মুক্তি যুদ্ধের গল্প – ৫ম পর্ব
—৫—
—————
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি তোমাদের আগেই বলেছি। কি পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের দেশ তথা আমাদের জাতিকে বাঁচানোর জন্য অস্র হাতে তোলে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম সে কথা তোমরা পূর্বে ই শুনেছ । ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙ্গালীরা নিরংকোষ সংখ্যা গড়িষ্টতা পেলেও ইয়াহিয়া খাঁন সংসদ অধিবেশন ডাকতে তাল বাহানা করছিলেন। বিভিন্ন আলোচনার বাহানায় বাঙ্গালী নিধনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন । তার পর ঘনিয়ে আসে সেই ২৫ মার্চের কালো রাত্রি। গভীর রাত্রে পাক সেনারা এক যোগে আক্রমন চালায় ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্রদের উপর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঘুমন্ত পুলিশদের উপর এবং পিলখানার ই,পি আর বাহিনীর উপর । ঘুমের ঘোরের অতর্কিতে আক্রান্থ হয়ে মারা যায় ইউনিভার্সিটির শত শত ছাত্র, পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা। যারা বেঁচে থাকে তারা কোন রকম পালিয়ে যায় প্রাণ নিয়ে খালি হাতে অথবা অস্র নিয়ে । সারা দেশে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার । দুঃখের মাতম বয়ে যেতে থাকে সারা দেশ ও জাতির উপর দিয়ে । গন হত্যা চালায় পাক সেনারা । যাকে যেখানে পায় সেখানেই হত্যা করে । মেয়েদের ধর্ষণ করতে থাকে গন হারে । ২৬ অথবা ২৭মার্চ অথবা আরও দু-এক দিন পর আমাদের গ্রামে একদল ইপি আর সদস্য পিলখানা থেকে পালিয়ে ঢাকা থেকে পায়ে হেটে এসে হাজির হয় । তারা পায়ে হেটেই ভারত রওয়ানা হয়েছে । আমরা তাদের খাবার ব্যবস্থা করলাম । তারা সারা দিন বিশ্রাম নিয়ে রাত্রে বেড়িয়ে গেল আবার ।আমি এবং আমার এক চাচাতো ভাই তাদের সাথেই যেতে চাইলাম । কিন্তু মা বাবার বাঁধার কারনে তাদের সাথে যেতে পারলাম না। বাঁধা দেওয়ার কারণ ছিল এই যে, ঐ সময় আমি ম্যট্ট্রিক পরীক্ষার পরীক্ষার্থী ছিলাম বটে। কিন্তু আকারে বড়ই ছোট ছিলাম । এই জন্য আমাকে বাঁধা দেওয়া হল ।ই পি আর সদস্যদের দল চলে গেল ।তাদের সাথে আমার যাওয়া হলনা ।উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। পর দিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা পালাব । যেই সিদ্ধান্ত , সেই কাজ ।আমি এবং আমার চাচাতো ভাই এই দুই জনে সকালে নাস্তা খাওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে পালালাম । আমাদের উদ্দেশ্য আমরা ঐ দিন আর রাত হেটে যে করেই হোক ই পি আর সদস্যদের দলে ভিরবো এবং তাদের সাথে ইন্ডিয়া চলে যাব । সেখান থেকে অস্র নিয়ে পূনরায় দেশে ঢুকবো এবং যুদ্ধ করবো।
আমরা সারা রাস্তা মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে এগুতে থাকলাম । দিন শেষে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা বাটাজোর গিয়ে পৌঁছলাম । আমরা যেহেতু খালি হাতে এবং এর পরবর্তী রাস্তা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ অচেনা । কাজেই রাত্রের ভাগে আর এগুতে সা হস পেলাম না । পরদিন সকালে আবার রওয়ানা হলাম সেই ই পি আর দলের সাথে মিলে যেতে । আমরা জিজ্ঞেস করতে করতে বিকাল নাগাদ মল্লিক বাড়ি হাটে পৌঁছলাম । সেখানে লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানলাম , উক্ত ই পি আরদের দল মল্লিকবাড়ি থেকে গাড়ো পাহাড়ের দিকে