ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র” – অষ্ঠাদশ পর্ব
অষ্টাদশ পর্ব
(ঊনিশ)
অনেকদিন বাড়ীতে যাওয়া হয়নি। অনন্তদা কোথায় আছে তাও জানা নেয়। বড় অভিমানী মানুষটি। নিজের বাড়ীতে মাথা গোঁজার যেটুকু জায়গা তাতে জীবনে যাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। সেটুকুও এখন ভাইদের দখলে। ভাইয়েরা অনন্তকে একটু খুঁজে দেখারও প্রয়োজন মনে করেনি। সে অবসর নেই। সবাই সংসার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বড় অবাক লাগে, সংসার নামক জিনিষটা রক্তের শক্ত বাঁধনটাকেও কত আলগা করে দেয়।
তিমির বাড়ীতে এসে খোঁজ নেয়। তবে কেউ সঠিক কিছু বলতে পারছে না। সবই অনুমান নির্ভর। কেউ বলছে ভারতে চলে গেছে। কেউ বলছে দুর সম্পর্কের কোন আত্মীয়ের বাসায় উঠেছে। ওদের কাপড়ের দোকানে কাজ করে। তিমির আশ্বস্ত হয়। যাক একটা ব্যবস্থা হলো। অনন্তদার জন্য খুব কষ্ট হয়। এতদিন কাছে থেকেও নিজের কষ্টের কথাগুলো কখনও মুখ ফুটে বলেনি। বরং তিমিরের কষ্টে নিজে কষ্ট পেত খুব বেশী। কত আপন ছিল মানুষটি। তিমিরের অনিয়ম দেখে কত কি ভাবতো সারাক্ষন। সাহস করে কিছু বলতেও পারতো না। অভিমান করে কতবার বলেছে চলে যাবো। কখনও যাওয়া হয়নি। আবার ফিরে এসেছে। মাঝে মধ্যে খুব রাগ করতো। আবার সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পরম ¯েœহে মাথার পাশে গিয়ে বসতো। হাত পাখার বাতাস করে ভাত খাওয়াতো। বিভিন্ন উপদেশ দিত। তিমিরের কষ্টটা ভাগাভাগি করে নিত।
বাড়ীতে বৃদ্ধ বাবার সামনে দাঁড়াতে কেমন লজ্জা হচ্ছে। মাথাটা আপনা আপনি নুইয়ে আসছে। আগের মত গলা উঁচু করে কথা বলতে পারছে না। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হাস্না হেনার গন্ধে সারা বাড়ীটা মৌ মৌ করছে। কিছুক্ষন আগে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়েছিল। একটা স্যাঁত স্যাঁতে পরিবেশ। তিমির বাইরের বারান্দায় একা বসে আছে। শম্পা এতক্ষন পাশে ছিল। তিমির কোনো কথা বলেনি। সবার কাছেই নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কাউকে বলতে পারলে নিজের ভেতরটা কিছুটা হালকা হতো। ইচ্ছে করছে শেলীকে সব কিছু খুলে বলতে। সেই প্রথম দিনের শুরু থেকে। সব শুনে নিশ্চয় সে ক্ষমা করবে।
বাবা এখনো ঘরে ফেরেনি। পুকুর ঘাটে বসে ইষ্ট নাম জপ করছে। সান্ধ্য মুহূর্তটা জগদীশ বাবুর এই ভাবেই কাটে। অন্ধকার গাড় হলে বাড়ি এসে এটা সেটা নিয়ে পাচঁ দশ কথা হয় স্ত্রীর সাথে। তার বেশীরভাগই ভালোবাসা বিবর্জিত। মনে হয় এই বুঝি ঝগড়া লেগে গেলো স্বামী স্ত্রীতে। বুড়ো বয়সে এটাই বুঝি সময় কাটানোর আধুনিক পদ্ধতি। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে কারও পক্ষেই সামান্যতম ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।
জগদীশ বাবু ফিরে এসেই হয়তো তিমিরকে জিজ্ঞাসা করবে তোর চাকরীর কোন ব্যবস্থা হলো। অন্য সময় তিমির বাড়ী এলে পুকুর ঘাটেই বাবার সাথে দু’চার কথা আলাপ হয়। ভালোই লাগে। একটা শান্ত নির্মল পরিবেশ। শান বাঁধানো ঘাট। চাঁদের অলো পরে জলগুলো ছোট ছোট ঢেউ খেলে যায়। কোন কোলাহল থাকে না। শম্পা এসে দাদু দিদিমার চিতায় সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে যায়। আজ বাবার মুখোমুখি হতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। বাবা যদি জিজ্ঞাসা করে তবে কি জবাব দেবে। শরীরটাও যেন ক্রমশঃ অচল হয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই মাথা ঘুরায়। খাওয়ার প্রতি কোন আগ্রহ নেই। ভয় হয়ে। সময় বুঝি ফুরিয়ে এলো।
তিমির নিজের মনে হাসতে চেষ্ঠা করলো।
শম্পা তখনও পড়ছে। দেশ হতে দেশ দেশান্তরে, ছুটছে তারা কেমন করে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্নিপাকে। তিমির নিজের মনে গত দিনগুলোর কথা ভাবে। কত দ্রুত ঘটে গেলো অনেককিছু। জীবনের একটা কাল অধ্যায়। যে নেশাটাকে তিমির বেশী ভয় করত সেই নেশাটায় এখন কাল হয়ে দাড়িয়েছে। মৃত্য ভয় তাড়া করছে সব সময়। যে অন্যায়গুলোকে সবচেয়ে বেশী এড়িয়ে চলতো সেগুলোর সাথেই যে কিভাবে জড়িয়ে পড়লো। অপরাধ বোধটায় তিলে তিলে ধ্বংস করছে। আজও একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে।
ভাবতে ভাবতে একসময় বিস্মিত হয়। জগদীশ বাবু আসন ঘরে সন্ধ্যা আহ্নিক নিয়ে ব্যস্ত। সুর করে গীতার শ্লোক পড়ছে। গুরুর নাম জপ করছে। হো হো করে হেসে উঠে তিমির। অনেকটা পাগলের মতো। শম্পা হা করে তাকিয়ে আছে। হাসি থামল অনেক্ষন পর। হাসি থামল অথচ হাসির রেশটুকু বিন্দুমাত্রও স্থায়ী হলো না।
– দাদা তুমি কি পাগল হলে নাকি। ওভাবে হাসছো কেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল শম্পা।
– পাগল হলে ভালোই হতো রে। আচ্ছা শম্পা আমি যদি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যায় তোরা কি আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবি।
– বারে! তাড়াবো কেন। তোমাকে বড় ডাক্তার দেখিয়ে ঠিক ভালো করে আনবো।
– কিন্তু অত টাকা পাবি কোথায়? আচ্ছা পাগল না হয়ে যদি মরে যায় তোদের খুব খারাপ লাগবে না রে?
