উটন দাদুর কাহিনী—১২ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
কিছুটা গিয়েই নদী–আমাদের নৌকো কোন ঘাটে আছে তার কোন ঠিকানা ছিল না। আমি আর আমার সাথী দুইজনেই নদীতে ঝাঁপ দিলাম। দেখলাম নদীর পার থেকে বুনোরা আমাদের দেখে তীর মারা শুরু করেছে। বলতে বলতে একবার,আঁ,করে লোকটা তার কথা বলা থামিয়ে দিল…ওর এক নাগাড়ে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল হবে।
উটন তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,কি হল ?
–ব্যথা,ভীষণ পিটিয়েছে বুনোগুলো। ছুরি দিয়ে দু চারটে পোঁচও মেরেছে। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করল, নদীতে সাঁতরাতে সাঁতরাতে পেছনে চীৎকার শুনতে পেলাম। আমার সাথী উঁ উঁ করে চীৎকার দিয়ে উঠলো–চোখ ফিরিয়ে দেখলাম,সাথীর গায়ে তীরের ফলা গেঁথে গেছে। আমি আর তাকালাম না কোন দিকে–স্রোতের অনুকূলে যতটা পারি এগিয়ে চললাম। রাত নেমে আসলো। কোথায় এলাম বোঝা যাচ্ছিল না। শেষ রাতের দিকে নদীর পারে উঠে ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেলাম।
আবার থামল লোকটা–খুব হাঁপাচ্ছিল। উটন আবার হাতের অঞ্জলি ভরে জল এনে ওর মুখে ঢেলে দিল।
–আর বেশী সময় নেই–সন্ধ্যের পরেই ওরা এসে পড়বে। আজকে নিশ্চয় ওরা আমাকে কেটে ফেলবে। ওরা আমার মাংস খাবে।
উটন বলে উঠলো,আমার কাছে বন্দুক আছে,আরও লোক আছে,তুমি তোমার কথা বল।
আর কি,জঙ্গলের ভেতর সকাল হল। এক সময় আমি প্রচণ্ড খিদেতে গাছের তল থেকে কুড়িয়ে ফল,পাতা খাচ্ছিলাম। এমনি সময় কোথা থেকে পাঁচ নেংটা বুনো এসে আমায় ঘিরে ধরল ! আমার কোন ভাষাই ওরা বুঝল না–চাঁই চুই চিক চিক কিচমিচ করে আমায় লাঠির বাড়ি মেরে ঘায়েল করল। দু,তিন জাগায় ছুরি দিয়ে আঘাত করল,আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। তারপর আজ দুদিন হল ওরা আমায় এখানে বেঁধে রেখেছে।
–ওরা তোমায় খাবে,এ কথা কি করে বুঝলে তুমি ? উটন প্রশ্ন করল।
দেখেছি ওরা নিজেদের মাংস খায়। যে মানুষ মরে যায় তাকে কেটে ওরা মাংস খায়। আর আমি তো–আর কথা বলতে পারল না লোকটা। হাঁপাতে হাঁপাতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে পড়ে থাকলো।
উটন তার ঝোলা থেকে কিছু খাবার বের করে ওকে দিল। খাবার গুলোর দিকে লোকটা আগ্রহ ভরে দেখল। কিন্তু খাবার সময় খুব ধীরে ধীরে মুখে দিয়ে হালকা হালকা চিবিয়ে কষ্ট করে গিলে ফেলল। ওর যে সমস্ত শরীরে ব্যথা ও কি করবে বেচারা ?
কিছু সময় চুপ করে থেকে উটন আবার বলে উঠলো,তা হলে আমরা পালাব কি করে ? আমাদের বাঁচার কি কোন পথই নেই ? বুনোরা কি আমাদের কোন কথাই বুঝতে পারবে না ? কোন রকম শিক্ষা গ্রহণ করার মত অবস্থা কি ওদের নেই ?
লোকটা আস্তে আস্তে বলে যেতে লাগলো,না ওদের কিছু নেই–ভাষা নেই—দয়া,মায়া নেই—ওরা বনের জন্তুদের মত–ওদের ধর্ম নেই–শুধু হিংস্রতা আছে–
–তবে আমরা বাঁচব কি করে ? উটন তার ভাবনার কথা বলল।
বাঁচার কোন উপায় নেই–উটনের দিকে করুণ তাকিয়ে লোকটা বলল,বন্ধু ! আপনার বন্দুক আর কতক্ষণ ! যখন ওরা দেখবে আর আওয়াজ নেই তখনি ওরা আক্রমণ করবে। হয়তো তখনই ওরা আপনাকে কেটে ওখানেই মাংস খেতে শুরু করবে।
–উটন বলে উঠলো,বাপরে,বাপ–কি ভয়ঙ্কর !