চলে গিয়েছে । আমরা সামনের দিকে দেখলাম শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সেখানে পথ প্রদর্শক ছাড়া এই পাহাড়ীয়া এলাকা পার হয়ে ইন্ডিয়া পৌঁছানো খুব সহজ সাধ্য ব্যাপার নয় । এলাকার দু এক জন লোক বললো- ঐ এলাকায় যদি কোথাও দু চার দিন অবস্থান করতে পারি তাহলে তারা পথ প্রদর্শক বা অন্য কোন দল ধরিয়ে দিতে পারবে । কিন্তু আমরা যেহেতু বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছি, তাই সাথে খুব বেশী টাকা পয়সা নিয়ে যেতে পারিনি । কাজেই শূন্য পকেটে বিনা পরিচয়ে আমাদের পক্ষে মল্লিক বাড়ি অবস্থান করা খুব একটা নিরাপদ মনে হল না ।ফলে আমরা ঐ তারিখের মত ভগ্ন হৃদয়ে ফিড়ে এলাম ।
গ্রামে ফিড়ে এসে দেখি আমাদের অপর দুই চাচাতো ভাই এবং এক বন্ধু ইতি মধ্যেই কাদের সিদ্দিকির দলে যোগ দিয়েছে । আমাদের মন যথার্থই খারাপ হয়ে গেল, মন যখন কোন বিষয়ে দেওয়ানা হয়ে যায় তখন ঘরে বসে থাকা সত্যিই কষ্টকর। আমরা কিছুদিন গ্রামে অবষ্থান করে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তি যুদ্ধারা কবে কোথায় অবস্থান করে সেই খুঁজ রাখতে শুরু করলাম । এর মধ্যে একদিন খুঁজ মিলেও গেল । পরদিন আমরা কাদেরিয়া বাহিনীর হেড কোয়াটার সখিপুর গিয়ে হাজির হলাম । আমরা সখিপুরে অবস্থান করা কোম্পানী কমান্ডারের সাথে দেখা করলাম । তিনি আমাদের বললেন-আপাতত তাদের নিকট কোন অতিরিক্ত হাতিয়ার নেই ।কাজেই এই মূহুর্তে আমাদের ভর্তি করতে পারবেন না । তাদের খাতায় নাম ঠিকানা লিখিয়ে দিয়ে আসতে বললেন । অস্রের যোগার হলেই আমাদের সংবাদ দিবেন । তা ছাড়া আমরা যদি কোন অস্র যোগার করতে পারি তা হলে যেন অস্র নিয়ে হেড কোয়াটারে চলে আসি। তাহলেই তারা আমাদের ভর্তি করে নেবেন। কি আর করা কাদের সিদ্দিকির হেড কোয়াটারে নাম লিখিয়ে বাড়ি চলে এলাম। উত্তেজনায় আমাদের দিন আর পার হচ্ছিল না। চতুর্দিকে খুঁজ নিতে থাকলাম, কোন ভাবে একটি অস্র যোগার করা যায় কিনা।
কিন্তু অস্র তো আর যোগার করা যায় না। আর আমিও মুক্তিবাহিনীতে যেতে পারছিনা । তারপর একদিন আমার চাচাতো ভাই ও এক বনধু যে দলে আছে সেই দল আমাদের পাশের গ্রামে এল । আমরা দু জন সেই দলের কমান্ডারের নিকট গেলাম । আমার সেই চাচাতো ভাই ও বন্ধু আমাদের নিয়ে পুট আপ করলেন । তিনি আমাদের দেখলেন এবং তাদের দলে নাম লিখিয়ে নিলেন । আমরা ঐ মূহূর্ত থেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই দলের সাথে অবস্থান করতে থাকলাম । আমার সাথে যে চাচাতো ভাই ভর্তি হলো পরদিন তাকে একটি রাইফেল দিল । কিন্তু আমাকে রাইফেল দিল না । আমি আবেদন নিবেদন করলাম , কিন্তু আমাকে রাইফেল দিচ্ছেনা । অযুহাত হল এই যে,আমি আকারে বেশ ছোট । তাদের ধারনা আমাকে রাইফেল দিলে বিপদে পরলে আমি রাইফেলটি হারিয়ে ফেলব । আসলে ঐ সময় একজন মানুষের চেয়ে একটি রাইফেলের দাম ছিল অনেক বেশী । আর তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গেড়িলা যুদ্ধের নিয়মই ছিল আক্রমন কর এবং কিছুক্ষণ আক্রমন চালিয়ে নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে দৌড়ে পালানো এবং যুদ্ধের পর নির্দিষ্ট একটি স্থানের কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হতো, সেখানে গিয়ে পূনরায় সমবেত হওয়া।
