Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

শেষ বিকেলের স্বস্তি

: | : ২৯/১১/২০১৩

শেষ বিকেলের স্বস্তি

হ্যলো ‘আমি হীরা বলছি’ ।
কথাটা শোনার সাথে সাথে স্বতঃস্ফুর্ততায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল জরার , কে ! কে বলছেন ?
আবার একই কথা শোনা গেল , ‘আমি হীরা বলছি’ ।
কিছুক্ষন নিরুত্তর থাকলেন জরা । এতদিন , এতদিন পর শুনলেন সেই কন্ঠস্বর । কি বলবেন তিনি ? এতোদিন পর এই কন্ঠ আদৌ তিনি কিন্তু শুনতে চাননি । হীরা নামটা মন থেকে একদম মুছে ফেলতেই চেয়েছিলেন । হয়ত ঘৃনাই ছিল লোকটার উপর তার । হয়ত কেন , ঘৃনাই তো ছিল । থাকবে না-ই বা কেন ! যে লোক দীর্ঘ সাতাশটি বছর কোনদিন কোনপ্রকার খোঁজ নিলনা , একটি মাত্র সন্তান , যার জন্মের সময় থেকে লাপাত্তা তিনি , সে কেমনে বেঁচে আছে , কি বেঁচে নেই , সে খোঁজটাও যিনি নিলেন না , আজ তার ফোন !
বিষ্ময় না কাটতেই আবার ভেসে এল সেই কন্ঠ , কই , কিছু বলছনা যে ।
এবার তিনি না বলে পারলেননা , এখানে কার কাছে ফোন করেছ ? এখানে তোমার কেউ নেই । বলেই সংযোগ বিচ্ছিন œ করে দিলেন টেলিফোনের ।
অভিমান বলতে যা বুঝায় , তা নয় , কোনদিন-ই তা ছিলও না ; আবার এতোদিন ধরে তীব্র একটা রাগ যে ছিল লোকটার উপর , কেন জানি তা-ও অতোটা নাই । মানে সেভাবে যেন রাগটা আসছেনা আর । আর অভিমান তো মোটেই ছিলনা , তা-ই যেন হতে যাচ্ছে আস্তে আস্তে লোকটার উপর । ভেবে পাচ্ছেননা জরা কেন এরকমভাবে কিছুটা পরিবর্তিত হচ্ছে তার মন । ফোন কলটাই কি এর কারন ! ইন্টারকম বেজে উঠে চিন্তায় ছেদ ফেলে দিল । অন্য ঘরে থাকা জয়কে বললেন , ড্রাইভারকে বলে দে তো বাবা , আজ অফিসে যাবনা । মার শরীরের খবর নিয়ে চলে গেল জয় তার অফিসে ।
মনটা তার বিষিয়ে ওঠার কথা । সংসারে সঙ্গী না থাকার কারনে হয়তো বা রাগটা একটু বেশিই । তবে অতো বেশী আবার নয় । কিছুক্ষন আগে একসময়ের ভালোবাসার লোকটির ফোন পেয়ে আজ এই শুনসান বাড়ীতে তার মন বেশ ভাল ভাল মনে হচ্ছে । এরকম কিন্তু হওয়ার কথা ছিলনা । জীবনে কোনদিন আর তার সাথে সম্পর্কই না রাখার ব্যাপারে মন স্থির ছিল তার । আগে হীরার আত্মীয়-স্বজন , মানে বোনরা কেউ তার সাথে দেখা করতে এলে একরকম অপমান করেই বিদায় দিয়েছেন তাদের তিনি । কয়েকদিন আগেও কে যেন তাকে একবার হীরা সম্পর্কে বলতেই তেলে-বেগুনে জ্বলেও উঠেছিলেন । নিজের ‘হীরা’ ডাকনামটিও তিনি বাদ দিয়েছেন ওর নাম হীরা বলে । অথচ হাহাকারের মধ্যেও ভালোলাগার একটা অনুভূতিতে পেয়ে বসেছে তাকে । অথচ এমনটা হবার কথা মোটেই নয় ।
মনে পড়ে ২৯ বছর আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ঢাকায় শিক্ষা ভবনে যখন চাকুরী শুরু করেন , তখনই একদিন তার একই কলেজ হতে পাশ করা তখনকার বড় ভাই হীরা তাকে প্রোপজ করে । আশ্চর্য্যর্রে ব্যাপার , তাদেও দু’জনের নামই হীরা , আরো আশ্চর্য্যওে ্র বিষয় , তারা দু’জনই একই দৈহিক গড়নের অধিকারী । দু’জনই লম্বা এবং পাতলা , এমনকি গায়ের রংটাও এক । হীরা বলে , আশ্চর্য্যজনকভাবে আমাদের মধ্যে কত মিল , তা তো তুমি দেখতে পাচ্ছো । তোমার কি মনে হয়না , খোদা আমাদের মধ্যে অন্য কোন বন্ধন তৈরীর ইচ্ছায় আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন ?
