অনেক কথা২৩
আমিরাতে দুই হাজার বছর–
এবার আমিরাতে দুই হাজার বছরের তাৎপর্যটা বলি, সতের বছরের ছেলে ছত্রিশ বছর বিদেশে অবস্থান করার পর সে ছেলে আর ছেলে রয় না; হয়তোবা রোগাক্রান্ত মৃত্যু পথপথি একজন, না হয়তোবা লাঠি আশ্রিত বাঁকাদেহী পুরাপুরি বৃদ্ধ একজন।
ঊনিশ শ নিরানব্বই সালের কথা, বহু কষ্টের সুদির্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটা প্লাটফর্মে উপনীত হয় সে। ছোটখাটো একটা মোটরপার্টেসের ব্যবসা করছে। চরম উন্নতির দেখা না পেলেও ভালই কাটছে দিন। কিন্তু, একথা কি কখনো অস্বীকার করা যায়–সুখের দুয়ারে সব সময় অশুভছায়া এসে দাঁড়ায়। তার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় পড়ল মহাবিপদে। ভিসার কী সমস্যা সমাধানে কেটে উঠতে পারছে না। দেশফেরত হতে বাধ্য। তাকে উদ্ধার করতে হবে। তার দোকানটার ভার নিতে হবে। নিল। পাঁচ-কি-ছয় মাস থালা ঝুলে রাখার পর সময় এল দোকানটা খোলার–আত্মীয়কে ভিসা দিতে হবে। মাঝে মাঝে একাজে ওকাজে দোকনটা খুলছে, কিছু কিছু সময় বসে জরুরি কাজকর্ম সারছে। কিন্তু ইতোমধ্যে একটা আইন জারি হয়েছে, যেকেউ অন্যত্র কাজ করতে পারবে তবে (মিনিস্ট্রী অফ ইন্টিরিয়র) লেবারকোর্ট থেকে ছয় মাসের ছাড়পত্র নিতে হবে। সেই আইনানুযায়ী ছয় মাসের ছাড়পত্র নেওয়া হল তার। তবে ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ-তারিখানুযায়ী সেই ছাড়পত্রটি তাকে প্রদান করা হয়েছে চার মাসের জন্যে। এটা অযৌক্তিক নয় এবং আইনের বাইরেও নয়। যেদেশে বাস করা হয় সেদেশের আইনকে শ্রদ্ধা করা কর্তব্য–অবশ্য করতে হবে।
এবার এল ভিসা ধারণের সেই কান্নাপল! কান্নাপল এজন্যে বলছি, চোখের পলকে বর্তমানে গ্লাফপ্রবাসীদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ ভিসার মেয়াদ দুয়েক বছরের বেশি কোথাও দেখা যাচ্ছে না। যাই হোক, এটাই যখন একটি দেশের আইন এ আইন অমান্য করা কিছুতেই চলবে না এবং মেনে চলাই ভাল। যতই কষ্ট হোক, টাকার পাহাড় লাগুক একাজের সমাধা করতে হবে, নাহলে লাঞ্ছনাগঞ্জনার অবশিষ্ট থাকবে না। তাই যেভাবেই হোক ভিসার মেয়াদ সচল রাখা প্রত্যেক প্রবাসীর জন্যে মঙ্গল।
ইদানীং তার ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ। তাই বেশির ভাগ সময় দোকানটা বন্ধ রাখা হয় । আজ কী জন্যে–হয়তো ভাগ্যবিড়ম্বনায় দির্ঘক্ষণ এসে বসল দোকানখুলে। এমন সময় কয়েকজন লেবারকোর্ট-অফিসার এসে হাজির, কাজের অনুমতিপত্র চায় অর্থাৎ ওয়ার্ক পারমিট। ছাড়পত্রটা ওঁদের হাতে দেওয়া হল। একজন অফিসার ভাল করে দেখে সঙ্গিদের আরেকজনকে ডেকে বলছে, দেখ দেখ–এটার মেয়াদ শেষ হয়েছে কবে–প্রায় মাস ছুঁই ছুঁই!
