ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র” – পঞ্চদশ পর্ব
(ষোল)
আজকের অপারেশনটায় যথেষ্ট ঝুঁকি আছে।
গোপন সুত্রে খবর পেয়েছে লোকটি নগদ দু’লাখ টাকা নিয়ে আসবেন। নন্দীনি হোটেলের পাশে মিয়া নগর লেনের মুখে ওৎ পেতে থাকতে হবে চার জনকে। রাস্তার উপর পানের দোকানটায় এর মধ্যে কয়েকবার যাতায়াত হয়েছে। এই প্রথম তিমিরের হাতে থ্রি-টু বোরের পিস্তল উঠেছে। পিস্তলটা হাতে দিয়ে বুকে জোড়ে একটা থাপ্পর দিয়ে মফিজ বললো-সাহস রাখবি। দিজ ইজ এ বিগ অপারেশন। সো বি কেয়ার। এতে ছয় রাউন্ড আছে। প্রয়োজনে সবটাই চালিয়ে যাবি।
টিউশনিগুলো নামে মাত্র চলছে। আগের মত আন্তরিকতা নেই। পড়ানোর সিষ্টেমটা একটু ভিন্ন বলে গার্ডিয়ানরা সহজে ছাড়তে চায় না। সব চাইতে বড় কথা ছাত্ররা খুব পছন্দ করে। বেতন বাড়ানোর অজুহাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করলেও নেহায়েত ছোট লোক ভাববে মনে করে আর ছাড়া হয় না। প্রসংগটা বাদ পরে যায়। ছাত্রদের পড়াতে বসে যখন পুঁথির নীতিবিদ্যা শিক্ষা দেয় তখন আপনা আপনি তিমিরের মাথাটা নুইয়ে আসে। ছাত্র ছাত্রীদের চোখে চোখ রাখতে পারে না।
জগতটাই বিচিত্র সব মানুষে ঠাসা। যে যার ভূমিকাই অভিনয় করছে মাত্র। কেউ রাম সাজছেতো পরক্ষনেই আবার রাবণ হয়ে যাচ্ছে। একজন মানুষ যত কাছেরই হোক সে আরেকজন মানুষ সম্পর্কে কতটুকুই বা জানে। এক একটা মানুষ যেন এক একটা পৃথিবী। প্রতিটা মানুষের অভিন্ন স্বত্বা। আলাদা স্বকীয়তা। একটা মানুষের পক্ষে একটা পৃথিবীর কতটুকুই বা জানা সম্ভব।
অনন্তদা ইদানীং তিমিরের চাল চলন কিছুটা আঁচ করতে পারলেও সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছে না। মনের ধারনাগুলোকে সব ভুল বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। এমন সব যুক্তি খুঁজে যেন সুর্যদেব যদি কখনও ভূল করে পশ্চিমে উদিত হয় তিমিরের পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়। এটা মানুষের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। চল্লিশোর্ধ চার সন্তানের জননী যখন বিশ বছরের যুবক কিংবা শ্বাশুড়ী যখন মেয়ে জামাইয়ের হাত ধরে লাগামহীন ঘোড়ার মত ছুটে চলে, অজানার উদ্ধ্যেশে পাড়ি জমায় তখন এসব নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হয়। তবুও অবিশ্বাস্য নয়। প্রতিনিয়ত ঘটছে। সমাজটায় এমন। পৃথিবীর কোন কিছুই যেন অবিশ্বাস্য নয়।
অনন্তদা বেশ কিছুদিন দূরে থেকেও সুবিধা করতে পারেনি। বোনের বাড়ীর পাশেই ছোট একটা মুদি দোকান দিয়ে বসেছিল। পুঁজি যোগান দিয়েছিল ভগ্নিপতি। যা দিয়েছিল বাকী দেওয়া আর ভগ্নিপতির ব্যাক্তিগত ব্যবহারেই বেশীদিন ঠিকিয়ে রাখতে পারেনি। ভগ্নিপতির সাথে কয়েকদিন চাষ বাস করেও তেমন সুবিধা হয়নি। লোকজন ঠিটকারি দিচ্ছে। একদিন কাউকে না বলে চলে এসে তিমিরকে বলল-এখানে আমার জায়গা না হলে কোথাও হবে না।
– ঠিক আছে তোমার যে ক’দিন ইচ্ছা থাকো। আমার কোন আপত্তি নেয়। তুমি থাকলে বরং আমি একটু স্বস্তি পায়। তিমির আশ্বাস দেয়।
