উটন দাদুর কাহিনী–পর্ব–১৪(শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
গম্ভীর গলায় উটন বলল,সে ল্যাংটাগুলো আমাদের ধরতে আসছে! ওরা জানে এই জঙ্গল ছেড়ে আমরা বেশী দূর যেতে পারব না।
সময় এগিয়ে চলছিল,দ্রুতপদে ওরা সবাই জঙ্গল ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। পেছনের দিকের জঙ্গলে বুনোদের চীৎকার ধ্বনি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তার মানে ওরা তাদের অনুসরণ করেই এগিয়ে আসছে।
রাবুনকে কাঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলতে পারছিল না বনুই। ও বিশ্রাম করতে বসে পড়ল। উটন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো আমাদের বসবার সময় নেই। বাঁচতে হলে এবার দৌড়াতে হবে–নতুবা বুনোরা আমাদের ধরে ফেলবে।
শমী এবার রাবুনকে কাঁধে তুলে নিলো। সবাই দিন ভরের ভয়, আতঙ্কে বড় ক্লান্ত–উটন দাদুর দেওয়া সামান্য খাবারে কারো পেট ভরে নি–সে খাওয়াও তো অনেক আগের। শরীরে জলের কমিও ধরা পড়ছিল। ভীষণ পরিশ্রান্ত সবাই। নেচুও আর পার ছিল না ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে এগিয়ে চল ছিল।
–না,আমাদের ছুটে চলতে হবে—উটন ঊর্ধ্ব শ্বাসে কথাগুলি বলে উঠলো।
পেছনে বুনোদের হই হল্লার আওয়াজ সমানে বেড়ে চলেছে। উটন দৌড়তে শুরু করল। বাকি সবাই উটনের পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলো। ছুটবো বললেই ছোটা যায় না। ঘন জংগল,লতা-পাতা, ছোটবড় ডালপালা সামনে বাধার সৃষ্টি করে—অনেক সময় সেগুলিকে ভেঙ্গে বা কেটে ফেলে সামনে এগোতে হয়।
নেচু দৌড়াতে পারছিল না–ওর গায়ের ব্যথা অনেক বেড়ে গেছে। সামনে পা ফেলতেই ব্যথা কেমন টনটন করে উঠছিল। এ দিকে শমী,রাবুনকে নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গেল নবু,বনুই, কুন্তা ওরা সবাই উটন দাদুর সঙ্গে সমান তালে ছুটে চলার চেষ্টা করছিল।
পেছনে গমগম আওয়াজ,হৈহল্লা আরও বেড়ে গেছে। কিছুই করার নেই–উটন মনে মনে ভীত হয়ে পড়েছে–সে বুঝতে পারছিল যে তাদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে চলেছে !
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আন্দাজ মত চলতে হচ্ছে–ফালি চাঁদ যে সামান্য আলো দিচ্ছিল তাতে আলো-ছায়া মিলে ঘোর ঘোর ভাবের সৃষ্টি করেছিল। তাও সেটুকু আলোও কখনও কখনও গাছের আড়াল হয়ে যাচ্ছিল। ঘন জঙ্গলের গভীর অন্ধকারময় গাছের ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে মাঝে মাঝে যে চুয়ানো আলোটুকু আসছিল তাকে সম্বল করে,আর হাতের ছোড়া,গুপ্তি দিয়ে ছোট বড় ডালপালা কেটে ওরা দ্রুত এগিয়ে চলছিল এক দিশা ধরে। হাতের টর্চ জ্বালাবার কোন উপায় ছিল না–জ্বাললে বুনোরা ওদের পালাবার নির্দিষ্ট পথ চিনে ফেলবে–আর ওদের চট করে ধরে নেবে।
