উটন দাদুর কাহিনী–১৩ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
এমনি সময় দূর থেকে কিছু লোকের চীৎকার শোনা গেল। ওরা যেন এই মন্দিরের দিকেই আসছে। নবু,নেচু,শমী,বনুই ওরা সবাই ছুটে এসে মন্দিরের ভিতর ঢুকল। তার মধ্যে লেংড়া নেচুও আছে। ও নিজকে বাঁচাতে পড়িমরি করে দৌড়ে এসেছে। ওরা সবাই আধমরা লোকটাকে দেখে চমকে উঠলো। উটন বেদির পাশ থেকে বেরিয়ে এসে ধীর,চাপা আওয়াজে ছেলেদের নিজের কাছে ডেকে নিলো।
এদিকে বাইরে,সামান্য দূরে,বুনোদের হই চৈ শোনা যাচ্ছিল। ওদের আওয়াজ ক্রমশ এ দিকেই এগিয়ে আসছিল। তার মানে ওদের দল ভারী হয়ে গেছে। ওরা উটনদেরই ধরতে আসছে !
উটন তাড়াতাড়ি এসে আহত লোকটার হাত ধরে বলে উঠলো, চলো আমি তোমাকে ধরছি,একটু কষ্ট হবে তোমার !
লোকটার নাম–রাবুন,সে অনেক কষ্টে উটনের হাত ধরে পা বেঁকিয়ে অনেক চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল। মুখ থেকে তার উঁ আ ব্যথার শব্দ বেরিয়ে আসছিল। একবার উঠেই সে বসে গেল মেঝেতে, এক হাতে দেওয়ালে ভর দিয়ে অন্য হাতে উটনকে ধরে ও আবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। তারপরে অনেক কষ্টে উটনের এক হাত ধরে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এক পা এক পা এগোতে লাগলো। ও খুব জোরে জোরে হাঁপাচ্ছিল—কষ্টের কাতর শব্দ তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল। উটন বলল,ওই ধারে বেদী,তার পেছন দিকে আমাদের যেতে হবে। একটু এগিয়ে ওরা এক জাগায় একত্রিত হল। ওদের কারো মুখে রা’ নেই।
চারিদিকে বিদঘুটে গন্ধ। এক মাত্র জ্বলে থাকা প্রদীপ আরাধনা স্থলকে অন্ধকার থেকে বাঁচাতে পারে নি। সেখানে যেন ছায়া প্রচ্ছায়ার খেলা চলছিল। মন্দিরের বিগ্রহ একটা পাথর। পাথরকে বুনোরা পূজা করে। তাতে চাপচাপ,দলাদলা রক্ত লেগে আছে। নীচে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছিয়ে আছে ছাইয়ের স্তূপ ও পোড়া কাঠের ছোটবড় টুকরো।
উটন সবাইকে চুপ করে থাকতে বলল। প্রদীপের মিটমিট, থমথমে আলোর আড়ালে দাঁড়িয়ে উটন ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,ওই দিকে আমাদের যেতে হবে–আমার পেছনে পেছনে সবাই এসো !
