দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল
১.
– নাজু আম্মা ! ও নাজু আম্মা !
কাতরকন্ঠ মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকা কাজের মেয়েটাকে ডাকলেন ষাটোর্ধ বৃদ্ধা সালেহা বেগম । হটাৎ করেই এইমাত্র প্রচন্ড পানির পিপাসায় ছটফটিয়ে ঘুম ভেঙেছে তার । পিপাসার যন্ত্রণায় শরীর যেন কাঁপছে তার । সাহায্যের আশায় তাই কাজের মেয়েটাকে ডেকে তুলতে চাইলেন ! কিন্তু আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে মেয়েটার মধ্যে কোনরকম নড়াচড়া টের না পেয়ে ফের ডাকলেন তিনি ।
– নাজু আম্মা বড় তিয়াস লাগছে গো আমমাজান । এক মগ পানি দিবেন আম্মা ।
– কি অইছে , অ্যাঁ ! মরা মরসে নি আপনের এই রাইত্তের বেলা ?
আচমকাই লেপের নীচ থেকে শুধু মাথাটা বের করে রীতিমতন খিঁচিয়ে উঠলো কাজের মেয়েটা ।
ইদানিং এই মুখরা মেয়েটাকে রীতিমতন ভয় পেতে শুরু করেছেন সালেহা । অথচ শাহনাজ নামের বছর পঁচিশেক বয়সী এই যুবতী মেয়েটাকে এই বাড়ীতে মোটা বেতনে রাখাই হয়েছে তার ব্যাক্তিগত পরিচর্যার উদ্দেশ্যে । বিশেষ করে তার বহুমূত্র রোগের কারণে রাতে একাধিকবার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন পড়ে । সুতরাং রাতবিরাতের তাকে দেখাশোনা করার জন্য মেয়েটাকে ঘুমাতেও দেয়া হয় সালেহা বেগমের ঘরেই । প্রথম কয়মাস মেয়েটা কিন্তু সালেহার দেখভাল করেছে রীতিমতন বুক দিয়ে । কিনতু ইদানিং কি যে হয়েছে ! কাজে ফাঁকি তো দিচ্ছেই , তারসাথে ইদানিং মাঝেমধ্যেই খারাপ ব্যাবহার করে বসছে বৃদ্ধার সাথে ।
অতি ভাল মানুষ সালেহার ধারণা সারাদিন তার মতন একজন বয়স্কা রুগীর দেখভাল করতে করতে মেয়েটা খুব সম্ভবত হাঁফিয়ে উঠেছে । তাই এনিয়ে তেমন কিছু না বলে উল্টো মেয়েটাকে সমঝে চলতে শুরু করেছেন ! এখনও তিনি তাই করলেন । অনেকটাই অপরাধীর মতন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে নিজের প্রয়োজনের কথা জানালেন তিনি ।
-হায়রে আমার খুদা ! পানি খাইবেন হের লাইগা কি এই শীতের রাইতে আমারে ডাক পাইড়া উঠান লাগবো আপনের ? ঐতো সামনেই সব রাখা আছে ! একটু কষ্ট কইরা নিয়া খাইলে তো আত আপনের আর ক্ষইয়া যাইতো না ! নিকি গরীব বইল্যা আমরা কুনু মানুষ না ? আমাগোর শইল কুনু শইল না !
এক নিঃশ্বসে কথাগুলো বলে ফের ফুরুৎ করে লেপের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দেয় নাজু ।
অগত্যা ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানা থেকে মাটিতে পা রাখলেন সালেহা । তৃষ্ণায় এই মুহুর্তে সত্যি তার রীতিমতন বুকের ছাতি ফেটে যাবার মতন দশা হয়েছে তার । ঘরে ছড়িয়ে থাকা ডিউম লাইটের মৃদু আলোয় হাত বাড়ালেন বিছানার লাগোয়া ছোট টেবিলটার উপর । ওখানেই তার পানের আর অষুধের বক্স , জায়নামায , তসবিহসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে কাঁচের একটা পানি ভর্তি জগ আর মগও রাখা থাকে । জগ থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন পুরো এক মগ পানি । কিন্তু তবু যেন তৃষ্ণা মিটলো না এতটুকু । আজন্ম তৃষিতই মনে হলো নিজেকে । তাই মগটা বাম হাতে রেখে ডানহাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন কাঁচের জগটা !
আর ঠিক তখনই ঘটলো বিপত্তিটা । প্রচন্ড তৃষ্ণার ক্লান্তির সাথে কিছুক্ষণ আগেই কাজের মেয়েটার খারাপ ব্যাবহার – সব মিলিয়ে কি হলো কে জানে ! হটাৎ করেই যেন ভীষণ অবসন্ন বোধ করলেন সালেহা । কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেমন করে হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল পানি ভর্তি জগটা ।
তীব্র গ্লানি আর আতঙ্কে বিষ্ফোরিত দৃষ্টি মেলে পাথর হয়ে তাকিয়ে দেখেন বিশ্বাসঘাতক কাঁচের পাত্রটার বিদ্যুৎবেগে পতন্মুখ হয়ে ছুটে চলা ।
( চলবে )