একজন গৃহকত্রীর মৃত্যু ….. অতঃপর ।
সমস্ত বাড়ীটা ঢেকে আছে শোকের গভীর চাদরে !
আজ ভোরেই এবাড়ীর কত্রী ফরিদা বেগম তার দীর্ঘ বিরাশি বছরের জীবনের অবসান ঘটিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন মৃত্যুর দেশে ! বেশ বনেদী পরিবারের মেয়ে আর বৌ হিসেবে বেশ একটা সুখ আর স্বস্তির জীবনই কাটিয়ে যেতে পেরেছেন তিনি বলা যায় ! তার ছেলেমেয়েরাও সবাই শিক্ষিত এবং বলা যায় যার যার ক্ষেত্রে ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত !
তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরেই এবাড়ীতে যেন সকাল থেকে নেমেছিল মানুষের ঢল ! আত্বীয়স্বজন আর শুভানুধ্যায়ী তো কম রেখে যাননি তিনি । যাদের সম্মিলিত কান্নার শব্দে দিনভর ভারী হয়েছিল আশেপাশের পরিবেশ ! কান্না নিয়েও যেন চলেছিল এক সুক্ষ্ণ প্রতিযোগিতা ! কে তার বেশি কাছের লোক ছিল , কে তার সবচেয়ে বেশি কাছের ছিল – সেটা প্রমানের নির্ভেজাল প্রতিযোগিতাতে যেন নেমেছিল সবাই ! আপাতত সেই প্রতিযোগিতা শেষ !
বাদ আসর মরহুমার নামাযে যানাজা শেষে দাফনও হয়ে গেল রীতিমাফিক । দায়িত্ব শেষ করে এর মধ্যেই একে একে ফিরে গেছেন শোকাগ্রস্ত মানুষেরা । শুধু রয়ে গেছে মরহুমার ছেলেমেয়ে ও তাদের পরিবার । যারা এই মুহুর্ত অবস্হান করছে মরহুমার শোবার ঘরে ! যে ঘরটিতে তিনি কাটিয়ে গেছেন শেষ দিনগুলোসহ জীবনের দীর্ঘ একটা সময় । মেয়েরা আগেথেকেই অবস্হান করছিল এ ঘরে । আর পুরুষেরা দাফনকাফন শেষ করে একবারে মাগরিবের নামায আদায় করে এই মাত্র এসে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে । আর তারা আসার পর হয়ে গেল আরেকদফা কান্নাকাটি । এ কান্না ছিল মরহুমার পরিবারের একান্ত নিজস্ব কান্না !
২ .
– এই যে মায়ের আলমারির চাবি !
আঁচল থেকে চাবির বড়সড় একটা গোছা খুলে সবার সামনের টেবিলটার উপর রাখলেন সালেহা ! তিনি মরহুমার বড় ছেলের বৌ । শ্বাশুড়ীর পর আপাতত এ বাড়ীর কত্রী হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে চাবিটা সংরক্ষণের দায়িত্ব তার উপরই ন্যাস্ত করা হয়েছিল । তিনি চাবিটা রাখারপর সবার উৎসুক দৃষ্টি একসাথে গিয়ে পড়লো বস্তুটার উপর । বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না কেউ । যেন ভেতরে ভেতরে নিজেদের গুছিয়ে নেবার জন্য সময় নিলো খানিকটা ।
– ভাবী মায়ের পর আপনিই এখন আমাদের মুরুব্বী । আপনি এ বাড়ীর বড় বৌ । আপননিই আলমারী খুলেন ।
কান্নাজড়িত কন্ঠে কথগুলো বলল মরহুমার ছোট মেয়ে রিহানা । অন্য সবার মতন তার স্বামী ছেলেমেয়েরাও সবাই এখন এঘরে ।
– তা হয় না রেনু । তোমরা মায়ের ছেলেমেয়েরা সবাই এখানে থাকতে আমার আলমারী খোলাটা ভাল দেখায় না । তোমরাই কেউ একজন ওটা খোলো ভাই ।
খানিকটা দ্বিধা আর কুন্ঠার সাথে বললেন সালেহা ।
– আরে এটা কোন কথাই হল না ! আপনি এ বাড়ীর বড় বৌ ! সুতরাং এখন সমস্ত দায়িত্ব আপনার ভাবী !
সকলের সম্মিলিত প্রতিবাদ আর অনুরোধে ফিরিয়ে দেয়া সম্মানটা ফের গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন সালেহা ! একটু অনিচ্ছা বা দ্বিধার সাথে তুলে নিলেন চাবির গোছাটা টেবিলের উপর থেকে । তারপর এগিয়ে গিয়ে ধীরেসুস্হ খুললেন আলমারীর ডালা দুটো । তারপর সরে দাড়ান সবার চোখের সামনে থেকে যাতে আলমারির ভেতরটা ভালভাবে দেখে নিতে অসুবিধা না হয় কারুরই । সহসাই কেউ জায়গা ছেড়ে নড়ে না ! পাছে কেউ লোভী না ভেবে বসে ! তা স্বত্বেও অতি সাবধানী আর তীর্যক দৃষ্টি মেলে এক নজরে আলমারীর ভিতরটা যথাসম্ভব দেখে নিতে ভুল হয় না কারুরই !
