প্রথম আলোয় মানব সভ্যতা
আমার বেশিরভাগ কবিতা বড় হয়। তাই অনেকে বলেন যে আমার কবিতা ভাল লাগে তাদের কিন্তু একটু বড়। এই কবিতাটাও বড়। কিন্তু পার্ট করে পোস্ট করলে ঠিকভাবে বুঝতে সমস্যা হবে। আরেকটা সমস্যা হতে পারে এভাবে লেখার কারণে। কিন্তু মাঝে মাঝে এভাবে লিখতে আমার ভালই লাগে। আর এই কবিতা পড়ে কেউ কেউ আমার উপর রাগ হতে পারেন। তাদের রাগানোর জন্য আগেই দূঃখিত বলে নিলাম। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সবসময়।
খুব ভোরে ঘুমে থেকে উঠে(সচরাচর যা হয় না) জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
মনটা অনেক ভাল হয়ে গেল(এই নয় যে মন খারাপ ছিল তবে এত ভোরে ঘুম
ভাঙ্গা খারাপ)। দেখি বিরাট লাল সূর্য উঠেছে। তবে অর্ধসমাপ্ত সেটা।
আমি তাকিয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে পুরো সুর্য দেখতে পেলাম।
ঘুমের হাই তোলতে ভুলে গিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
হঠাৎ চমকে উঠলাম। ‘বাহ এ কিভাবে সম্ভব হল!
আমার জানালা আমার জানা মতে দক্ষিন দিকে। তাহলে!
শোয়া থেকে উঠে আরও ভালভাবে লক্ষ্য করলাম কিন্তু না ঠিকই,
সূর্যই ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছে আর লালিমা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আমি বিস্মিত হলাম। তাড়াতাড়ি আমার ঘরের চারদিক তাকালাম, না ঠিকই আছে।
আমার জানা মতে যেদিক পূর্ব সেদিকে তাকালাম। নাহ কোন সূর্য নেই সেদিকে।
আমার মনে আছে সেদিকে জানালা না থাকায় কোনদিন আমি সূর্য দেখি না।
আসলে আমি ইচ্ছা করেই এই কাজ করেছি যাতে ভোরের আলো এসে
আমার ঘুমের কোন ক্ষতি করতে না পাড়ে।
আমার জানা আছে যাকে সবাই সুন্দর
সকাল বলে থাকে আমি সেই সব সকালে
চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকতাম, আর দক্ষিনা মিষ্টি বাতাস
উপভোগ করতাম। তাই হঠাৎ এ রকম অবস্থা আমার কাছে
কল্পনার বাইরে। ঘরের বাইরে গিয়ে সব লক্ষ করলাম না অন্য কোন কিছুরই পরিবর্তন নেই।
কিছুই বুঝতে পারলাম না। কাউকে জিজ্ঞাসা করবো সে ইচ্ছাও হল না। যদি তারা আবার পাগল ভাবে।
তাই নিজেই বুঝার চেষ্টা করলাম। চুম্বক দন্ড নিয়ে কোনটা কোন দিক তা দেখতে লাগলাম।
দিক ঠিকই আছে। শুধু আমার ঘরে আলো ঢুকতো না বলে সূর্য সরে এসেছে, এই ব্যাখ্যাই পেলাম।
প্রথমে হাসি পেল। পরে কিছুটা ভয়। আবার হাসি। মনে মনে বললাম, পাগল হয়ে গেলাম নাকি?