কিন্তু বুনোরা আর বেশী দূরে নেই–ওরা বেশ বেগেই ওদের দিকে ধেয়ে আসছে ! কি করে বুঝতে পারছে ওদের পালাবার দিশা ? মনে হয় উটন বাধ্য হয়ে এক,দুবার মুহূর্তের জন্যে যখন টর্চ জ্বালিয়ে ছিল তখন থেকেই ওরা আলোর আভাস পেয়ে গিয়ে থাকবে–ওদের পালানোর দিশা কিছুটা আন্দাজ করে নিয়ে থাকবে। আর সেই আভাস মত ওরা উটনদের দিকে ওদের নাক বরাবর ধেয়ে আসছে। আর তা ছাড়া বুনোরা জঙ্গলে চলে অভ্যস্ত–ওরা এসব বন জঙ্গল চেনে–তাই উটনদের চলার গতি থেকে ওদের গতি অনেক বেশী।
আরও কাছে এসে গেল বুনোদের দল—হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ স্পষ্ট কানে আসছিল। ওদের হাতের মশালগুলি অনতি দূরে দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে দেখা গেল। নেচু আর শমী আর চলতে পারছিল না। ওরা চাপা চীৎকারে বলে উঠলো,দাদু আমরা আর পারছি না।
সে কথা উটনদের কারও কান পর্যন্ত পৌঁছল না–সবাই এখন নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—চাচা,আপন প্রাণ বাঁচা– এমনি একটা ক্ষণ এখন তাদের সামনে এসে পড়েছে। রাবুন ভয়ে কাঁপছিল, ও শমীকে বারবার জড়িয়ে ধরছিল। নেচুর মনে হচ্ছিল যে বুনোদের হাত থেকে আর বাঁচন নেই !
সবাইকে একবারে ধরা দেওয়া কোন কাজের কথা নয়–উটন তবু চেষ্টা করল,কিছুটা জোর গলায় সে বলে উঠলো,নেচু,শমী তোরা সবাই কোন গাছে উঠে লুকিয়ে পড়!
উটন দাদুর সাবধানতার কথা মনে পড়ে গেল নেচুর,ও বলে উঠলো,শমী,ওরা যদি আমাদের ধরে ফেলে তবে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বি–আর হাত দুটো সামনে দিয়ে প্রণামের ভঙ্গী করে থাকতে হবে।
রাবুন কথাটা জানে–তবে ওর প্রতি বুনোদের রাগ অনেক বেশী থাকবে–অন্য কোন উপায় না পেয়ে রাবুনকে একটা গাছের আড়ালে রেখে শমী ঝাপটানো এক গাছের ওপরে চড়ে বসলো। নেচু বেচারা কি করবে ! সে আর একটু এগিয়ে গিয়ে চারদিকে শাখা-প্রশাখা ছড়ানো একটা গাছ দেখে তার নিচের দিকে ঝুলে থাকা একটা ডাক ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেল। অসহায় রাবুন গাছের গোঁড়ায় জড়সড় হয়ে নিশ্চুপ পড়ে ছিল। সে জানে বুনোরা তাকে নিশ্চয় খুঁজে পেয়ে যাবে। তার মৃত্যুর আর বেশী দেরী নেই–মরণ তার শিয়রে অপেক্ষা করছে !