– তুমি ওভাবে কথা বলছো কেন দাদা?
– এমনি। হঠাৎ মনে হলো তাই বল্লাম।
– আমি মরতে দেবো না।
– কিভাবে ঠেকাবি।
– জানো দাদা, আমি যখন ঠাকুর ঘরে পুজো দিতে যায়, তখন ঠাকুর প্রনাম করে কি বলি জানো।
– কি বলিস।
– বলি, তোমার যাতে একটা চাকরী হয়। তোমার চাকরীটা হলে আমাদের আর কোন কষ্ট হবে না।
তিমির শম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অবলীলায় চোখে জল এলো। শম্পা বুঝতে পারেনি তিমিরের ব্যাথাটা কত গভীরে। শম্পাকে আদর করে বললো – লক্ষী বোন আমার, এখন থেকে ঠাকুরের কাছে আর কিছু চাসনে। তার কাছে কিছু চাইতে নেয়। আমি আর চাকরী করবো না।
– কেন।
এর উত্তরটা দেওয়া সম্ভব নয়। তিমির স্পষ্ট বুঝতে পারছে কাজ করার মত মনের জোড় আর সাহস কোনটায় নেই। শম্পাকে পড়তে বলে তিমির বারান্দায় গিয়ে বসে। ভালো লাগছে না। নিজের ঘরের সাথে এক ধরনের লুকোচুরি। এড়িয়ে চলতে চাইছে সবাইকে। কতক্ষন পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলো। বাইরে ঘন অন্ধকার। অন্ধকারে দাদু দিদিমার শ্মশান মন্দিরের ক্ষীন আলোক রশ্মিটা চোখে পরছে। মন্দিরের অলোটা এখনও পুরোপুরি নিভে যায়নি। বাতির বুক জ¦লছে। মুছি বাতি। সন্ধ্যায় সামান্য তেল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় শম্পা। তেল ফুরিয়ে গেছে। সলতেটা শুধু নিভে যাওয়ার আগে ভালো করে জ্বলছে। একটু পরেই নিভে যাবে। অন্ধকার হয়ে যাবে চারিদিক। উঠোনের বড় আমগাছটার আড়াল থেকে হুতুম পেঁচা ডেকে যাচ্ছে বার বার। সন্ধ্যার সময় এ বড় অলুক্ষণে ডাক। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দটা বড় বিভৎস মনে হচ্ছে। পুকুরের অগ্নি কোণ থেকে একটা বিড়াল কান্না শুরু করেছে। বিদঘুটে কান্না। ঠিক মানুষের মত। তিমিরের বড় ভয় হচ্ছে। এ সমস্ত লক্ষনগুলো মোটেও শুভ লক্ষন নয়। কিসের যেন অশুভ ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে আসছে।
হরি কাকা দোকান থেকে ফিরছে। হাতে হারিকেন। কাঁধে গামছা বাঁধা ঝুলি। আজ হাটবার। সম্ভবত: মাছ কিনেছে। ভ্যাপসা একটা পঁচা মাছের গন্ধ। তিমিরকে অন্ধকারে পুকুর ঘাটে বসে থাকতে দেখে হারিকেন উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল-
– কে।
– আমি। হরি কাকা চিনতে পারে।
– কবে এলি।
– এইতো। আজ বিকালে।
তিমিরের কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এক্ষুনি হয়তো জিজ্ঞাসা করবে-চাকরী বাকরী কিছু জুটেছে। না কি আগের মত সেই টিউশনি দিয়েই চলছে। না, আজ আর কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। সম্ভবত: মাছ পঁচে যাচ্ছে। তাই ঘরে যাবার তাড়া আছে। নয়তো খুটিয়ে খুটিয়ে সব জিজ্ঞাসা করতো।
বয়স হয়েছে হরি কাকার। তবুও কোন রকমে মুদির দোকানটা আগলে ধরে আছে। পুঁজি পাতি খুব সামান্য। প্রতি হাটবারে শুধু একটু মাছ খাওয়া হয়। তাও সন্ধ্যার পরে যখন হাট ভেঙ্গে যায় তখন কেনে। সে সময় দামটাও একটু কম থাকে। ভাংতি মাল বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে কম দামে বেচে দিলে পরিশ্রমটা কমে। কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতে হয় না। মাছ তরি তরকারির দামটাও কম থাকে। শেষ বাজার বলে কথা। তিমির খেয়াল করে গামছা ভিজে পঁচা মাছের পানি পরে লুঙ্গির কাঁচাটা ভিজে গেছে।
হরি কাকা এগিয়ে যায়।
চলবে———-