মুক্তি যুদ্ধের গল্প (৪র্থ পর্ব )
শুভদের বাসায় গিয়েছিলাম মাঝে এক শুক্রবার চলে গিয়েছে। অর্থাৎ ১৫ দিন আগে। এর মধ্যে একদিন ফোনে কথা হয়েছে, সেও এ সপ্তাহে নয়, গত সপ্তাহে। এত দীর্ঘ বিরতি নেওয়া আসলে ঠিক নয়। ছেলে দুটির জন্য মায়া হয়। মা প্রবাসী, বাবা থেকেও নেই। শুধু মাত্র বৃদ্ধা নানীই তাদের সম্বল। আর এ কারনেই সম্ভবত আমার উপস্থিতিতে ওরা এতটা আনন্দিত হয়। তাই ওরা আমার কোন আত্বীয় না হওয়া সত্বেও আমি না গিয়ে থাকতে পারি না । তা ছাড়া আত্বীয় নয় কথাটা আমি সঠিক বলে মনে করি না । আসলে আমরা রক্তের সম্পর্কের লোকদেরকেই সাধারণ ভাবে আত্বীয় বলে মনে করি। কিন্তু আত্বীয় স্বজন আসলে কি তাই? আমি মনে করি আত্বার সাথে যার সম্পর্ক সে-ই আত্বীয় । সেখানে আবার রক্তের সম্পর্ক আসে কোথা থেকে? আর স্বজন বলতে নিজের লোকদেরকেই বুঝায়। সে অর্থে শুভ, অনিরুদ্ধ আমার অনেক নিকটতম আত্বীয়। তাই দীর্ঘ বিরতিতে মনটা বেশ খারাপ লাগছিল । মনে হচ্ছিল ছেলে দুটি সম্ভবত মন খারাপ করে অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাস্তবে অবশ্য সেটা নাও হতে পারে। কারণ তারা ছোট সময় থেকেই ঐ পরিবেশে মানুষ হয়েছে। আমার তো ছোট বেলা কেটেছে গ্রামে। সেখানে বাবা মা ভাই বোন,তা ছাড়া প্রতিবেশীদের সাথে প্রতিদিনের দেখা শোনা। কাজেই
আমার কাছে এমন মনে হতেই পারে যে, আত্বীয় স্বজন ছাড়া বসবাস বড়ই কঠিন কাজ । কিন্তু শুভ অনিরুদ্ধ এই ইট কাঠের শহরে জন্মের পর থেকেই বেরে উঠেছে। তাদের কাছে হয়তো একা থাকাকে একাকিত্বই মনে হয় না। তবু দুপুর থেকে ভাবতে ভাবতে এক সময় বেলা পরে এল। আমার মনটাও এক সময় আনচান করতে শুরু করল। আর আমিও আনমনে হাটতে হাটতে এক সময় শুভদের দ্বারে এসে পোঁছলাম। কলিং বেল চাপতেই শুভ এসে দরজা খুলেই বললো –
আরে মামা আপনি—–। বলেই একদম আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে বলল-এত দিন হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন কেন?
না ভাগ্নে, খুব জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলাম।
আমার মনে হয় কি মামা, আসলে আপনি আমাদের ভুলেই গিয়েছেন।
শোন ভাগ্নে, যদি ভুলেই যেতাম, তবে আজ আসলাম কি করে?
আমিও তো তাই ভাবছি মামা আজ আপনি আসলেন কি করে? আমি শুভর কথার জবাব দিতে দিতেই অনিরুদ্ধ এসে ঘরে ঢুকলো এবং সেও একি অভিযোগ করতে থাকলো। দুই ভাগ্নেকে আস্বস্থ করে আমি ওদের নানীর সাথে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি শুভর নানী বেশ অসুস্থ। তার বেশ জর। ডাক্তারের কথা বলতেই তিনি তড়িৎ বলে উঠলেন,
“না ডাক্তার আনতে হবে না। আমি ভাল হয়ে গিয়েছি তো।” আমি বললাম-
দেখুন, আপনি অসুস্থ। আর আমি যদি ডক্তার না দেখাই তা হলে আপনার মেয়ে শুনে বলবেন আমি আপনাদের মোটেই যত্ন নেই না। আমি যাই বলি না কেন, শুভর নানু কিছুতেই ডাক্তার আনতে রাজি হলেন না। ফলে বাধ্য হয়েই ডাক্তার আনার ভাবনা আপাতত মাথা থেকে দূর করতে হল। সেই সাথে আজকে এখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিতে হল। কারণ একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে তো আর একা বাসায় ফেলে যেতে পারি না। যদিও শুভ অনিরুদ্ধ আছে সে অর্থে একা নয়। কিন্তু তারা তো শিশু। গভীর রাতে কোন সমস্যা দেখা দিলে তারা কোন কাজেই আসবে না।
পড়ালেখা শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তার পর শোবার রুমে এসে খাটের উপর গল্প শুনার জন্য রাম রাম শ্যাম শ্যাম করে বসে পরলো আমার দুই ভাগ্নে। আমিও মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে এসে বিছানায় জায়গা নিলাম। ভাগ্নেদের বললাম-আচ্ছা শুভ- আমরা ইতি পূর্বে স্বাধীনতা সম্বন্ধে কি কি গল্প বলেছি? অনিরুদ্ধ বললো-
মামা আমরা বাংলাদেশ কিভাবে ইংরেজদের দখলে চলে গেল, তার পর শহীদ তিতুমীর এদেশের স্বাধীনতার জন্য কিভাবে যুদ্ধ করেছে, ১৮৫৭ সালে ইংরেজ বাহিনীর বাঙ্গালী সিপাহীরা কিভাবে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে ছিল সে সকল গল্প শুনেছি।
