Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

সাঝেঁর মায়া

: | : ০৯/১২/২০১৩

সন্ধ্যা নদী।

ক্রমে পশ্চিম আকাশের সূর্য লাল হয়ে বিদায়ের ইঙ্গিত জানাচ্ছে। শান্ত সন্ধ্যা। ধরনীকে এক অপূর্ব মায়ায় আচ্ছন্ন করে সে নেমেছে আকাশ জুড়ে।
রহস্যময় পরিবেশ।
স্নিগ্ধতা।
নিস্তব্ধতা।
আবার হঠাৎ কোলাহল।

বানারীপাড়া নদীবন্দরের পাশ দিয়ে বেশ কিছুটা জায়গায় চড় পড়েছে। সাঁঝের আলোয় চড়ের রাজত্ব করছে একটি কিশোরের দল। প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা এই চড়েই আড্ডা জমায় কিশোরের এই দলটি।
দলে ভিড়তে আজ যেন একটু বেশীই দেরী করে ফেলেছে রাজু। আবার ফিরেও যেতে হবে তাড়াতাড়ি। কলেজে পরীক্ষা চলছে। তাই এত তাড়াহুড়ো। দলের অন্যদেরও এই তাড়া আছে। দেরী করে আসার অপরাধ লুকাতেই যেন সবার মধ্যমণি হতে চায় রাজু। কিন্তুু নিজ অপরাধ সে লুকাতে পারল না।
“কিরে সবাই শোক সভায় উপস্থিত নাকি?” রাজু বলল।
রাজুর উপর কিছুটা রেগেই আরাফ বলল, “তোর কাজে তুই যা। এখানে এসেছিস কেন?”
“আরে ভাই রাগ করে না, তোদের সবার জন্য সুন্দরী একটা বউ এনে দেব। আজ একটু কাজ ছিলো। তাইতো দেরী হয়ে গেলো।”
“তোর তো প্রতিদিন বাসার কাজ থাকে। কখনো মসজিদ মেরামত, কখনো মাহাফিল এর চাঁদা তোলা। আচ্ছা এই কাজগুলো কি বছরের প্রতিদিন থাকে?”
“ওর ফুপাতো বোনের যে কাজ করে দেয় তার কথা বললি না কেন?” আরাফকে উদ্দেশ্য করে জহির বলল।
এতক্ষণ চুপ করে থাকা রিপু মুখ খুলল, “আচ্ছা বাদ দে এসব। কিন্তুু রাজু তুই আমাদের সবার জন্য একটা বউয়ের কথা বললি কেন?”
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে সবার জন্য একটা করে দেব।”
আরাফ বলল, “কেন তুই কি বউ এর বাজার দিছিস নাকি?”

এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ চলে আড্ডা। পরবর্তী দিন পরীক্ষা থাকায় প্রতিদিনের চেয়ে বেশ আগেই আড্ডা শেষ হয় রাজু আরাফদের। যে যার ঘরে ফিরে যায়। কিছু কেনাকাটা করার জন্য বাজার হয়ে বাসায় ফেরে রাজু।
রাজুর মা সাহেলা বেগম। সবসময়ই চিন্তিত থাকেন তার ছেলেকে নিয়ে। এই বয়ঃসন্ধি কালের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সচেতন অবিভাবকদের চিন্তার সীমা থাকে না। এরা বেশীরভাগ সময়ই নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে না। মেজাজ থাকে খিটখিটে। কন্ঠ থাকে গাঢ়, ভারী ও গম্ভীর। ভাল কথা বললেও মনে হয় রেগে কথা বলছে। নারীর প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়, বিচিত্র খেয়াল ও ভাব মনে জেগে ওঠে। বিভিন্ন কারনে অবিভাবকদের উৎকন্ঠা যথার্থ।
সাহেলা বেগম রাজুকে বললেন, “এত দেরী করেছিস কেন?”
রাজু বলল, “বই কিনতে বাজারে গিয়েছিলাম।”
“আচ্ছা ঠিক আছে যা পড়তে বস।”