কথাটা শুনে অনন্তদার বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠল। অনন্তদা থাকলে অন্ততঃ হোটেলের ভেজাল খেতে হয় না। তিমিরের নিজের রান্না করার সময় কোথায়। নিয়মিত ড্রাগ নেওয়ার ফলে শরীরটা কেমন নেতিয়ে পরেছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা কমে এসেছে। সামান্য বিষয়ে রেগে যায়। কেমন যেন দিন দিন হিং¯্র হয়ে উঠছে। সন্ধ্যার সময় রান্নাটা ঠিকমতো করে রাখতে বলে তিমির বেরুতে যাচ্ছিল। শেলী পর্দা সরিয়ে হাসি মুখে বলল-রান্না করতে হবে না। মা আমাদের ওখানেই রাতের খাবারটা খেতে বলেছে।
– মাসীমা হঠাৎ নিমন্ত্রন করে পাঠিয়েছে, ব্যাপার কি। উনার শরীর ভালো তো।
– শরীর ভালো। তবে ব্যাপার কি জানি না। মা বলেছে আর অমনি চলে এলাম।
– আমি তো আরও বেরুচ্ছিলাম।
– মা বলেছে আপনার জন্য নাকি একটা সারপ্রাইজও আছে।
শেলীর চোখে মুখে আনন্দ খেলা করছে। আজ শাড়ী পরেছে। হালকা বেগুনি রংয়ের শাড়ী। পাড়ে নিখুঁত সুচী কাজ। সম্ভবত মা করে দিয়েছে। লম্বা চুলের বড় খোঁপায় দু’টো রজনীগন্ধাও গুঁজে দিয়েছে। কোনো বিউটিশিয়ানের চেয়েও চমৎকার।
তিমির বেরুতে গিয়েও খাটের একপাশে বসল। বেরিয়ে যাওয়াটা কেমন অভদ্রতা । শেলীর প্রতি একটা দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে সেদিনের ঘটনাটার পর তিমির নিজের থেকে কখনও দেখা করতে যায়নি। শেলী নিজে থেকে এসেছে। কেন আসে তিমির তাও আন্দাজ করতে পারে। যতবারই দেখা হয়েছে শেলী সেদিনের ছিনতাই-এর ঘটনাটা বেশ ফলাও করে বলেছে। আরও বলে একজনকে মাঝে মধ্যে এই গলিতে দেখা যায়। আমার ইচ্ছা করে দিন দুপুরে রাস্তার উপর কলার চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করতে। সে দিন যে তুমি-ই ছিনতাই করেছো। টাকাগুলি এক্ষুনি ফিরিয়ে দাও। পারি না কারণ আমরা মেয়ে।
তিমিরের ভীষন ভয়। কখন না জানি বলে ওঠে আপনি ছিলেন সেদিন। ট্যক্সির সামনে দাড়িয়ে। যদি চিনতো তো বলেই ফেলতো। শেলীর মুখে কোন কথায় আটকায় না। তিমির ভয় চেপে বলেছিল, মেয়েরা সবাই আজরা জেবিন হয়ে উঠলে কোন ছিনতাইকারী ছিনতাই করার সাহস করতো না। তবে তো মেয়েরাও ছিনতাই শুরু করবে। তা নয়তো সব পুরুষকে ব্রুসলি কিংবা বাংলা সিনেমার নায়ক হতে হবে। বলল শেলী।
সময় ঘনিয়ে আসছে। কিছুক্ষনের মধ্যে সবাইকে একত্রিত হয়ে প্লান করতে হবে। কথা হয়েছে রাত ন’টার মধ্যে সবাই নন্দীনি হোটেলে গিয়ে বসবে। তিমির উঠতে চাইল। বলল-শেলী, আমার কিছু জরুরী কাজ আছে। মাসীমাকে বলো আর একদিন খাবো। আর সারপ্রাইজটাও যেন থাকে।
– কিন্তু সারপ্রাইজ তো আর একদিনের জন্য বসে থাকবে না।
শেলীর পাংশু মুখ। তার বিশ্বাস ছিল এ আবদার অন্ততঃ তিমির প্রত্যাখান করবে না। শেলী এখন মাঝে মধ্যে দাদা সম্বোধন করে। টিউশনির পর থেকে পারিবারিক সম্পর্কটা এখনও ভালো ভাবেই ঠিকে আছে। তিমিরের যাতায়াত অনেকটা ঘরের ছেলের মতোই।
