Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

সালিশিনামা (ধারাবাহিক গল্প-৫)

: | : ০২/০১/২০১৪

(পাঁচ)

তবে হাজী সাহেবের কথায় সবাই একমত হলেও বৃত্তাকার সভার একেবারে ও মাথায় সামনের দিকে ছড়ি হাতে মাটিতে বসা ষাট বছরের বৃদ্ধ দিনমজুর ওমেদ আলী কিন্তু একমত নয়। বয়সের ভারে ভগ্ন শরীরে তার অতটা শক্তি না থাকলেও বিবেকের বলিষ্ঠতায় সে হাজী সাহেবের তিরষ্কার করা কথার প্রতিবাদ করে বলে- হাজী সাব এটা ক্যামন কথা কন ? এক হাতে তালি বাজে ? মেয়েটার না হয় শরম নাই, ছেলেটারও কি নাই ? সে কি করে একটা বিবাহিতা মেয়ের কাছে যায় ?’
জনতার মধ্য থেকে কে একজন খেই খেই করে ওঠে- ঐ বুড়া এত প্যাঁচাও ক্যা ? তুমি কি বিচারক নাকি ?’
ওমেদ আলী আবার কি বলতে যাবে এমন সময় আরও ক’জন খেই খেই করে ওঠা লোকটাকে সমর্থন করে চেঁচিয়ে ওঠলে এই বৃদ্ধ বয়সের শীতল রক্তেও যেন তার যৌবন কালের তেজস্ক্রিয়তা হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে। তবে তা প্রকাশ পাবার আগেই জুলুমবাজ হিসেবে খ্যাত মীর জাফর ম-ল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে বলতে থাকে- তুমিই তাহলে বিচার করো আমরা যাই ?’
সভাময় আবারও গুম গুম শব্দ ওঠে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় ওমেদ আলীর ফিরে পাওয়া যৌবনের তেজস্ক্রিয়তা শীতল হতে সময় লাগে না। তবে কোণ ঠাসা হয়ে পড়লেও ভেতরে সে জবাই করা কবুতরের মতো ছটফট করতে থাকে। প্রথমে ওমেদ আলীর কথায় হাজী সাহেব আহত হলেও গণতান্ত্রিক নিয়মের খাতিরে তিনি নিজেকে সামলে নেন এবং একই সঙ্গে অনেকে তার প্রতিবাদ করে ওঠায় মনে মনে তিনি খুশি হন। যেন তিনি এতে কিছুই মনে করেননি এমন একটা ভাব নিয়ে সবাইকে শান্ত হবার আহবান জানিয়ে আবার বলেন, এটা সালিশি বৈঠক। কথার পিঠে কথা বলার অথবা ভুল ধরবার অধিকার সবারই আছে। যাই হোক রাত অনেক হয়ে গেছে। বিচার আর দীর্ঘায়িত করা যাবে না। চেয়ারম্যান সাহেব ব্যস্ত মানুষ তাকে আর আটকে রাখাও ঠিক হবে না। তবে ঘটনা যা ঘটেছে তা কম-বেশি আপনারাও অবগত আছেন। দোষ যে উভয়রেই আছে তা আমরাও বুঝতে পেরেছি। তবে মানুষ মাত্রই দোষ-ত্রুটি থাকে তাই মানুষ মাত্রই ভুল করে। জগতে এমন কোন ঘটনা নেই যার কোন ফয়সালা নেই। আপনারা ধৈয্য সহকারে আর একটু অপেক্ষা করেন চেয়ারম্যান সাহেব এর ফয়সালা দিবেন।’
সভার সামনে কল্পনা যেখানে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল সে সেখানেই ছিল মূর্তির মতো। দিনমজুর ওমেদ আলীকে শাসানো দেখে সম্ভবত সাত্তার মিয়াও ঘাবড়ে গেছে। তাই সেও আর কথা বলে না। ওমদে আলীর মতো আরও দু’চার জন কথাটা ধরলে না হয় কথা বলা যেতো, কিন্তু সত্যি সত্যি আর একটি লোকও তাদের পক্ষে কথা বললো না। তাই সে তার নিজের সাহসিকতার উপরও ভরসা হারিয়ে ফেলে যেন। তবে কথা বলার সাহস না পেলেও মনে মনে সে আশাবাদী যে, মেয়েটার একটা কূলকিনারা তো হবেই।
চেয়ারম্যান সাহেব আবার কি বলতে যাবেন এমন সময় হাজী সাহেব তার কানে কানে কি বললেন, তাৎক্ষণিক দু’জনেই উঠে জমায়েতের বাহিরে চলে গেলেন। দেখা দেখি তাদের সারিতে আরও যারা ছিলেন একে একে তারাও উঠে গেলেন। সবশেষে রইচ কেরানীও উঠে গেলেন তার ছেলেদের সাথে কথা বলতে। অপেক্ষমান লোকদের মধ্যে আবারও মৃদু গুঞ্জন উঠলো। নীচু স্বরে কথাবার্তা চলতে লাগলো।
মিনিট দশেক বিরতির পর আবার পূণর্জমায়েত হলে চেয়ারম্যান সাহেব জব্বার মিয়াকে ডাকলেন। উপস্থিত লোকেরা হঠাৎ কৌতুহলি হয়ে উঠে জব্বার মিয়াকে দেখার জন্য। তার কথা যেন সবাই ভুলেই বসেছিল। অসংখ্য উৎসুক দৃষ্টি এলোমেলো ভাবে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের উপর নিক্ষিপ্ত হয়। এরপর দম বন্ধ করা কয়েকটা মূহুর্ত কেটে গেলে দু’হাতে ঘন জঙ্গল কেটে কেটে আসার মতো মানুষের ভিড় ঠেলে ঠেলে জব্বার মিয়া সামনে আসে। অবাক চোখে সবাই তার দিকে তাকায়। আশ্চর্য তো লোকটা ! যার মেয়েকে নিয়ে এতো কান্ড সে কি না দাঁড়িয়ে থাকে পিছনে। তবে জব্বার মিয়া যে একজন নিরীহ মানুষ গ্রামের লোকেরা তা জানে। আর জানে বলেই তাদের অনেকেই আফসোস করে মনে মনে। তাই বলে তার হয়ে জোর গলায় কথা বলে ঝুঁকি নেয় না কেউ। রক্তের রক্ত হলে, নয়তো গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তি হলে না হয় ভাবা যেতো তার কথা।
ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ায় জব্বার মিয়া। চোখে মুখে তার সব হারানোর শুন্যতা।

(চলবে..)

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

 

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top