ছোট সংসার রাজুদের। বাবা, মা আর দুই ভাই। বাবা আশিকুর রহমান স্থানীয় এক বেসরকারী স্কুলে সামান্য বেতনের চাকুরী করে। এই সামান্য আয়েই চলে তাদের সংসার। সামান্য বেতনের চাকুরী আর একটি ছোট্ট নীড়। কিন্তুু সুখের অভাব নেই এই ছোট্ট সংসারটিতে।

রাজুর ছোট ভাই রাফি এসে তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাল। রাফি এখনো স্কুলে ভর্তি হয় নি। অ আ ক খ এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ তার জ্ঞান।
রাফি বলল, “ভাইয়া পাশের বাসার না ইমন না একটা না নতুন গাড়ি কিনেছে। তুই লেখাপড়া করে না চাকরি করে না আমাকে না একটা গাড়ি কিনে দিবি।”
এই না শব্দটি সে নতুন শিখেছে। প্রতি কথায় সে না বলবে। এই না এর অর্থ হয়তো এখনো তার বোধগম্য নয়।
রাজু বলল, “ঠিক আছে ভাইয়া এখন যাও। আমি পড়ি তো। গাড়ি কিনতে হলে তো অনেক পড়তে হয়।”
রাফি চলে গেল।

রাজুর বড় হওয়াটা সে নিজেই ঠিক ধরতে পারছে না। এখন প্রায়ই তার বাবা তার সাথে রাজনৈতিক আলাপ করে। মাঝে মাঝে ঘরোয়া কিছু ব্যাপারেও আলাপ করে। যার জন্য সে সব সময়ই অপ্রস্তুুত থাকে।

রাত দশটার কিছুটা বেশী। খাবার টেবিলে রাজুর সাথে তার বাবা, মা ও ছোট ভাই। খাবার মাঝেই হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।
আশিকুর রহমান বললেন, “তোমরা বসো আমি দেখছি।”
ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,
“আস্সালামুওলাইকুম”
“ওয়ালাইকুমআস্সালাম। কে আরাফ?”
“হ্যাঁ আঙ্কেল। রাজু বাসায়?”
“হ্যাঁ, খাবার টেবিলে। কেন জরুরী কিছু?
আচ্ছা ধরো আমি রাজুকে ডেকে দিচ্ছি।”
রাজু এসে আরাফের সাথে কথা বলে আবার খাবার টেবিলে গেল।
আশিকুর রহমান বললেন, “কি খবর আরাফে?”
রাজু বলল, “হু ভাল। কাল আবার হরতাল।”
“আরাফ বলেছে?”
“হ্যাঁ, এই মাত্র নাকি টিভিতে দেখল।”
“কাল তো পরীক্ষা আছে, কলেজে যাবি কিভাবে?”
“সমস্যা নেই, গাড়ি তো চলে। আর একদম না চললে অন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব।”
“দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় কে জানে। আর যে অবস্থায়ই থাক না কেন আমাদের তো কাজ করতেই হবে।”
রাজুর মা বললেন, “তুই এক কাজ কর, আরাফদের
বাড়ি হয়ে ঘুরে যা। কি না কি হয় বলা তো যায় না।”
রাজু বলল, “দেখি কাল কি অবস্থা হয়।”

পরবর্তী দিন খুব ভোরেই আশিকুর রহমান কর্মস্থলের উদ্দেশ্য রওনা হলেন। সকাল বেলাই রাস্তায় খুব গন্ডগোল। অনেকেই পথে ঝামেলা করেছে। শেষ পর্যন্ত হেঁটেই স্কুলে পৌছাতে হয়েছে তার। রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। মাঝে মধ্যে দুই একটা রিকশা খুব ভয়ে ভয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। স্কুলে পৌঁছেই আশিকুর রহমান বাসায় ফোন করলেন।
“হ্যালো – ”
রাজুর মা ফোন ধরে বললেন, “হ্যাঁ, বলো।”
“রাজু কোথায়?”
“বাসায় আছে।”
“ওকে আরাফদের রাস্তা হয়ে যেতে বলো। এই রাস্তায় খুব গন্ডগোল চলছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে বলব।”