অন্য দিকে চীৎকার চেঁচামেচি বেড়ে যাচ্ছিল–বুনোরা মন্দিরে পৌঁছে গেল। উটন,কুন্তা,শমীকে নিয়ে উটন সেই দাঁড় করানো পাথরটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ওরা সবাই একে একে পাথরের ফাঁক দিয়ে মন্দির চত্বরের বাইরে বেরিয়ে এলো।
ওদিকে তখন ভীষণ চীৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল–বুনোরা নিজেদের আরাধনা চত্বরে ঢুকে পড়েছে। ওরা এগিয়ে আসছে, উটনদের দিকে। উটনরা তাড়াতাড়ি পাথরের টুকরোটাকে আবার ধাক্কা দিয়ে যথা স্থানে রেখে দিল।
লোহা ও পাথরের হাতিয়ারের ঠোকাঠুকি আর ঘষাঘষির আওয়াজ কানে ভাসছিল। মাঝে মাঝে ওদের অবোধ্য ভাষার চেঁচামেচি উটন ওদের কানে আসছিল।
বনুই,শমী দুজনে মিলে রাবুনকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলেছে। উটন আর বাকি সব ছেলেরা দ্রুত পায়ে হেঁটে আগে আগে চলেছে। মন্দিরের পেছন দিকের ঝোপঝাড়,জঙ্গল পেরিয়ে ওরা সবাই এগিয়ে চলেছে। নদীর বয়ে যাওয়া স্রোতের শব্দ ওদের কানে আসছিল। তার মানে ওরা নদীর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ওরা কি করবে ? ওদের নৌকো তো বাঁধা আছে অনেক,অনেক দূরে–সে জাগা তাদের সম্পূর্ণ অজানা।
এখানে অন্ধকার–ছায়া,উপচ্ছায়ার ভিড় চারিকে ছড়িয়ে আছে। নিঝুম,থমথম করছে চারদিক–এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে আছে। ওরা নদীর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সে নৌকোর সন্ধান যদি বুনোরা পেয়ে গিয়ে থাকে তবে ওরা তা নিশ্চয় নিজেদের দখলে করে নিয়েছে।
উটন দাদুর মনে হচ্ছিল,কেন যে জেনে শুনে এ বিপদের ফাঁদে পা দিয়েছে ! এখানে নিজের সাথে সাথে আরও কটি প্রাণ আজ বিপন্ন–এ অবস্থায় ওরা বেঁচে ফিরতে পারবে কি না কে জানে ! এমনি এডভেঞ্চারের নেশার ভূত ওর ঘাড়ে কেন যে চেপে ছিল ও এ মুহূর্তে কিছুতেই তা বুঝে উঠতে পারছিল না।
দূরের উপাসনা গৃহ থেকে বাদ্যযন্ত্র নয়–কেমন যেন বাঁশ,লাঠি পেটাবার মত আওয়াজ ভেসে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল না,ওরা কাউকে মারছে না কি সন্ধ্যারতির প্রার্থনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ! নাকি ওদের দেবতার সামনে চড়ছে কোন নরবলি ?
থামতে হল উটনদের। আর একটু নীচে উড়ালী নদী বয়ে চলেছে–এখানে আবার উগ্র গন্ধ বড় বেশী করে নাকে লাগছিল। ব্যাগ থেকে উটন টর্চ বের করে ফোকাস দিল সামনের নদী পারে। একি ! ওগুলি কি ? টর্চের আলোর ফোকাসে ওরা দেখল,চারি দিকে পড়ে আছে অসংখ্য নরকঙ্কাল ! আর তারই মাঝে আছে সদ্য কাটা এক নর মুণ্ড ! তখনও অবিকৃত মাংস তাতে লেগে আছে! ওটা দেখলে মনে হচ্ছে,এখনও সনাক্ত করা যাবে কার মুণ্ড বলে !
নেচু ভয়ে চাপা চীৎকার করে উঠলো। আর শুধু নেচু কেন,সবাই ভয়ে শিউরে উঠলো। কুন্তা চীৎকার করে বলে উঠলো–ও কার মাথা ?
–কোন বুড়ো মানুষের হতে পারে,নিজেদের কারও বুড়ো বাবাকে ধরে কেটে ফেলেছে হবে—পেটের খিদেতে, রাবুন ধীরে ধীরে বলে উঠলো।
উটন কাছে এগিয়ে গেল–কাছ থেকে দেখল সেই নর মুণ্ড–হ্যাঁ,তাই হবে–বেশ বুড়ো লোকটা—হতে পারে সেই মৃত প্রায় লোকটা যে উটনের হাতের কলা চাটছিল! উটন অস্বস্তির দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
কিন্তু এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। বুনোদের গ্রামের বিপরীত দিকে ওদের যেতে হবে। না হলে যে সমূহ বিপদ। নিশ্চয় বুনোরা ওদের হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে–আর খুঁজতে খুঁজতে এখান পর্যন্ত তো আসবেই। উটনের মনে হল,ওই যে মন্দিরের গোপন পথটা যেটার ঢাকনা পাথর ঠেলে ওরা মন্দিরের পেছন দিকে বেরিয়ে এলো তার ব্যবহার হয় তো বুনোরা সবাই জানে না। ওদের দু এক জনই কেবল জেনে থাকবে সে রহস্য দ্বারের কথা। তা না হলে এত সময়ের ভিতর ওরা তাদের কাছাকাছি পৌঁছে যেত।
অন্ধকারে হেঁটে চলেছে ওরা। রাবুন আর চলতে পারছিল না–ওকে কোলে তুলে হেঁটে চলেছে নবু। দূরে বুনোদের কোলাহল ক্রমশ ক্ষীণতর হয়ে আসছে। হঠাৎ এক জাগায় কেন যেন খসখস করে আওয়াজ হল। উটন আর তার সাথীরা চট করে নিজেদের হাতিয়ার বের করে নিলো। কেবল রাবুন ও নেচু বেশী মাত্রায় ভীত হয়ে পড়ল–ওদের কি শেষে বুনোদের হাতে পড়তে হবে ?