একথার পর আসলে আর কোন কথা থাকেনা । ছিলওনা ; ফলে সম্পকর্ হতে সময় লাগেনি দু’জনের মধ্যে । ঐ মুহুর্তটার কথা আজ বেশি কওে মনে হচ্ছে তার , কি ছিল তার ঐ একটি কথায় , একটি বাক্যে ! যাতে সন্মতি দিতে তার দেরী হয়নি । বরং হীরার ঐ কথাটি-ই তার সন্মতি আদায় করে নিয়েছে । ৫৩ বছর বয়সে এসে আজ তিনি অনূভব করেন ঐ মুহুর্তটি-ই ছিল তার জীবনের সেরা মুহুর্ত ।
কেন যেন দেখা যায় সম্পর্র্কের মাধ্যমে হওয়া পরিণতিগুলো টেকে কম । কিছুদিন মধুরভাবে কেটে এই ধরনের পরিণতির অবসান হয় । ‘ঝরা’ নামে ডাকতো তাকে । অনুভূতি প্রকাশটা হীরার দিক থেকেই থাকত বেশী । মনে পড়ে একদিন একটি ক্যাসেট নিয়ে রাত এগারোটায় হীরা হাজির বাসায় , মানে ঝরা যে বাসায় থাকতেন , সে বাসায় । কলিং বেল বাজিয়ে ঝরা বের হয়ে আসতেই ক্যাসেটটা তার হাতে দিয়ে বলেন , এর মধ্যে থাকা সব কয়টি গানই তোমার পছন্দের ঐ গানটি , শুনিও ; বলে অত রাতে আসার লজ্জায় আর না দাঁড়িয়ে প্রস্থান করেন তিনি । চুড়ান্ত পরিণতি অর্থাৎ বিয়ের আগেকার এরকম আরো কিছু মধুময় স্মৃতি মনে পড়ে তার । নিস্তব্ধ বাসায় এক পর্য্যায়ে মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল তার , বড় মায়া মায়া ভাব ছিল চেহারায় তোমার ।
বিচ্ছেদ বলতে যা বোঝায় , আসলে তাদের মধ্যে তা হয়নি । সম্পর্ক শুরুর ছয় মাসের মধ্যে বিয়ে এবং এর দেড় বছরের মধ্যে তাদের সন্তান জয়ের আগমন । ইতিমধ্যে কলহ শুরু হয়ে গেছে তাদের মধ্যে । ঝরা ততদিনে বদলী হয়ে রাজশাহীতে । থাকেন মা’র বাসায় । এখানেই হয় তাদের মধ্যে চূড়ান্ত কলহ ।
প্রেক্ষিত অথবা কারন হয়ত থাকে আরো গভীরে ; তবে কিছু রাগী মহিলা স্বামীকে কাছে পেলে বেশী করে অভিমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেন , যে অভিমানের প্রতিফল কি হতে পারে তা না বুঝেই । আমি বিশারদ নই এবং কেন নারী-পুরুষের সম্পর্ক ভাঙ্গে , সে-বিশ্লেষন করার মত মনোবিজ্ঞানী হওয়ার কোন যোগ্যতাও আমার নেই । তবুও নিজের দেখা কিছু ঘটনা থেকে আমি মেয়েদের , আমার নিজেরও মেয়ের বিয়ে হয়েছে , বলতে চাই , আপনারা স্বামীকে কখনও বলবেননা যে , ‘এখানে এলে কেন ; যাও মা’র সাথে , বোনের সাথে থাকগে’ । পুরূষ এতে কঠিন এবং কঠিনভাবে রি-আক্ট করে কিন্তু । সাবধান ।