হয়ে গেল ফাঁসির দণ্ডীয়মান অপরাধ। অপরাধী বিমর্ষ–ভয়ে কেঁপে কেঁপে বলল, স্যার, আরেকটা কাগজ তৈরি আছে অনুগ্রহপূর্বক একটু দেখুন। অফিসারগণ দেখল, এ কাগজটাও ছাড়পত্র বটে কিন্তু রেজিস্ট্রেশন্ করা হয় নি।
অফিসারজন বলল, একি? পরিহাস করার জায়গা এটা নয়…
অপরাধী হাতজোড় করে বলল, স্যার, সাম্মিট করতে পারি নি, কারণ আমার পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ শেষ–নবায়ন না করে এটা জমা করা যাচ্ছে না।
অফিসার একজন বলল, সেই দেখা যাবে–চল…
সপ্তা পনের দিন হাজতবাসের পর কারাবাস। শুরু হল অন্ধকার জীবনের অবাঞ্ছিত অধ্যায়। সেই জ্বালাময়ী দিনগুলোর কথা বললাম না আর। শুধু এটুকু বললাম, এক-একটি পল যেন কেটেছে তার এক-একটি মাসের মতো। এক-একটি মাস যেন কেটেছে তার এক-একটি শতাব্দীর মতো…
এধরণের নগণ্য অপরাধে যদি কোনো প্রবাসী জঘন্য অপরাধের কারাভোগ করতে হয়, তা হলে এমন দেশে বসবাসের চেয়ে বনবাস ভাল। এখানে সমস্ত পাবন্দি এবং আইনকানুন তবে ভিনদেশিদের জন্যে। স্বদেশিরা ইচ্ছে করলে রাতকে দিন–দিনকে রাত বানাতে পারে। তাদের জন্যে আইন কি আর কানুন কি। যারা লোক্যাল তাদের সাত খুন মাফ! বলা বাহুল্য, একজন অতিথির প্রতি আতিথ্য করা যেমন গৃহস্থের কর্তব্য, বিদেশিদের প্রতি তেমন উত্তম আচরণ করা একটি রাষ্ট্রের এবং তার নাগরিকের কর্তব্য। সকল প্রবাসী অতিথির মতো।
আইন! আইন!! আইন!!! আইনের এ কঠিন শব্দ ভিনদেশিদের কানে এসে শেষ। সকালে এক আইন! বিকালে আরেক আইন! প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ধারা, নতুন নতুন আইন একমাত্র ভিনদেশিদের জন্যে। ভিনদেশিরা সব সময় ভয়াতঙ্কে দিন কাটছে, কখন কী আইন হয়ে বসে! সকালে ঘুম থেকে জেগে কখন যে দেখতে হয় তাদের দুনিয়াটা অন্ধকার–লাখ টাকার ব্যবসাবাণিজ্য ফেলে চলে যেতে হচ্ছে খালি হাতে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসাবাণিজ্যে এত বেশি কর দিয়েও কোনো সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারছে না। কারণ, এসব দেশে কোনো ব্যবসাবাণিজ্য ভিনদেশির নামে হতে পারে না, অতএব নেই বলা যায়। তবে এখানে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ভিনদেশি। তাই করের বোঝা বইতে বইতে ছোটখাটো দোকানদারেরা–ব্যবসায়ীরা মরেই যাচ্ছে। কারণ আমাদের দেশের মতো করফাঁকি দিতে পারলে বাঁচামরার কোনো কথায় আসত না। এসব দেশে লক্ষ-হাজার টাকা ত দূরের কথা, সিকি-আধুলি-এক টাকা করফাঁকি দেওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই। তাই বলে এসব দেশ আজ উন্নতির চূড়ায়। তাই কোনো কোনো ব্যবসায় লাভ করেও লোকসান গুনতে হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীরা তাড়াতাড়ি ব্যবসা গুটিয়ে অন্যপথ খুঁজতে হচ্ছে। কোনো কোনো দোকানে মাস শেষে হিসাব করলে দেখা যায় দুয়েক শ টাকাও জমা হচ্ছে না! এসমস্ত দোকানিরা বছর শেষে কাঁদাকাটি জোড়তে হচ্ছে–মোটা অঙ্কের লাইসেন্স ফি, ভিসা ফি, এ ফি, ও ফি, করফি ভরতে ভরতে দেখা যাচ্ছে অনেক ঋণ হয়ে গেছে। এসব ঋণ শেষ হতে-না-হতে আবার ঘুরে আসছে বছর! ফি দিতে দিতে একদণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না তারা! স্বদেশিরা মনে করছে, টাকার পাহাড় নিয়ে যাচ্ছে প্রবাসীরা। কিন্তু তারা একথা একটুও চিন্তা করছে না যে ভিনদেশিরা ছাড়া এসব দেশ কীভাবে ডেভেলাপ করা সম্ভব হত? তবু ভিনদেশিরাই অপদার্থ! কারণ দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্যাদা বুঝে না। এভাবে চলছে গ্লাফপ্রবাসীদের করুণজীবন।
শেষপর্ব
চলবে…