দশটায় পরীক্ষা শুরু। হরতালের কারনে রাজুর আগেই রওনা দিতে হবে। আশিকুর রহমানের ফোনের কথা সাহেলা বেগম রাজুকে বললেন। সে বাবা মার কথা অমান্য করার ছেলে নয় এই কথা সাহেলা বেগম খুব ভালো করেই জানেন। তবুও সে রাজুকে বার বার সাবধান করে দিল।
সাহেলা বেগম বললেন, “বাবা, সাবধানে যাস। আর আরাফদের রাস্তা দিয়েই যাবি কিন্তুু।”
“আচ্ছা ঠিক আছে মা তুমি চিন্তা কর না।”
বাবার কথা মতই সে ভিন্ন রাস্তা ধরে কলেজের উদ্দেশ্য রওনা হলো।
রাজুদের বাসার সামনেই একটি ছোট চায়ের দোকান। হরতালের দিন দোকানটি যেন একটু বেশীই জমজমাট। দোকানির সাথে তার খুব ভাব।
দোকানে গিয়ে রাজু বলল, “কি খবর কাকু, কেমন চলছে?”
“খুব ভালো, জব্বর চলছে।”
“তা ভালো। কিন্তুু তুমি হরতালে দোকান খুলেছো কেন? পিকেটাররা তো তোমার দোকান নিয়ে যাবে।”
কিছুটা অপ্রস্তুুত হয়েই দোকানী বলল, “না, না তা নিবে না। আমি গরিব মানুষ। আমার এই ছোট চায়ের দোকান নিয়ে কি করবে?”
“তাহলে কিন্তুু পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। বলবে পিকেটারদের সাথে তোমার হাত আছে।”

রাজুর সৌভাগ্য! কথা বলতে বলতে একটা বাস এসে পড়ল। “বাস যখন চলে তখন গন্ডগোল মনে থেমেছে।” এই ভেবে আর ভিন্ন রাস্তা ঘুরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করল না রাজু। বাসেই উঠে পড়ল সে। প্রচন্ড ভীড়, তাই দাড়িয়েই যেতে হবে। অনেক পরিচিত মুখ রয়েছে বাসে।
পুলিশ পাহারায় কিছুক্ষণের জন্য পিকেটাররা লুকিয়ে ছিলো। পুলিশ না থাকায় আবার শুরু হলো গন্ডগোল। অবরোধকারীরা সরকারবিরোধী মিছিল দিচ্ছে। মিছিলের সামনেই বাস। হঠাৎ রাজুর শার্টে তরল জাতীয় কিছু পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট আওয়াজ। সাথে সাথে বাসে আগুন ধরে গেল। পিকেটাররা বাসের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। জানালার পাশে থাকা দুই একজন লাফ দিয়ে বাইরে পড়লেও অধিকাংশই লোকই বাসের ভিতরে।
হৈ চৈ। কোলাহল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আসলো। পিকেটারদের কেউ রাস্তায় নেই। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উপস্থিত। আগুন নিয়ন্ত্রনের চেস্টা চলছে। এম্বুলেন্স এসেছে। গুরুতর আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।

এরপর…….

কয়েকটি বছর কেটে গেছে। থেমে নেই কারো জীবন। থেমে নেই সন্ধ্যার তীরের সেই আড্ডা। হয়তো সেদিনের আরাফ, জহির, রিপু জীবন সংগ্রামে নেমে গেছে। নতুন কোন আফার জহির এসেছে সন্ধ্যার তীরে। রাফি বেশ বড় হয়েছে। তার বাবা তাকে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছে। কিন্তুু এই গাড়িতে কি মিটেছে তার শখ? তার যে বড় আশা ছিলো তার ভাইয়া তাকে একটি গাড়ি কিনে দিবে!সব কিছুর সাক্ষী হয়ে বয়ে চলছে সন্ধ্যা নদী। কখনো থামবে না তার এই বহমানতা। স্রোতের কল কল শব্দের সুরে সুরে সে যেন বলছে, “Men may come and men may go, But I go on for ever .”

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top