,পাজামা। মাথার চুল আলুথালু। উটন তার ঝোলা থেকে তাড়াতাড়ি ছুরি বের করে লোকটার হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিল। টর্চের আলোয় বোঝা গেল লোকটার পোশাকে লেগে আছে চাপ চাপ রক্তের দাগ ! বাঁধন কাটার পরেও লোকটা ওঠার অবস্থায় ছিল না। বুনোরা ওকে খুব পিটিয়েছে হবে,চোট খাওয়া শরীর। উটন তাকে হাত ধরে দাঁড় করবার চেষ্টা করল,ওর উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। শেষে দেওয়া ঘেঁষে লোকটা কোন মত উঠে বসলো।

–তুমি এখানে কি করে এলে ? উটন জিজ্ঞেস করল।

–আমি উদু গাঁয়ের লোক। পাঁচজন মিলে গিয়ে ছিলাম বালুচরি গ্রামের দিকে–ওখানকার  লোকও খুব হিংস্র–একথা আগে আমরা জানতাম না—লোকটা মাঝখানে থেমে গেল,ধীরে আবার বলে উঠলো,জল,জল চাই !

কিন্তু জল এখানে কোথায় ?  উটন জানে না। ও এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।

লোকটা বলে উঠলো,ওই দূরে পাথরের একটা গামলা আছে। ওতে ওরা নদীর জল এনে রেখেছে। উটন উঠে গিয়ে টর্চ জালিয়ে দেখল পাথরের বড় কুণ্ড মত একটা জাগা,তাতে অনেক জল রাখা আছে। উটন তার থেকে জল দু হাতের অঞ্জলিতে ভরে এনে লোকটার মুখে ঢেলে দিল। এমনি দু, তিন বার জল খেয়ে লোকটা কিছুটা শান্ত হল।

লোকটার গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা,ভাল ভাবে ও নাড়াচাড়া করতে পারছিল না। ও এবার খুব ধীরে ধীরে নিজের কথা বলতে শুরু করল,বালুচরি গাঁয়ের লোকেরাও মানুষের মাংস খায়। ওরা দূর থেকে দেখেই আমাদের দিকে তীর ছুঁড়তে লাগলো। সামনেই দেখলাম আমাদের তিন তিনটে লোকের গায়ে এসে তীর বিঁধে গেল। আর ওরা ওখানেই মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো। বুনো লোকগুলো তীর ধনুক নিয়ে ছুটে এলো। আর আনন্দ উল্লাসের সাথে নাচতে নাচতে আমাদের ঘায়েল তিন জনকে কাঁধে ফেলে নিয়ে চলে গেল ! আমি আর আমার সাথী জঙ্গলের ভিতর থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম,এবার বুনোদের ভেতর থেকে কিছু লোক আমাদের দিকে ধাওয়া করল। আমরা প্রাণপণ ছুটতে লাগলাম।

ক্রমশ…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top