বিদ্যুত বিভাগে ঢাকায় কর্র্মরত হীরা ঐ চুড়ান্ত কলহের পর দিশেহারা হয়ে পড়ে । তখনই দশ মাসের প্রশিক্ষনে নরওয়ে যাওয়ার সুযোগ আসে তার । ঝরাকে কিছু না বলে তিনি চলে যান নরওয়ে । সেখানেই যোগাড় করেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকা যাওয়ার ট্যুরিষ্ট ভিসা । প্রশিক্ষন শেষে দেশে এসে দিন পনের থেকে আবার পাড়ি জমান আমেরিকা । সালটি হচ্ছে ঊননব্বই , আজ থেকে চব্বিশ বছর আগের কথা । আর দেশমূখী হননি ।
হীরা এবং ঝরা থেকে ‘জরা’ নাম গ্রহনকারী , কেউ কারো সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টাই করেননি । কোনভাবেই তাদেও মধ্যে কোন যোগাযোগ হয়নি । কেউ অন্য অর্থাৎ তৃতীয় কারো পানিও গ্রহন করেনি । জরা তবু কাছে নিয়ে থাকেন প্রানপ্রিয় সন্তান জয়কে । কাউকে কাছে না পেয়ে অব্যক্ত এক বেদনা নিয়ে একা একাই থাকেন হীরা । ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে ছোটখাটো ব্যাবসা করেন দিনে , আর রাতে নিসংগতা ভুলে থাকতে পান কওে সময় পার করেন ।
দিনকয়েক আগে হাসপাতালে ভর্তি হন হীরা এবং একেবারে অসহায় বোধ করেন । ইতিমধ্যে অতি স্নেহময়ী মা মারা গেছেন , ঢাকায় থাকেন দুই বোন । যোগাযোগ আছে তাদের সাথে । কিন্তু যে সম্পর্র্কের সমাধি দিয়ে , বলা যায় একরকম ইতি টেনে সাত সমুদ্র পেরিয়ে সকলের আড়ালে বিচরন করছেন , হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি , পেয়েছেন কি শান্তি ? পেরেছেন কি ভুলতে তাদের ? এ-অনুভূতি কুওে কুরে খাওয়ার এক পর্য্যায়ে হাতে থাকা সেলফোনটা থেকে কখন যে বেরিয়ে গেছে কলটা , নিজেও জানেননা ।
কই ! কিছুই তো বদলায়নি ঝরা । সাতাশ বছর আগে যে ঝরাকে দেখেছিলেন , এখনও সেই একইরকম আছে ; সেই রাগী কন্ঠ , কথারও সুর সেই আগেরই মত । অনেক শুভাকাংখী বলত , মিটমাট করে নাও । মন থেকে কখনও সায় পাননি , কারন মনে হয় তিনি জানতেন যে ঝরা রাজী হবেনা । এজন্য নিজেও কখনই উদ্যোগী হননি এবিষয়ে । ছেলের নাম জয় জানতেন , এটাও জেনেছেন ছেলের আদলও হয়েছে তারই মত । কিন্তু ছেলেও তাকে ঘৃনা করে হয়তো মায়ের মত । তাই ছেলের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করেননি কোনদিন । বাথরুমে পড়ে গিয়ে বাম কটিতে ব্যাথা পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দিন কয় আগে । ভাগ্য ভাল হাড্ডি ভাঙ্গেনি । কতদিন থাকা লাগবে জানা নাই ; আবার বলছে পান করা ছাড়তে হবে এবং এজন্য পূনর্বাসন কেন্দ্রে দু’চার মাস থাকতে হবে । এদিকে মুখেও একটা টিউমার হয়েছে , সারানো দরকার সেটাও । দু’একজন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া দেখারও কেউ নাই । বিদেশ বিভুঁইয়ে আসলে খুবই অসহায়ত্ব বোধ করছেন তিনি ।