কি করব ভেবে না পেয়ে নিজেকে কয়েকবার আঘাত করলাম, ব্যাথায় কাতরালাম, জেগেই আছি।
তার পর ভাবলাম কিছু খেয়ে নেয়া যাক। তারপর ভাবা যাবে এ বিষয় নিয়ে। তাই করলাম।
খেয়ে যখন ঘর থেকে বের হলাম তখন দেখি লাল সূর্য আর লাল নেই তবে দিক এখনো একই।
এক এক করে উঁকি দিতে লাগলাম এক এক বাড়িতে। একটা বিষয় দেখলাম সবাই একসাথে বসে।
কি নিয়ে যেন কথা বলছে। একটা বিষয় হল এখানে সবার বাড়ির অবস্থাই এক। সবাই ঘুমাতে
পূর্ব দিকে জানালা রাখেনি, আমার মত সবার দরকার শুধু দক্ষিনা মৃদু মিষ্টি হিমেল হাওয়া।
আমার মনে হল সবার বুঝি একই অবস্থা। আমার ঘরে অন্য কোন সদস্য না থাকায়
আমি আলোচনা করতে পারছি না। কিন্তু তারা তো অনেকে থাকে তাই
আলোচনা করছে একসাথে ঘরে বসে। বাইরে বের হচ্ছে না।
আসলে দরকারও তো তেমন নেই। আমি কি করব
বুঝতে পারছি না। হঠাৎ একটা বিষয় মনে পরল।
এক মেয়ের কথা যে মেয়ে বিভিন্ন ছলে
আমাকে খাবার দিয়ে গেছে বারাবার।
আমি এ নিয়ে তেমন প্রশ্ন করিনি। এ ভেবেই খুশি হয়েছি
যাক আমার আর রান্না করতে হবে না। ভাবলাম তার বাসায় গেলেই হয়।
তাই করলাম। এ ছাড়া তো আর কিছু করার নেই কারণ সপ্তাহে তিনদিন ছুটির মধ্যে আজ শুরু।
হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম তার বাসায়। আমাকে দেখে তার চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখতে পেলাম।
আমাকে নিয়ে গেল সে তার ঘরে। আমি কিছু বলার আগেই আমাকে কতগুলি খাবার দিয়ে
চলে গেল কোথায় জানি। সকালে তো তেমন কিছু খাইনি। তাই চুপচাপ খেতে লাগলাম।
কিছুক্ষনের জন্য সব ভুলে গেলাম। হঠাৎ সেই মেয়ে ঘরে ঢুকে বলে উঠলো,
‘আপনি এসেছেন ভালই হয়েছে। আমি চিন্তা করছিলাম এ নিয়ে।
হুজুর বলছে এ দেশে নাকি শয়তানের আছর লেগেছে।
এই জন্যই নাকি সূর্য দক্ষিন দিকে উঠেছে।’
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
যাক শুধু আমিই দেখিনি এটা।
তার মানে এটা সত্যি সত্যিই হয়েছে।
হঠাৎ হাসতে লাগলাম আমি। আমাকে দেখে
সে মেয়েও হাসতে লাগল। হঠাৎ আমার হাসি থেমে গেল।
আমার মনে পড়ল ভোরে দেখা রক্তিম সূর্যের কথা, আমাকে
বন্ধী করতে চাইলো তার রুপ। হঠাৎ যেন কি হয়ে গেল আমি উঠে
দাঁড়ালাম। তখনই তার মাতার ডাক শুনা গেল ‘ঐশী’ বলে। সে চলে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে সে বলল, সবাই সভা করবে
বলে ঠিক করেছে। আজ দুপুরে হবে সভা। কেন এমন হল? কেন সূর্য দক্ষিনে উঠে
গোলযোগ বাধালো, এ নিয়েই সভা ডাকা হয়েছে। আমি বিদায় দেবার কথা বললাম
কিন্তু তা করতে দিল না মেয়ে। কাঁদতে শুরু করল। ভাবলাম, এসে তো মহা বিপদে
পড়লাম। যথা সময়ে সভা শুরু হল। মসজিদের হুজুর, মন্দিরের পুরোহিত হতে
