Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

পুতুলের আলমারি

: | : ৩০/১১/২০১৩

বৈশাখের তীব্র খাঁখাঁ রাস্তাঘাট জনবিরল, বড় রাস্তার ওপর এই বিরাট পাঁচতলা বাড়িটাও যেন ঝিমোচ্ছে, দরজা জানলা সব বন্ধ, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। শুধু দোতলার একটা ঘরে অনামিকার চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে বারকয়েক এপাশ ওপাশ করে উঠেই পড়লেন। খাটের পাশেই দেওয়ালে লাগান পুতুলের আলমারিটা, বসে বসে তাই দেখতে লাগলেন। রঞ্জিত মারা যাবার পর যখন এখানে আসা ঠিক হল তখন অনেক কিছুরই মায়া কাটাতে হয়েছিল, কিন্তু এই পুতুলের আলমারিটার মায়া কাটাতে পারেন নি। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বড়ো প্রিয় তাঁর এটা। মা, ঠাকুমা, দিদিমা কতজনের দেওয়া দেশ বিদেশের পুতুলে পরিপূর্ণ তাঁর এই সংগ্রহ। নিজেও কি কম সংগ্রহ করেছেন। এত বছরেও একটা ভাঙে নি, নষ্ট হয় নি। মানুষ চলে গেছে কিন্তু পুতুলগুলো রয়ে গেছে তাঁদের স্মৃতি বহন করে। একেক সময় মনে হয় এও যেন একটা সংসার। আজকাল যেন এই পুতুলগুলো বড্ড টানে। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় দেখতে দেখতে।

নাঃ অনেকদিন ঝাঁড়পোছ করা হয় নি পুতুলগুলো। বড়ো রাস্তার ওপর বাড়ি, যতই আলমারির কাঁচের পেছনে থাক, ফাঁকফোকর দিয়ে ধুলো ঢোকেই। একটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে এসে অনামিকা ভরদুপুরে পুতুল ঝাড়তে বসলেন। পরম মমতায়, যত্নে একেকটা মোছেন আবার যথাস্থানে রেখে দেন। এই বয়েসেও পুতুল প্রীতির জন্যে কম পরিহাস সহ্য করতে হয় নি ছেলে, বউ, নাতি, নাতনী সবার কাছ থেকে। এখানেও যখন এলেন তখন কি করে যেন রটে গেছিল তিনি এক আলমারি ভর্তি পুতুল নিয়ে এসেছেন। সবাই দেখতে এসেছিল। তবে এখানে কেউ ঠাট্টা করে নি বরং ওনার সংগ্রহের প্রশংসাই করেছে। সবচেয়ে ভালো বলে সঞ্জয়, এই পাঁচতলা বাড়িটার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ছেলে, এতগুলো বুড়োবুড়ির ভরসার জায়গা।

রোজ সকালে তাঁর কুশল সংবাদ নিতে এসে জিজ্ঞেস করে, “পুতুলরাও সব ভালো আছে তো জেঠিমা?”

“কেন রে পুতুলদের আবার কি হবে?”

“না, বলা যায় না, কোনো পুতুল যদি ভেঙেটেঙে যায়।”

“তাহলে আমি আবার একটা কিনে এনে রেখে দেব। পুতুলের আলমারি খালি হবে না, বুঝলি?” অনামিকা হেসে বলেছিলেন।

ক্রমশ অনামিকার পুতুলের আলমারি দ্রষ্টব্য হয়ে উঠল, আশপাশ থেকেও অনেকে এসে দেখে গেছে। পুতুলগুলো গুছোতে গুছোতে এসবই ভাবছিলেন অনামিকা। হঠাৎ একটা ছোটো চামড়ার উট মোছার জন্যে হাতে নিতেই যেন টাইম মেশিনে সওয়ার হয়ে মুহূর্তে ফিরে গেলেন অনেক বছর আগে।

সাম মরুভূমিতে উটের পিঠে চড়ে অনামিকার প্রবল চিৎকার। নীচে দাঁড়িয়ে রঞ্জিত চেষ্টা করছেন ছবি তোলার কিন্তু অনামিকার তখন ছবি তোলা মাথায় উঠে গেছে। শেষ পর্যন্ত ওই বাবারে মারে করা ছবিই উঠল একটা।

রঞ্জিত একজোড়া চামড়ার উট কিনে দিয়ে বলেছিলেন, “এদুটোও তোমার পুতুলের আলমারিতে রেখো। দেখবে আর মনে করবে আর হাসি পাবে।”

সত্যি এখনও হাসিই পেল, এত বছর পরেও। পুতুলের আলমারি নয়তো স্মৃতির সিন্দুক। উটটা রেখে একটা ছোট্ট পুতুল হাতে নিলেন।