তিমিরের ইশারা পেয়ে অনন্তদা একটু আগেই বেরিয়ে পরেছে। কিছু খাবার আনতে হবে। তিমির ইতস্তুত বোধ করছে। এখনি হয়তো জিজ্ঞাসা করবে আপনি সবকিছু এভাবে এড়িয়ে চলেন কেন। প্রশ্নটা আরও কয়েকবার করেছে শেলী। প্রায়ই নিশ্চুপ কিংবা শুনেও না শোনার না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়ে গেছে। এড়িয়ে চলার একটা আনন্দ আছে। পরোক্ষ একটা কৌতুহল থাকে। যা তিমিরের খুবই পছন্দ।
– একটা কথা বলবো। জিজ্ঞাসা করল শেলী।
– বলো।
শেলী ভীত হরিনীর মতো একপলক তাকায়। তিমিরের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং ভালোবাসার মিষ্টি কথা শুনলে কেবল উপহাস করতে মন চায়। কেউ শান্তনা দিলেই মনে হয় নিজের দুর্বল জায়গায় প্রচন্ড আঘাত করছে। আরে বাবা, চাকরী করছি না তো কি হয়েছে। কারও ঘাড়ে বসে তো খাচ্ছি না। অত নীতিবাক্য কেন। হাত ঘড়িতে সোয়া আটটা বাজলো। হোটেলে পৌঁছতে কমপক্ষে আধাঘন্টা।
– চৈতী দিদির বিয়ে হয়ে গেছে শুনলাম।
– হ্যাঁ, সে তো অনেক আগে। খুব ভালো ঘর। ছেলেটাও উপযুক্ত। ও খুব সুখে আছে। তিমির চায়নি এই অসময়ে চৈতীর কথা উঠুক।
– আপনি জানেন।
– নতুন বিয়ে। সুখে থাকারই কথা। বিয়ের দুই তিনমাস পর আমার কাছে একটা চিঠি দিয়েছিল। তুমি পড়বে।
– আপনার আপত্তি না থাকলে বাসায় গিয়ে পড়তে পারি।
তিমির মানিব্যাগ থেকে চিঠিটা শেলীর হাতে দিয়ে বললো আবার ফিরিয়ে দিও। মানি ব্যাগে চৈতীর একটা ছবিও ছিল। এই সেদিন আর ধরে রাখা যায়নি। ছবির পেছনে শুধু লেখা ছিল ”হৃদয়”। অনেক পুরানো সাদা কালো ছবি। উপরের ক্যামিকেল উঠে গিয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। তবুও একটা স্মৃতি যেন সারাক্ষন জড়িয়ে থাকত। একটা প্রান ছিল। অথচ আর শেষ রক্ষা হয়নি।
পাবলিকের লাঠির ভয়ে দৌঁড়াতে গিয়ে ব্যাগটা পরে গিয়েছিল রাস্তায়। অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে ছবিটাও ছিল। তিমিরের ছবিটাও ছিল। পেছনে লেখা ছিল পুরো নাম ঠিকানা। বুদ্ধিমানের মত কিছুক্ষন থেমে ব্যাগটা আবার কুড়িয়ে নেয়। পুলিশের হাতে পরলে তো ভিটে ছাড়া করবে। তাছাড়া এসব দুনম্বরী কাজে সঠিক কোন ডকুমেন্ট রাখতে নেই। এই বোধটা ছিলনা। মফিজও বলেনি। ভাগ্যিস কি বিপদটাই না গিয়েছিল। মাস্তানের পকেটে মেয়ে মানুষের ছবি পাওয়া গেছে। সেটা নিয়ে পাবলিক কিংবা পুলিশ হাসা হাসি করত। পুলিশ গিয়ে চৈতীকে অপমান করত। সংসারে ভাঙ্গন ধরত। আর ভাবতে পারে না তিমির। একজন মাস্তানও যে ভালোবাসতে পারে সেটা বোঝাতো কি করে।
অনন্তদা দু’টো সেভেন আপ আর দু’পিস কেক নিয়ে দু’জনকে দেয়। শেলী প্রথমটায় আপত্তি করলেও শেষপর্যন্ত খেয়ে নিল। তিমির একটু খেয়ে বাকীটা অনন্তদার জন্য রেখে দেয়। চলে যাচ্ছিল শেলী। একটু থেমে বলল-কাল একবার আসব। আপনার সময় হবে।
– এসো। তবে বিকালের দিকে।
তাড়াহুড়ো করে বেরুতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে ভীষণ হোঁচট খেল তিমির। এই মুহুর্তে মনের সন্দেহটা বেড়ে গেল।
চলবে———