— এখানে এত দুর্গন্ধ কেন ? উটন লোকটাকে জিজ্ঞেস করল।
–মানুষ কেটে এখানেই তো খায়,কখনও ভাগাভাগি করে বাড়ি নিয়ে যায়,লোকটা জবাব দিল।
উটন উঠে দাঁড়ালো–টর্চ নিয়ে ঘুরে ঘুরে চারদিকে দেখতে লাগলো, বিশ্রী দুর্গন্ধ চার দিকে। এক জাগায় কালো একটা পাথর তাতে চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে মনে হল। তার মানে হতে পারে ওদের দেবতা এটা। দেবতা ধরনের ওই পাথরটা বেশ লম্বা আর উঁচু ! উটন পাথরের কাছটায় গেল। হঠাৎ উটন আশ্চর্য হল,তার থেকে কিছুটা দূরে,পেছন দিকের লম্বা দেওয়ালের পাথরের ওপর সরু,লম্বা কিছু একতা চকচক করে উঠল! ওটা সোনার চেন না তো—উটন তাড়াতাড়ি ওটার কাছে গিয়ে হাত দিয়ে ধরতে গেল। ধরা যাচ্ছিলো না ওটা–জিনিসটা তা হলে কি ? টর্চ মারল উটন। ভাল করে দেখে বুঝল,কিছু না–একটা আলোর রেখা মাত্র ! আসলে ওটা সোনা বা রুপোর চেন না–অতীব ক্ষীণ লম্বা একটা আলোর রেখা–তবে কোথা থেকে এলো আলো ? পাথরের কাছে গিয়ে উটন পরীক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎ তার মনে হল আরে এটা ত সূর্যের আলো। এখন সূর্য নিশ্চয় পশ্চিম আকাশের দিকে ঢলেছে। এ তারই আলো। পাথর পার করে মন্দিরের বাইরে কি কোন খোলা জাগা আছে ? হতে পারে কোন গুপ্ত পথ ! যে কোন কারণে হোক এই মন্দিরের ঘরের পাশ দিয়ে বানানো হয়েছে গুপ্ত পথ–যার শেষ হয়েছে নিরিবিলি কোন গুপ্ত স্থানে। সূর্যের আলো হয় তো মুহূর্ত সময়ের জন্যে এই এঙ্গেলে চেনের আকার সৃষ্টি করে আবার সরে গেছে।
হ্যাঁ,ঠিক তাই,উটন দেখল,এখন সেই চেন আর নেই–সে বুঝতে পারল,এই পাথরের অন্য পারে হয়তো কোন রহস্য রয়ে গেছে। কি সে রহস্য ? জানার জন্যে সে আরও এগিয়ে গেল—দেখল মন্দিরের দেওয়ালের গায়েই বিশাল আর একটা সাইজ করা বর্গাকার মত টুকরো পাথর। তার এক দিকের চিলতে ফাঁক দিয়ে সামান্য আলোর রেখা তখনও চোখে পড়ছে। পাথরের ফাঁক দিয়ে তাকাবার চেষ্টা করল,হ্যাঁ দেখা যাচ্ছে–কিছু সময় চোখ রেখে বোঝা গেল বাইরে অনেকটা খোলা জাগা আছে। উটনের কেন যেন মনে হল যে এই পাথরে কোন রহস্য তো নেই !
পাথরে ধাক্কা লাগাল ও–মনে হল খুব সহজে ওটা নড়ে উঠলো। আরও একটু জোর লাগিয়ে ঠেলার চেষ্টা করল–আরে পাথর একদিকে কিছুটা সরে গেল। তাই তো–বাইরের আবছা আলোর প্রকাশ খানিকটা জোরালো হয়ে গেল। আরও ধাক্কা লাগাতেই পাথর পাশটাতে আরও সরে গেল। উটন এবার বাইরের সূর্যের স্তিমিত আলো দেখতে পেল–বাইরে খোলা জাগা রয়েছে, ছোটবড় ঝোপ ঝাড় রয়েছে। সামান্য এগিয়ে গিয়ে জাগাটা মনে হল ঢালানের দিকে নেমে গেছে আর সেই ঢালানে হতে পারে উড়ালী নদী বয়ে যাচ্ছে।
পাথর আরও একটু ঠেলে উটন ধীরে ধীরে বাইরে বেরোল–নির্জন জাগা,বুনোদের এদিকে যাতায়াত নেই বলে মনে হল। এ গুপ্ত পথ উটনদের ভবিষ্যতে পালাবার জন্যে কাজে আসলেও আসতে পারে। উটন আবার মন্দিরের চত্বরে ঢুকল—বেশ গায়ের জোর দিয়ে দেওয়ালের পাথরটাকে আবার যথা স্থানে ঠেলে রাখল।
ক্রমশ…