গির্জার ফাদার বা ভিক্ষু সবাই এক এক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করল। কিন্তু
কেউ কারও মত মানতে নারাজ যদিও সবার ব্যাখা প্রায় একই।
সবাই নিজের নিজের ধর্মের আলোকে ব্যাখ্যা করল
কোন খারাপ শক্তির কপলে পড়েছে দেশ।
এবং তা থেকে রক্ষা পেতে হলে
যে ধর্মের পন্ডিত ব্যাখ্যা করল
সে তার ধর্মকেই পুরো প্রাধান্য দিল।
তাই ক্রন্দলের সৃষ্টি হল। হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকল।
হঠাৎ দেখি সেই মেয়ে এসে আমার হাত ধরে সভা থেকে নিয়ে যেতে লাগল।
আমি প্রতিবাদ করার সুযোগ পেলাম না। আসলে তেমন ইচ্ছাই হল না। কেমন স্থবিরতা
গ্রাস করেছে আমাকে এই সভা বাকবিতণ্ডা। বাড়ির কাছাকাছি পৌছে সে প্রশ্ন করল আমাকে,
‘তোমার কি মনে হয় এমন কেন ঘটলো?’ আমি আসলে এ বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম না।
ভাবছিলাম তাকে নিয়ে। একাকিত্ব জীবনে যে স্বপ্ন দেখিনি সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।
তার কথায় আমার ঘোড় ভাঙলো। কি উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ দুষ্টমি মাথায়
চাপলো। বললাম, ‘মনে হয় কোন ঘরের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকতে পারে না বলে এ কাজ
করেছে সূর্য, দেখ না সবাই কেমন ঘর তৈরি করছে কোন জানালা রাখে নি পূর্বে।’
এ কথায় হেসে উঠল মেয়ে। বলল, ‘কেন দুপুরে তো সবার ঘরেই আলো ঢোকে।
দক্ষিনে তো সবারই জানালা আছে। যেমন আমার বা তোমার ঘরে আছে।’
‘তাতে কি হয়েছে?’ হাসতে হাসতে বলতে লাগলাম আমি,
ব্যাপার তো প্রথম আলোর। সে তো আর ঢুকতে
পাড়ে না কোনদিন। আর আমার মনে হয়
সূর্য এ জন্য রাগ কেউ তার
সকালের মিষ্টি রোদে যায় না।
সবাই তো দুপুর পর্যন্ত ঘুমায় এখানে।’
‘তা তো হবেই। সবার অফিস তো দুপুরে।
সকালে উঠে কি করবে? তুমিও তো ওঠো না।
সকালের খারার দুপুরে নিয়ে গিয়েও তোমাকে শতবার
ডাকতে হয়েছে।’ মেয়ে বলতে লাগল। সে থামলে আমি
বিদায় নিতে চাইলাম কিন্তু সে তা হতে দিল না। আমাকে তার
কক্ষে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘বাইরে গিয়ে কাজ নেই। যে ক্রন্দল শুরু হয়েছে
কখন কি হয় কে জানে। আমি তোমাকে কোনভাবেই মরতে দিতে পারব না।’
এ কথা শুনে আমার অনেক ভাল লাগল। কেউ তো কখনো এভাবে বলেনি আমাকে।
এই ভাললাগাকে বুকে নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি টেরই পেলাম না।
ঘুম ভাঙলো সূর্যের কিরণে। তার মানে সকাল হয়ে গেছে আবার।
নাকি আবার কোন পরিবর্তন। সন্দেহ জাগল মনে।
কারন ঘুমিয়েছি গতকাল দুপুরে ভাবলাম।
সত্যি হলে তো অন্তত খাবার জন্য
হলেও মেয়েটি ডাকতো আমাকে।