কাজেই আমি ঐ সময় সাড়ে সাত সের ওজনের রাইফেল নিয়ে দৌঁড়ে ভাগতে পারবো কিনা সেই সম্পর্কে আমার কমান্ডারের বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না। ফলে তিনি জানালেন-“তুমি আপাতত স্টোরে যোগদান কর ।পরে তোমাকে অস্র দেওয়া হবে ।ফলে আমি মুক্তি যুদ্ধে যোগদান করতে পেরে যে টুকু খুশী হয়েছিলাম সেই খুশী টুকু মনের মধ্যে দাবিয়ে নিয়ে কোম্পানীর ষ্টোরেই যোগদান করলাম । কাজ হলো সকল মালা মাল রক্ষনা বেক্ষণ করা । এর মধ্যেই সপ্তাহ কেটে গেল । আমি আমার চাচাতো ভাই ও বন্ধুকে তাগিদ দিতে থাকলাম। কারণ তারা উভয়েই আমার চেয়ে সাড়ে তিন বৎসরের বড় ছিল। তারা কমান্ডারের নিকট তদবীর করতে থাকলো এবং কমান্ডারকে বুঝাতে থাকলো যে,আমি ছোট হলেও অত্যান্ত সাহসী ছেলে । কাজেই আমাকে রাইফেল দিলে সেই রাইফেল হারানোর কোন সম্ভাবনা নেই।ফলে সপ্তাহ খানেক পরে একদিন কমান্ডার আমাকে ডেকে একটি রাইফেল দিয়ে বললেন-“খবরদার,রাইফেলটি হারিও না যেন। তুমি প্রতি দিন এই ক্যাম্পের চতুর্পাশ দিয়ে রাইফেল নিয়ে ৫/১০ চক্কর করে দৌড়াবে। তাহলেই রাইফেল নিয়ে দৌড়ানো তোমার একটি অভ্যাসে পরিনত হবে। আর এ ভাবেই আমি একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাজ শুরু করলাম। এখন তোমরাই বলো-এত কষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করে তার পরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার পর যদি কোন অমুক্তিযোদ্ধা কোন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে অঙ্গুলি তুলে কথা বলে, তা হলে কি সেই কথা সহ্য করা যায়? তখনই তো বলতে ইচ্ছা করে, তোমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অঙ্গুলি তোল কেন? তোমরা জিজ্ঞেস করো সেই ভাই, সেই বাবা, সেই চাচাদেরকে , যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উপযুক্ত বয়সের একজন ব্যক্তি থাকা সত্তেও তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে
অংশ গ্রহন করেনি কেন?তারা কি প্রাণের মায়ায় মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেননি, না কি স্বাদ্ধীনতার বিরুধীতাকরার কারণে? যদি প্রাণের মায়ায় মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহন না করে থাকেন, তবে তাদের প্রতি বিদ্বেষ নেই আমার। তবে ধিক তাদের প্রাণের প্রতি , যে প্রাণের মায়া করে তারা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন নি। আর যদি বিরুধীতা করে থাকেন তবে তাদের অবশ্যই বিচার হ ওয়া উচিৎ। কারণ যারা এ দেশ চায়নি, তাদের এ দেশে বাস করার কোন অধিকার নেই । যারা প্রাণের মায়ায় যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন নি তাদের সন্তানদের প্রতি আমাদের আহবান আপনাদের যদি দেশের প্রতি সামান্য তম মায়াও থেকে থাকে তবে আপনার বড় ভাই, বাবা, চাচাদেরকে তাদের ভীত হৃদয়ের প্রতিশত ধিক্কার দিয়ে বজ্র কন্ঠে অয়াজ তোলুন, যারা দেশের স্বাধীনতার বিরুধীতা করেছে, যারা এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি তাদের এ দেশে বস বাসের অধিকার নেই ।স্বাধীনতা বিরুধীদের সন্তানদের আমার আহব্বান , আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সমালোচনা না করে , জিজ্ঞেস করুন আপনার বড় ভাই, বাবা , চাচাদের, দেশের প্রতি যদি তাদের মায়া থেকে থাকে তবে তারা দেশের স্বাধীনতার বিরুধীতা করেছে কেন?আপনারা যদি দেশ প্রেমিক হন তবে কেন পারেন না আপনাদের বড় ভাই, বাবা চাচাদের বিচারের সন্মুখীন করতে? আসুন আমরা অপরাধীদের বিচার করে আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য কাজ করে এ দেশকে সোনার বাংলায় পরিনত করি।