খানিকক্ষণ কাটার পর আবারও সবার অনুরোধক্রমে ভেতরকার জিনিসপত্র বের করার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন সালেহা । সবার আগে সিন্দুকের ভেতরকার জিনিসগুলো একএক করে এনে রাখেন বিছানার মাঝখানে ! সবগুলোই ছিল ছোট বড় নানান আকারের গয়নার বাক্স ! এই মুহুর্তে সবার মধ্যই যেন বিরাজ করছে একটা টানটান উত্তেজনা ! না জানি কি না কি কত্ত কিছু বের হয় ওগুলো থেকে !
একে একে খোলা হল সব বাক্স । যা বেরুলো নেহায়েৎই কম কিছু নয় ! তারপরেও বুঝি হতাশ হল কেউ কেউ । হয়তো আরো অনেকবেশি কিছু বেরুবে বলে আশা করেছিল তারা ।কি কি বেরুল তাহলে ? একটা অনেক পুরনো ডিজাইনের ভারী নেকলেস ।ওজন হতে পারে কমপক্ষে পাঁচ ছয় ভরি । প্রায় সমান ওজনের একজোরা বালা । ছয়টা সোনার চূড়ি । বেশ কয়টা আঙটি আর গলার চেইন । একটা হীরে বসানো নাকফুল । এসবই ফরিদা বেগমের প্রথম যৌবনের অতি শখের বস্তু সব । যা বহুকাল আগে স্বামীর মৃত্যু হবার পর আর ব্যবহার না করে সযত্নে তুলে রেখেছিলেন একান্ত স্মৃতি হিসাবে ।
কয়েকমুহুর্ত আগে যে মুখগুলোতে ভর করেছিল হতাশার মেঘ , সে মুখগুলোই ফের উজ্জ্বল হতে সময় নিলো না খুব বেশী । দ্রুত নড়েচড়ে বসলো যেন সবাই ! সর্বপ্রথম দখল হয়ে গেল ভারী নেকলেসটা ।
– মা সব সময় বলতো , ওরে রোকেয়া এটা আমি তোর মেয়ের জন্য রেখে দিয়েছি যত্ন করে ! ওর বিয়ের দিন এটা আমি নিজের হাতে ওর গলায় পরিয়ে দেবো ! ও খোদা , তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন ? আমার মায়ের এই সামান্য ইচ্ছা পূরণের জন্য আর কয়টা দিন মাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলা না তুমি খোদা !
নেকলেসটা বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে হাহাকার কে ওঠে রোকেয়া বেগম । মরহুমার বড় মেয়ে ।
রোকেয়ার তৎপরতা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় ঘরে উপস্হিত বাকী সবাই ! কিন্তু এনিয়ে কেউ কোন প্রতিবাদ করে না পাছে অন্যরা তাকে লোভী ভেবে বসে – এই ভয়ে ! যা যাবার গেছে – এখন বাকী জিনিস জিনিসগুলোর দিকে নজর দেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ !
– এই বালাজোড়া আমি রাখি মায়ের স্মৃতি হিসবে ?
বালাজোড়া দুই হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে সবার দিকে শোকাহত করুন দৃষ্টি মেলে তাকায় আরেক মেয়ে ফিরোজা !
না ! এবারও কেউ কোন আপত্তি তোলে না ! এখানে সবাই বিশাল মনের অধিকারী !
দেখতে দেখতে পুরো আলমারিটা খালি হতে খুব বেশি সময় নেয় না ! ভাগ হয়ে যায় বহু বছর ধরে সংরক্ষন করে আসা যাবতীয় সম্পদ ! বঞ্চিত হয় না কেউই ! কম বেশী কিছু না কিছু স্মারক মিল সবার ভাগ্যেই ! কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশাল আলমারীটা নিজের গহ্বরের শেষটুকু উগড়ে দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য পেটে ।
– দাদীর আলমারীটা আমি নেব । আমার পারসোনাল জিনিসপত্র রাখার জন্য এটা খুব দরকার !
সবশেষে নিজের দাবী পেশ করে মরহুমার বড় ছেলের ঘরের নাতি সোহান । এবারই স্কুল পেরিয়ে মাত্র কলেজে ঢুকলো ! সুতরাং নিজস্ব জিনিসপত্র নিজ হেফাজতে রাখার প্রয়োজনটা এখন থেকেই দেখা দেবে তার !
পরিশিষ্ট :
– বড় আপার কারবারটা দেখলে ভাবী , কেমন সুন্দর করে সবচেয়ে দামী জিনিসটা কেমন করে দখল করে নিলো । বলে কিনা মা বলে গেছে ! আরে মা বললে কি আমরা কখনো জানতাম না নাকি ! আর মার কাছে থাকতিই বা কতোক্ষণ তোরা ? আসতি তো সেই অসুখ বিসুখের খবর পেলে মাসে ছয় মাসে একবার । তাও বাপের বাড়ি নাইওড়ের বেড়ানি বেড়াতে ! সারাদিন আমাদের হাড় মাংস জ্বালিয়ে তারপর ফিরতি সব !
– তুই ঠিকই বলেছিস রে ছোট ! সারা জীবন বুড়ির দেখাশুনা করলাম আমরা । অসুখের সময় রাত জেগে সেবা করলাম ! বুড়ির হাগামুতা অবধি ঘেঁটেছি এই হাতে ! কিনন্তু শেষমেষ কি পেলাম বল ! লোভী বদমায়েশগুলো কি সুন্দর কাঁচকলা দেখিয়ে দিয়ে গেল আমাদের !
সবাই চলে যাবার পর নিজেদের কষ্টের ঝাঁপি খুলে বসে বাড়ীর দুই বৌ !!!! ( শেষ )