খানিক সময় পরেই বুনোরা হুড়মুড় করে এসে গেল সেখানে। রাবুন আড়াল থেকে মশালের আলোয় দেখতে পেলো ওদের দলে অনেক লোক–অন্তত বিশ-পঁচিশ জন তো হবেই। ওরা হৈ হৈ রই রই রবে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক এমনি সময়,সাবধানতা সত্ত্বেও রাবুনের হাতের নিচের বা পায়ের নীচের চাপ পড়ে শুকনো পাতায় খসখস শব্দ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে বুনোদের এক জন—হাকুয়া, হাকুয়া করে চীৎকার করে নিজের ভাষায় কিছু জানান দিয়ে উঠলো।
সাথে সাথে কয়েকজন বুনো থেমে গেল–কাতরাই,কাতরাই করে বুনোদের কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠলো। ওরা কিছু একটা সন্দেহ করেছে হবে। আশপাশের জঙ্গল ওরা খুঁজে দেখতে লাগলো। ওদের মধ্যে থেকে কজন হঠাৎ চীৎকার করে ডাক দিয়ে উঠলো,সাঙ্গু,সাঙ্গু…পৌ পু পৌ পৌ,ওদের ভাষায়–ওই ওই, পেয়েছি,পেয়েছি এমনি কিছু হবে বোধহয়। সবাই ছুটে গেলে চীৎকার করে ওঠা লোকটার কাছে। রাবুনকে ওরা দেখে ফেলেছে। ওরা সবাই তাদের হাতিয়ার নিয়ে ওকে ঘিরে ফেলল। এবার ওদের কজন মিলে পাথরের হাতিয়ায় দিয়ে ওকে আঘাত করতে লাগলো। রাবুনের আর্তনাদে
জঙ্গলের নির্জনতা খানখান হয়ে ভেঙে যেতে লাগল। বুনোদের চোখে তখন আগুন জ্বলছিল। পালিয়ে যাওয়া খাদ্য ওরা আবার সামনে পেয়েছে। মুখে তাদের খাদ্য লালসার রস জড় হচ্ছিল। এক সময় আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রাবুন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কজন বুনো মিলে গাছের লতা দিয়ে ওর হাত পা বেঁধে নিলো,আর চ্যাংদোলা করে নিয়ে বাকি শিকারের উদ্দেশ্যে দ্রুত এগিয়ে চলল জঙ্গল ধরে।
বুনোদের মনে আনন্দ–যে শিকার তারা হারিয়ে ছিল তা আবার তারা ফিরে পেয়েছে !
রাবুন আধ ঘুম-জাগরণের মাঝে বুঝতে পারছিল,ওর শরীর থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝরছে–ব্যথায় সে কাতর–মৃত্যু তার হাতের কাছে ! সে জানে যে বুনোরা তাকে কেটে ফেলে তার দেহের কাঁচা মাংসই খুবলে খাবে !
রাবুনকে যারা নিয়ে যাচ্ছিল তারা দুলকি চালে চলছিল,মুখ থেকে তাদের আনন্দ সূচক শব্দ বেরিয়ে আসছিল। কখনো আবার ওরা বিকৃত মুখ নিয়ে হেসে উঠছিল। অজানা কথা ও ইঙ্গিতে ওরা পরস্পর মনের ভাব প্রকাশ করছিল। ওদের মধ্যে একজন আচমকা চীৎকার করে উঠলো,সে পিছন দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে কি যেন বলছিল। বুনোরা এক এক করে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। চীৎকার দেওয়া লোকটার কাছে ছুটে এলো–মনে হল ওরা গাছে নেচুর উপস্থিতির ব্যাপারে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। নেচুর গায়ে আঘাতের ব্যথা–আসলে ও এক ভাবে গাছে বসে থাকতে পারছিল না। ব্যথায় ও কাতরে,কাতরে উঠছিল। ও যখন সামান্য নড়েচড়ে উঠেছিল তখন গাছের ডালপালাও সামান্য নড়েচড়ে উঠলো। এমনি অসতর্ক মুহূর্তে হয়তো কোন বুনোর কানে সে শব্দ গিয়েছিল। সে তাই টের পেয়ে চীৎকার করে উঠেছিল।
বুনোরা শব্দের উৎস ধরে গাছে গাছে খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাদের শিকার। কান পেতে আবার আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছিল। তাদের মশাল উঁচু করে গাছের ঝোপ ঝাড় খুঁজে ফিরছিল।
নেচু বেচারা নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না। একে তো তার পায়ে ব্যথা,তার ওপর এক ভাবে স্থির হয়ে অনেক সময় থাকার দরুন ওর শরীরের ব্যথা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ও নড়েচড়ে দেহর ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্যে যেই চেষ্টা করতে গেল অমনি ব্যাপারটা ঘটে গেল। হঠাৎ ধরে রাখা গাছের ডাল থেকে তার হাত ছুটে গেল,আর নিচে হুড়মুড় করে এসে পড়ল সেই গাছেরই নিচের একটা মোটা ডালের ওপর। বুনরা নেচুকে দেখে নিলো—ওরা এবার হই হল্লা করে উঠলো। ওদের ভিতর থেকে দু-তিনজন তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে গেল। নেচুর পা ধরে ওরা হেঁচকা টান মারল।
ক্রমশ…