আমি কক্ষ হতে বের হলাম।
বাইরের উঠানে দেখি কয়েকটা লাশ।
আরও অবাক হলাম। এ কিভাবে হল।
দৌড়ে গেলাম সেখানে। দেখি সে মেয়ের নিথর
দেহ পড়ে আছে সেখানে, প্রিয়ার নিথর দেহ পড়ে আছে সেখানে।
পাগল করে দিল অদ্ভুৎ সব চিন্তা। বের হয়ে গেলাম বাড়ি থেকে,
আরও কয়েকটা লাশ পরে থাকতে দেখলাম এখানে সেখানে।
দেখি মাঠের কাছে আবার বৈঠক হচ্ছে।
গেলাম সেখানে। শুনতে লাগলাম।
কে একজন বলে উঠল,
এর কোন প্রতিকার নেই।
দক্ষিনের দরজা বন্ধ করে দাও।
সবাই উচ্চস্বরে তার পক্ষে বলতে লাগল।
আর একজন বলে উঠল, এটাই ঠিক হবে।
আর যদি কোন কেউ এর প্রতিকার করতে পারে
তাহলে আবার জানালা খুলে দেয়া হবে। বা বাড়ির সম্মুখভাগ
পরিবর্তিন করা হবে। তাই হোক তাই করা হোক। সবাই
উচ্চধ্বনি করল। ধর্মের প্রতিনিধিরা চুপটি মেরে বসে
সবাই চোখেই লোভের ঝিলক। ভাবছে সেই প্রমান
করবে সেই সূর্যের দিক পরিবর্তন করেছে।
ধীরে ধীরে সবাই সরে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।
ভাবতে লাগলাম, কে মারল মানুষ।
কেউ তো তা নিয়ে কথাও বলছে না।
কেঁদে উঠল মন। ভাবতে লাগলাম কেনই বা
এমন হল। আবাক লাগল কি যেন বুঝলাম আমি।
প্রথম আলো আসল কিন্তু কেউ টের পেল না।
সবাই তাকে তাড়িয়ে দেওয়াতে ব্যাস্ত।
আর উলটো তারা রক্ত পান করল।
আসলে কি এই আলো
আমাদের দরকার নেই?
সবাই কি এই অন্ধত্বে বাস
করবে যুগ যুগ ধরে? আর
আবেগহীনভাবে চলতে থাকবে মানব সভ্যতা?
এ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম। প্রিয়ার কাছে
যাবার কোন ইচ্ছাই হল না। কেমন যেন হয়ে গেলাম।
সে লাশ তো কবর দেয়া উচিৎ। কিন্তু আমাকে যেন গ্রাস
করল সীমাহীন নির্লিপ্ততা। ঘরে গিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
কারণ কোন কাজ ছিলনা, অফিস ছিলনা। কাজ করার ইচ্ছাও ছিলনা।
আশপাশ থেকে অনেক শব্দ শুনলাম। তার মানে তারা সবাই
সূর্যের আলোর প্রবেশের পথ বন্ধ করছে।
কিন্তু আমি কিছুই করলাম না।
শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে গেলাম ধীরে ধীরে।
আমার যখন ঘুম ভাঙলো।
দেখি আমার ঘরে কোন আলো নেই।
কিন্তু আমি আশা করেছিলাম।
উঠে গেলাম জানালার কাছে
দেখি কোন সূর্য দেখা যাচ্ছে না।
ঘর থেকে বের হলাম দেখি সবাই
বুঝি আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে।
সবাই হাতজোড় করে প্রনামের ভঙ্গিতে।
আমি বুঝতে পারলাম না, কি হচ্ছে।
দেখি আমার ঘরের উপর দিয়ে হলুদ
সুর্য হানা দিচ্ছে। সকলে হাঁটু গেঁড়ে বসল।
আমি কি করব বুঝতে পারলাম না।
চোখ দিয়ে জল আসল মানুষের
অসহায়তা দেখে। দৌড়ে গিয়ে ঘরে
প্রবেশ করলাম। আবার শুয়ে পড়লাম খাটে।
ভাবতে লাগলাম আমি হারিয়েছি আমার প্রিয়ারে।
১১২১৩, ঢাকা।