এক জাগায়,কিছুটা দূর ওরা আগুনের ঝলক দেখতে পেল। উটন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই বলে উঠলো,না,বেশী লোকজন নেই,দু একজন বুনো হবে। ওরা ধীরে ধীরে ওই দিকেই এগিয়ে গেল। খানিকটা দূরে মশালের মত আগুন জ্বলছিল–দূর থেকে মশালের আগুনে তিনজন বুনকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। উটনদের উপস্থিতি বুনোরা টের পেল না। টর্চ না জ্বালিয়ে উটনরা খুব ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। এবার আরও পরিষ্কার হল দৃশ্য,তিনটে বুনকে ওরা দেখতে পেল–ওরা আগুনে কিছুর মাংস ঝলসিয়ে খাচ্ছিল। বড় বড় গরুর হাড্ডি হবে,হাতে নিয়ে তা থেকে মাংস মুখ দিয়ে টেনে,খুবলে খাচ্ছিল! আগুনের সামনে বুনোগুলোকে কদাকার রাক্ষসের মত দেখাচ্ছিল। উটন চুপিসারে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বড় একটা ঝোপের আড়ালে হয়ে গেল আর দেখতে লাগলো সেই ভয়ংকর নারকীয় দৃশ্য।
এবার বুনোদের পাশ কাটিয়ে তেমনি চুপচাপ ওরা চলতে থাকলো আরও সামনের দিকে। ওদের আরও,আরও দূরে এগিয়ে যেতে হবে–বুনোদের আস্তানা থেকে যত দূরে যেতে পারবে তত ওরা নিরাপদ হবে।
নেচুর ব্যথা বেড়েছে তবু প্রাণভয়ে সে স্বাভাবিক হেঁটে চলেছে। কিন্তু দৌড়োবার প্রয়োজন হলে তখন কি হবে ? ভাল করে ও দৌড়াতে পারবে না। এ পর্যন্ত ও ঠিকঠাক চলেছে।
ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার চিরে ওরা হেঁটে চলেছে বুনোদের গ্রামের বিপরীত দিশা ধরে। বেশ কিছু সময় স্তব্ধতায় ওরা ঝোপঝাড়, গাছপালার ফাঁকফোকর গলিয়ে হেঁটে চলছিল। মাঝখানে স্তব্ধতা ভাঙল নেচু–আমরা কি এবার নিজেদের গ্রামের দিকে যাত্রা করব ? নেচু প্রশ্ন করেছিল উটন দাদুকে।
উটন দাদু বলল,আমাদের সামনে অনেক বিপদ–আমাদের নৌকো নিশ্চয় বুনোরা দখল করে নিয়েছে। আমাদের দেশে ফিরতে হলে চাই বড় একটা নৌকো–তার আগে,এই জীবন বাঁচিয়ে, এই মহাবিপদ এড়িয়ে,আমাদের নিরাপদে পৌঁছাতে হবে উড়ালী নদীর পারে।
–তা হলে কি হবে ? এবার বনুই ভয়ের সুর নিয়ে প্রশ্ন করল।
–কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে,উটন সান্ত্বনার সুরে বলে উঠলো।
ঠিক এমনি সময় ওদের সবার কানে এলো দূরে কোথাও অনেক লোকের সোরগোল। দূরে হলেও ওরা পেছন ফিরে দেখতে পেল, কতগুলি আগুনের স্তিমিত শিখা—কখনো নিভছে,কখনও জ্বলছে—ওগুলি যেন নাচানাচি করে চলেছে !
ক্রমশ…