হ্যা ঠিক বলেছ। আসলে আমাদের বাঙ্গালীরা বা ভারত বর্ষীয়রাই বলো, এ জাতি কখনো পরাধীন থাকতে চায়নি। কাজেই ইংরেজরা এ দেশ দখল করার পর থেকে এ দেশের মানুষ কখনই চুপ করে বসে থাকেনি। একটার পর একটা আন্দোলন, বিদ্রোহ, যুদ্ধ করেছেই স্বাধীনতার জন্য।
আচ্ছা তোমরা কি জান, তিতুমীরের স্বাধীনতার যুদ্ধের আগেও এ দেশে আরো বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়? অনিরুদ্ধ বললো-
না মামা তাতো শুনিনি।
শুন, ১৭৬৪ সালে মীর কাসিম বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন। কিন্তু তাতেই এ দেশের মানুষ দমে যায়না। তারা দেশের ভিতর ফকির মজনু শাহ এর নেতৃত্বে ফকিরদের এক বিরাট বাহিনী গড়ে তুলেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজদের আক্রমন করে পরাজিত করে। এ দিকে ভবানী পাঠক বাংলার সন্ন্যাসীতের সংঘঠিত করে ফকির মজনু শাহের বাহিনীকে সাহায্য করতে থাকে। সেই সাথে যোগ দেয় দেবী চৌধুরাণী। ১৭৮৬ সালে ২৯ নভেম্বর ফকির মজনু শাহ লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের বাহিনীকে আক্রমন করেন। যুদ্ধে ফকির মজনু শাহ আহত হন এবং পলায়ন করেন। পরে তিনি ঐ আঘাতেই মৃত্যু বরণ করেন। মজনু শাহের মৃত্যুর পর ফকির বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে যায়। তোমরা কি মনে কর, সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ফলেই আমাদের বাংলার মানুষ একদম হাত পা গুটিয়ে বসেছিল? না বাঙ্গালীরা কিছুতেই পরাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। তবে ঐ সময় বাঙ্গালীরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না থাকার কারণেই ইংরেজদের সাথে সহজে পেরে উঠেনি।
বাংলাদেশে সব সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালু ছিল। ১৭৮০ সালে দিনাজপুরের রাজার মৃত্যু হলে তার স্থলে তার বিধবা স্ত্রী জমিদারী দেখা শোনা করতেন। কিন্তু রাজার পুত্র নাবালক এই অযুহাতে ইংরেজরা কোম্পানীর পক্ষ থেকে জমিদারী দেখাশোনা করার জন্য দেবীসিংহ নামক এক ব্যক্তিকে জমিদারী দেখা শোনা করার জন্য নিয়োগ দিলেন। ইংরেজদের এজেন্ট এই দেবীসিংহের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিদ্রোহ বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। এই দেবীসিংহ গ্রামবাসীদের নিকট থেকে “দিরীনউইল্লা” নামে বেআইনি কর আদায় করতেন, তিন আনা করে বাটা এবং বছরে জমার উপর দুই আনা করে বেশী ট্যাক্স এবং টাকা প্রতি সাড়ে আট আনা ট্যাক্স আদায় করতেন। মানুষ খজনার জন্য গবাদি পশু বিক্রী করেছে,স্ত্রী, কন্যা, মাতা, ভগিনীর গায়ের গহনা বিক্রী করেছে,সন্তান বিক্রী করেছে। এর পরও খাজনা আদায় কারীরা নিরীহ মানুষদের ঘরের খুটির সাথে বেঁধে মারধর করতেন। এক সময় রংপুরের মানুষ মরিয়ান হয়ে উঠে। তারা খাজনা আদায়কারীদের ঘেড়াও করে ফেলে এবং তাদের হত্যা করে। কৃষকরা আর কোন খাজনা দিবেনা বলে ঘোষণা দেয়। রংপুরের বিদ্রোহ পার্শ্ববতী জেলা গুলোতে ছড়িয়ে পরে। দিনাজপুর ও কুচবিহারের কৃষকেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং তাদের নেতা দিরজী নারায়নকে তাদের নবাব ঘোষণা করে। ইংরেজ সরকার বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনা বাহিনী নামান।১৭৮৩ খ্রিটাব্দে ২২ ফেব্রুয়ারী পাটগ্রামের নিকট এক যুদ্ধে কৃষকেরা পরাজয় বরণ করে। এই যুদ্ধে ষাট জন কৃষক মারা যান এবং বহু কৃষক আহতহন ও বন্ধী হন। তাদের মধে নেতৃস্থানীয় পাঁচ ব্যক্তিকে নির্বাসনে দেওয়া হয়।
জান শুভ, আমাদের এই দেশে ইংরেজরা দু শ বছর রাজত্ব করেছে ঠিকই কিন্তু একদিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। প্রাচীন আমলে আমাদের দেশে পৃথিবীর সেরা কাপড় তৈরী হতো, তাকি তোমরা জান?
