দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ৭
( পূর্ব প্রকাশিতের পর : )
সালেহা বেগম ছেলে আতিকের সংসারে আছেন প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল । এর আগে কখনোই এখানে তার টানা দেড় দুই মাসের বেশি থাকা হয়নি । আসলে সারা জীবন গ্রামের মুক্ত বাতাসে জীবন যাপন করে অভ্যস্ত সালেহা বেগমের এই নাগরীক ফ্ল্যাট বন্দী জীবনে কেমন যেন হাঁফ ধরে যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই । আর তাছাড়া এখানে মন খুলে কথা বলার মতন মানুষেরও যেন বড্ড অভাব ।
ছেলে তো সারাদিন তার অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেই , তার মধ্যে মাসের অনেকটা সময়ই তাকে কাটাতে হয় দেশের বাইরে । আগে বউমাও নাকি স্বামী ছেলে নিয়ে সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়াতো দেশ বিদেশ – শুনেছে সালেহা । কিন্তু সালেহার জন্যই সম্ভবত এখন আর তাদের কোথাও একসাথে যাওয়া হয় না – এটা সালেহা নিজেই বুঝতে পারেন খানিকটা হলেও ! এবং এই জন্য বেশ অপরাধবোধেও ভুগেন বুঝি তিনি ।
কিন্তু তা স্বত্ত্বেও আসলে কিছু করার নেই সালেহার । ইচ্ছা থাকার পরেও ফিরে যাওয়ার কোন পথই যে খোলা নেই তার সামনে । কোথায় ফিরবেন তিনি ? তার সারা জীবনের লড়াইয়ের যে হাতিয়ার – স্বামীর রেখে যাওয়া পায়ের নীচের শক্ত মাটিটুকু , যার উপর দাঁড়িয়ে আজীবন লড়ে গেছেন জীবনের সমস্ত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে ! তার সেই ভিটেটুকু যে সর্বশেষ বন্যার ভাঙ্গনে গিলে খেল সর্বনাশা যমুনা !
তাইতো তাকে সারাজীবনের জন্য পিঠটান দিয়ে চলে আসতে হলো পরাজিত সৈনিকের মতন !
না ।
তাই বলে এখানে খুব অসুবিধা যে হচ্ছে – ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয় আসলে । তার জন্য এ বাড়িতে নিজস্ব কাজের মানুষ সহ মোটামুটি সব ধরনের ব্যবস্হাই করা হয়েছে । প্রতি সপ্তায় নিয়ম করে কাজের মানুষকে নিয়ে সারাজীবন পায়ে হেঁটে পথ চলায় অভ্যস্ত সালেহা বেগম গর্বিত ভঙ্গিতে ছেলের গাড়িতে চড়ে যান ডাক্তার দেখাতে । সময় মতন পান জর্দাসহ আনুষাঙ্গিক দরকারী সব জিনিস তিনি পেয়ে যান ফুরিয়ে যাবার আগেই ।
তাহলে ?
পুত্রবধুর সাথে সম্পর্কে কোন সমস্যা ?
নাহ ! তেমন কিছুও নয় । আসলে তার ছেলের বউ নিজেও সারাদিন খুব ব্যাস্ত থাকে । চাকুরী না করলেও বিভিন্ন ধরনের কি সব সংগঠনের কাজে তাকে অনেক ছুটাছুটি করতে হয় নানান জায়গায় – ছেলের কাছেই শুনেছে সালেহা । বাসায় থাকলেও সারাদিন নানারকম লোকজন আসে বউমার কাছে । সন্ধ্যার পরেও প্রায় প্রতিদিন বের হয়ে বাড়ী ফিরে অনেক রাতে । এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রথমদিকে একটু অবাক হয়ে ছেলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন । ছেলে শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছিল বউমা ক্লাবে যায় !
ব্যাপারটা আজও সালেহার কাছে ঠিক পরিষ্কার নয় । গ্রামে থাকতে তিনি ক্লাব বলতে বুঝতেন ওটা শুধু ছেলেদের ব্যাপার । তার স্বামীকেও দেখেছেন ক্লাব নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে । যেখানে গ্রামের কিশোর যুবকদের নিয়ে নানান সামাজিক কাজকর্ম করা হত । হ্যাঁ , তখন না হলেও ইদানিং ঐ ক্লাবে গ্রামের মেয়েরা নানান সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজে অংশ নিতে দেখেছেন । কিন্তু তা বলে প্রতিদিন নিয়মকরে সন্ধার পর থেকে অনেকটা রাত্রি পর্যন্ত ঐসব মেয়েদের ক্লাবে অবস্হান করতে শোনেননি বা কখনো দেখেননি সালেহা ।
যাই হোক , এনিয়ে কোন বাড়তি প্রশ্ন কখনোই ছেলেকে করেননি সালেহা । বড় শহরের বড় মানুষদের আলাদা নিয়ম বলেই বুঝে নিয়েছেন তিনি ।
বড় মানুষ ?