ঘুমের মধ্যে একটা রিংটোন মস্তিস্কে ক্রমাগত: যেন আঘাত করেই যাচ্ছিল । কিন্তু ওটা যে একটা কল , কেউ যে তাকে ডাকছে মনেই হয়নি ; সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার হতে একসময়ের অতি আপনজন যে ডাকতে পারে , কল্পনাতেও আসেনি কখনও । মস্তিস্কে ক্রমাগত আঘাত করা কলটা অবশেষে তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘটায় তার এবং সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে একসময় অনূভব করেন কলটা আর কারো নয় , ঝরার । ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে গিয়ে কঁকিয়ে উঠেন তিনি এবং শুনতে পান , কি হয়েছে তোমার , কঁকাচ্ছো কেন ?
ওপার থেকে ভেসে আসা কথাগুলো জরার হৃদয়ে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে চলেছে । একি যৌবনে শোনা হীরার কন্ঠ না-কি অন্য কারো কন্ঠ এটা , ঠাওর করতে পারছেননা তিনি । মনটা হাহাকার করে ওঠে । ছয় ফুট লম্বা পুরুষটার এ-কি হাল হয়েছে! মায়ের অবস্থা দেখে মা-কে জড়িয়ে ধরে থাকে জয় । ফোনের কথাগুলির কিছুটা তার কানেও আসে । জীবনে যাকে কোনদিন দেখেনি , কথাও শোনেনি কোনদিন , আজ একটু তা শুনে তারও অস্থির অস্থির মনে হয় । ’বাবা’ বলে নিজের অজান্তেই ডেকে ওঠে সে । রক্তের টান বোধহয় এরকমই হয় । জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জরা ।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন জরা । যাবেন আমেরিকা । আর কষ্টে থাকবেননা , তাকে এবং প্রানপ্রিয় সন্তান জয়কে দেবেননা আর কোন কষ্ট । স্বামীর ছোট বোন , একসময় মনে হত নিজেরই ছোট বোন । মনে পড়ে একরকম অবজ্ঞা-ই করে গেছেন তাকে । কিন্তু নিজে তার কাছ থেকে পাননি কোনদিন কোনরকম অবজ্ঞা , নির্ভেজাল সন্মানই শুধু পেয়ে গেছেন সবসময় । কতদিন এসেছে সে তার অফিসে বড় ভাইয়ের ঘর যাতে আবার ঠিক হয়ে যায় , সেই চেষ্টায় । দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে । কেন জানি তাকে আজ মনে পড়ছে বড় বেশী করে ।
অবশেষে আমেরিকার বিমানে উঠে বসেন ওরা তিনজন । জয়েরই আনন্দ বেশী । মাঝে বসেছে সে । জন্মের দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর এই প্রথম বাবা-দর্শনে যাচ্ছে সে । বাবার মতই স্বাপ্নিক মন তারও । স্বপ্নের কি জাল বুনতে বুনতে যাচ্ছে সে , তা শুধু সে-ই জানে । মানূষ সময় সময় তাকিয়ে থাকছে হাস্যোজ্জ্বল তিনটি মুখের দিকে ।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top