একজন লালমিয়ার গল্প
লালমিয়া বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে কৃষি ডিপ্লোমা যোগ্যতা দেখলেই আবেদন করতে বলে ছেলেকে। ছেলেও আবেদন করে। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষায় সে কখনোই টিকে না। টিকবেই বা কিভাবে, তার মাথায় তো এখন কৃষির কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেই স্থান দখল করে নিয়েছে ইলেক্ট্রনিক্স। এক্ষেত্রে তার আবার ইলেক্ট্রনিক্স এরও কোন সার্টিফিকেট নেই। তাই সে ইলেক্ট্রনিক্স এর যোগ্যতার কোন চাকরিতে আবেদনও করতে পারে না।
ছোট ছেলে……. সে তো সারাক্ষণ তার পড়াশোনা, লেখালেখি আর তথ্য-প্রযুক্তির সাথে সম্পর্ক রক্ষায় মহাব্যস্ত। তার ও জীবনের একটি কাহিনী আছে। সে এক বিশাল কাহিনী। শুধু এটুকুই বলি, সে একবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আবার নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। এখন সে আবার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সে একটি পার্ট-টাইম কাজ করে। ভার্সিটির খরচ অবশ্য সে নিজেই চালায়। এরপরও বাবার কাছ থেকে অল্প কিছু নিতে হয়।
লালমিয়া তাঁর ছোট ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। এখানে তিনি তার অফিস থেকে বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন। তার স্ত্রী, মেয়ে এবং বড় ছেলে থাকে গ্রামে। তাই তাকে এখন মোটামুটি দুইটি পরিবার সামলাতে হয়। একটি ঢাকায়, তিনি আর তার ছোট ছেলে মিলে একটি; অপরটি গ্রামে স্ত্রী, মেয়ে আর বড় ছেলে মিলে।
তিনি সর্বসাকুল্যে বেতন পান আট হাজার টাকা। এখান থেকে বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল বাবদ কর্তন শেষে তিনি পান মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনি কিভাবে তাঁর সংসার চালাবেন; এই ভেবে তিনি বাসার একটি কামরা তাঁর আর তাঁর ছোট ছেলের জন্য রেখে বাকি কামরাগুলো ভাড়া দিয়ে দেন। বেতন এবং ভাড়ার টাকা যা পান তা দিয়ে হয়ত চালিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি তার পথরোধ করে দিল।
তিনি হয়ত পারতেন, আয়টাকে টেনে বড় করে নিতে; তাঁর অন্য সহকর্মিরা যেভাবে করে। কিন্তু সেটা যে সঠিক পথ নয়। তাই তিনি পারেন নি। এখন তাকে প্রতি মাসেই কারো না কারো কাছ থেকে ধার করতে হয়। এই মাসে হয়ত খালেক সাহেব, পরের মাসে হয়ত খালেদ সাহেব। এই রকম হয়ত কোন মাসে আকবর সাহেব, তো পরের মাসে আশরাফ সাহেব নয়ত সোহরাব সাহেবের কাছ থেকে নিতে হয়। মাসের শেষ মুহূর্তে এসে তাঁর মাথায় এক ধরনের চাপ অনুভূত হয়। কেননা, এই সময়েই তো তাঁর পকেট গড়ের মাঠ হয়ে যায়। এই মাসে কার কাছ থেকে টাকা নেওয়া যায়, সেই টেনশন তাঁর মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে আর যন্ত্রণা দিতে থাকে। কারো কাছ থেকে পেয়ে গেলেই সাময়িক চাপমুক্তি। এই ভাবেই চলতে থাকে তাঁর টানাপোড়েনের সুখের সংসার!
কোন মাসে কোন কারণে বাড়তি খরচ পড়ে গেলে তো মহাসর্বনাশ। তাকে কোন সুদখোরের শরণাপন্ন হতে হয়, আর নয়ত অফিস থেকে ঋণ সুবিধা নিতে হয়। তখন তো তাঁর বেতন আরও ছোট হয়ে আসে। কেননা প্রতি মাসেই তাকে এইসব ঋণের সুদ দিয়ে দিতে হয়; পাশাপাশি আসলের একটা অংশও সাথে দিতে হয়। তখন তাঁর কি হাল হয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
কখনো কখনো তাঁর ছোট ছেলেটির টিউশন ফি জোগাড় হয় না। তখন যে সে তার বাবার কাছে চাইবে, বাবার তো সেই অবস্থা থাকে না। হয়ত কখনো চেয়ে বসে। তখন লালমিয়ার শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি দিতে পারেন না। বরং বলতে বাধ্য হন, “তোর টিউশন ফি দরকার তো আমার কাছে এসেছিস কেন, আমি কি করব?”
এভাবেই চলে যায় লালমিয়াদের জীবন। তাঁরাও হয়ত চাইতেন মেয়ের ভাল চিকিৎসা হবে, ছেলের পড়ার খরচ তিনি নিজেই দিবেন, বড় ছেলের জন্য কিছু টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দেবেন। হয়ত তাদের মনেও খায়েশ ছিল স্ত্রী-সন্তানদের ভাল কাপড় কিনে দেবেন, নিজের জন্যও ভাল কিছু কিনবেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। এক সময় উপরের ডাকে সাড়া দিয়ে হয়ত উপরেই চলে যান তাঁরা।