“মা এটা তুমি আর এটা আমি। এই দুটো পুতুল কিন্তু তোমার আলমারিতে পাশাপাশি রাখবে,” ছোট্ট শুভ বলছে রথের মেলা থেকে দুটো পুতুল কিনে।

“আর বাবা? বাবা কোনটা হবে?” অনামিকা জিজ্ঞেস করেন।

সারা রথের মেলা খুঁজে অবশেষে আরেকটা ছেলে পুতুল পছন্দ হল শুভর। রাখা হল আলমারিতে, দুপাশে দুটো বড়ো পুতুল, মাঝে একটা ছোটো পুতুল। কি খুশী হয়েছিল শুভ সেদিন। কোনো কারণে এই পুতুলগুলো এদিক ওদিক করলেই রেগে যেত।

অনামিকা মোবাইলের দিকে হাত বাড়ালেন, তারপরেই হাত গুটিয়েও নিলেন। শুভ বেড়াতে গেছে। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে। কি দরকার অকারণে বিরক্ত করার, দুদিন পরেই তো ফিরবে। মাথাটা হঠাৎ কিরিকম যেন করল। ক’দিন থেকেই শরীরটা ঠিক যুতের যাচ্ছে না। এবার মনে হচ্ছে সঞ্জয়কে বলতে হবে ডাক্তার দেখানোর কথা। কোনোরকম টলতে টলতে বিছানায় শুয়ে পড়ার আগে এমার্জেন্সি বেলটা টিপতে পেরেছিলেন।

*****

শহরের অভিজাত এলাকায় বড়ো রাস্তার ওপর এই বিশাল পাঁচতলা বাড়িটাকে সবাই এক ডাকে চেনে। ‘সায়াহ্ন’ বৃদ্ধাবাস। এর খ্যাতি বহু প্রসারিত। ঠিক তথাকথিত বৃদ্ধাবাস নয় এটা। দেখলে মনে হয় বেশ অনেকজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা যেন সুবিধার্থে একসঙ্গে থাকার জন্যে এখানে বসবাস করছেন। প্রত্যেকেরই ছোট্ট ছোট্ট এক একেকটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাট। ইচ্ছে মতো নিজেদের রান্না করার ব্যবস্থাও আছে। যদিও সবাই একসঙ্গে লম্বা ডাইনিং এ বসে গল্প করতে করতে খেতেই পছন্দ করেন। খাওয়া দাওয়া, দেখাশোনা, ডাক্তার বদ্যি – সব কিছুরই সুবন্দোবস্ত। কারুর নিজেদেরই যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি আছে সায়াহ্নে থাকার, কারুর কারুর ছেলেমেয়েরা সে ব্যবস্থা করেছে। এরকম জায়গায় মা বাবাকে রাখাও যে একটা বিরাট সোশ্যাল স্ট্যাটাসের মধ্যে পড়ে সে তো বলাই বাহুল্য। সায়াহ্নের খ্যাতির আরেক কারণ সায়াহ্নের বাসিন্দারা। বৃদ্ধ বয়েসেও এনারা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপর। সব সময় পরিপাটি, ফিটফাট। সায়াহ্নের বর্ষবরণ, রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান দেখতে ভিড় হয় প্রতি বছর।

আজও সায়াহ্নের সামনে একটা জটলা। কিন্তু সে ভিড়ের সর্বত্র মন খারাপের, শোকের ছাপ। সায়াহ্ন থেকে আজ একজন বিদায় নিয়েছেন। সায়াহ্ন থেকে বিদায় নেওয়ার অর্থই জীবনকে বিদায় জানানো, আর বাদবাকি সব কিছুকে বিদায় জানিয়েই তো সায়াহ্নে আসে লোক। এমার্জেন্সি বেলের আওয়াজ শুনে সঞ্জয় অনামিকার ঘরে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ।

সায়াহ্নের সব অধিবাসীরা চোখের জলে অনামিকাকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন। নামিয়ে আনা হয়েছে অনামিকার পার্থিব দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা রওনা দেবে পিস হাভেনের উদ্দেশ্যে, ওনার ছেলের ফিরতে সময় লাগবে। গাড়ি ছাড়ার আগে সঞ্জয় পেছন ফিরে একবার দেখল সায়াহ্নকে। বারান্দায় জানলায় মুখের সারি। হঠাৎ ওর মনে হল গোটা সায়াহ্নটাই যেন একটা পুতুলের আলমারি। বাইরে থেকে ঝকঝকে ফিটফাট, কিন্তু তার আড়ালে বোবা কান্না, অনুভব করেছে সঞ্জয় বহুবার এ ক’বছরে। আজ একটা পুতুল ভেঙেছে, একটা জায়গা খালি হয়েছে। কাল আরেকটা পুতুল আসবে, বসবাস করবে ওই একই জায়গায় আর অপেক্ষা করবে ভেঙে যাওয়ার।

 

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top