না মামা। আমাদের দেশে বিদেশের চেয়েও ভাল কাপড় তৈরী হতো?
অবশ্যই, আমাদের দেশের কাপড় ছিল বিশ্বের সেরা কাপড়। তার নাম ছিল মসলিন কাপড়। ঐ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড শিল্প কারখানায় খুবই উন্নত হয়। ফলে তাদের দেশে প্রচুর কাপড় উৎপন্ন হতো। কিন্তু সে সকল কাপড় ঢাকার মসলিন কাপড়ের তুলনায় ছিল খুবই নিম্ন মানের। ফলে সারা দুনিয়া ব্যপি মসলিন রপ্তানী হতো। মসলিন কাপড়ের জন্য ইংরেজদের কাপড় বিক্রী হতোনা।সে কারণে ইংরেজরা মসলিন কাপড় তৈরী নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। এমন কি মসলিন কাপড় তৈরীর শিল্পীদের ধরে ধরে এনে তাদের আঙ্গুল কেটে দেয়। যাতে তারা আর কখনও মসলিন কাপড় তৈরী করতে না পারে।
শুভ বললো-
বলেন কি মামা ইংরেজরা এত নির্মম ছিল? বাঙ্গালীরা কিছু বলতো না?
অবশ্যই বলতো। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক বিরাট আন্দোলন গড়ে উঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় রাণী শিরোমনি। ১৭৯৯ সালে ইংরেজদের সাথে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজয় বরণ করে এবং রাণী শিরোমনি গ্রেফ্তার হন। তাকে পরবর্তী জীবন ফোর্ট উলিয়াম দূর্গে আটক করে রাখা হয়। আচ্ছা শুভ, তোমরা কি জান , নীল কি এবং নীল কর কি?
মামা নিল কি তা জানি। ওই যে কাপড়ে দেয়। তবে নীল কর কি তা জানি না।
হ্যা ভাগ্নে। এটাইতো কথা। আমাদের দেশ তো সব সময় কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের ভূমি অতি উর্বর। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব হয়। যার ফলে সে দেশে প্রচুর পরিমানে কাপড়ের কারখানা গড়ে উঠেন সে কথা আমি তোমাদের আগেই বলেছি। এই সকল কারখানার তৈরী কাপড় রং করার জন্য প্রচুর পরিমানে নীলের প্রয়োজন হয়। আর তখনি তাদের বাংলার উর্বর জমির প্রতি নজর পরে। অবশ্য প্রাচীন আমল থেকেই এদেশে নীলের চাষ হত। কৃষকেরা নিজের ইচ্ছা মতো নীলের চাষ করে নিজেরা বিক্রয় করতো.। বাংলা দেশের ফরিদপুর,যশোর,ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, ময়মনসিংহ এবং ভারতের বারাসত,মালধ,মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি জেলায় নীলের চাষ হতো। এ সকল এলাকায় প্রচুর নীল উৎপন্ন হতো। সে সকল নীল বেশীর ভাগ ইংল্যান্ডে তৈরী কাপড়ে ব্যবহার করা হতো। ফলে ঐ সময় নীল রপ্তানী খুব লাভ জনক ব্যবসা ছিল। এই সুযোগ গ্রহনের জন্য ব্রীটেন থেকে দলে দলে নীল করেরা এ দেশে এসে এদেশের কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করতে থাকে। কৃষকেরা নীল চাষ করতো, কিন্তু ইংরেজরা নীলের দাম দিত কম এবং বিভিন্ন ভাবে চাষীদের সাথে প্রতারণা করতো। চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করার জন্য এমন কোন অপরাধ নেই যা নীল করেরা করতো না। তারা খুন, দাঙ্গা, লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ, অপরণ ইত্যাদি করে কৃষকদের ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখতো। ১৮৬০ সালে দীন বন্ধু মিত্র তার নীল দর্পন নাটকে নীল করদের এসব অত্যাচারের কথা নিখুত ভাবে তুলে ধরেন। ফলে ধীরে ধীরে কৃষকেরা উত্তেজিত ও বিদ্রোহ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এক সময় চাষীরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে নীল চাষে অস্বীকৃতি জানায়। এতে চাষীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্র আন্দোলনে রুপ নেয়। ফলে ইংরেজ সরকার নীল চাষে কাউকে বাধ্য করা যাবে না মর্মে এক আইন পাশ করে। এই আইন পাশের ফলে ১৮৬০সালে নীল বিদ্রোহের অবসান ঘটে।