হ্যাঁ , নিজের পুত্রবধুকে আসলে সব সময় বড় আর উঁচুতলার মানুষ হিসেবেই জেনে এসেছেন সালেহা । আর জেনেছিলেন ছেলের মুখ থেকেই । তার একমাত্র সন্তান আতিক তখন পিতার স্বপ্ন পূরণ করে দেশের সবচেয়ে বড় আর সম্মানজনক বিদ্যামন্দির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবচেয়ে উঁচু পাশ দিয়ে বছর দুই হলো চাকুরীতে ঢুকেছে । ছেলেই তাকে জানিয়েছিল সেটি তাঁর বাবার আরেকটি স্বপ্নমতন সরকারী চাকুরী নয় যদিও । কিন্তু বেসরকারী হলেও বেশ উঁচু পদের সম্মানজনক চাকুরীই ছিল সেটা । স্বামীর ইচ্ছার কথা মনে করে খানিকটা মনঃক্ষুন্ন হলেও মেনে নিয়েছিলেন ছেলের উদ্ভাসিত মুখ দেখে । বাঁধা দেননি ।
চাকুরী পাবার পর থেকে আতিক প্রতিমাসেই তখন নিয়মকরে মায়ের কাছে চলে আসে সময় পেলেই । মায়ের কাছে দু একদিন কাটিয়ে ফের ফিরে যায় নিজ করমক্ষেত্রে । ততোদিনে বলতে গেলে সালেহা বেগমের সব সংগ্রামেরও অবসান ঘটেছে । ছেলে তার ভার বইবার মতন উপযুক্ত হয়েছে । বইছেও । অবশ্য এক্ষেত্রে সালেহা বরাবরই নিজেকে একটু ভাগ্যবানই ভাবতে পারেন চাইলে । কারণ মেধাবী পুত্রটির পড়াশোনার খরচ নিয়ে তাকে আসলেই কখনো খুব বেশি ভাবতে হয়নি ।
যাই হোক , আতিক সেবার এসে কেন যেন সারাদিনই মায়ের পিছন পিছন ঘুরঘুর করেছিল খুব । সেই ছোট্টবেলাটির মতন । যেন মাকে কিছু বলতে চাইইছে সে খুব করে । অবাক হলেও কিছুই জিজ্ঞেস করেননি তিনি বরাবরের মতন । কারণ জানতেন ছেলে নিজে থেকেই সব বলবে আসলেই যদি তেমন কিছু বলার থাকে তার মায়ের কাছে ।
শেষমেষ রাত্রিবেলা খাওয়া দাওয়ার পর ভীষণ লাজুক কিংবা হয়তো খানিকটা কুন্ঠা নিয়েই আতিক মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরেছিল একটি মেয়ের ছবি । ভীষণ সুন্দরী মেয়েটির ছবি দেখে সালেহা ভেবেছিলেন নির্ঘাৎ কোন সিনেমার নায়িকার ছবি তাকে দেখাচ্ছে ছেলেটা !
এবার তিনি সত্যি অবাক হয়েছিলেন । এবং আরও বেশি অবাক হয়েছিলেন ছেলের পরবর্তী বক্তব্য শুনে ।
মেয়েটির নাম অনামিকা । বিরাট বড়লোক বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে । তারা একসঙ্গেই পড়ানোশা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেখান থেকেই তাদের ভাব পরিচয় আর ভাব ভালবাসা । এখন তারা বিয়ে করতে চাইছে । কারন আতিক নাকি বিদেশী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে । এই খবরটা অন্তত সালেহা জানতেন বিদেশে পড়তে যাওয়ার বিষয়ে ছেলেটি বেশ চেষ্টা চরিত্র করছে অনেকদিন ধরেই । মাকে বলেছিল আতিক । তবে সেটা যে ঠিক হয়ে গেছে তা জানতেন না সালেহা । আরো জানতেন না আগামী মাস তিনেকের মধ্যেই যে ছেলেকে যেতে হবে । অনামিকার বাবা মায়ের নাকি ইচ্ছা ওরা বিয়ে করে একসাথেই বিদেশে যাক যেহেতু ওকে যেতে হচ্ছে প্রায় তিন বছরের জন্য ।
আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল সালেহার জন্য সে রাত্রে । গ্রাম্য সহজ সরল জীবনে অভ্যস্ত সালেহা বেশ খানিকটা ধাক্কাই খেয়েছিলেন যখন শুনলেন আতিক আসলে চাকরী করছে অনামিকার বাবারই অফিসে ! তিনি সম্ভবত ছেলের কাছ থেকে প্রথম কষ্টটাও পেয়েছিলেন সেদিনই ! বিশেষ করে ছেলের কথা শুনতে শুনতে যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে ছেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই একটা কাঁটা ছকে উন্নতির দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে নিশ্চিত গতিতে । এবং সেটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ছেলেরই হবু শ্বশুড়ের হাত ধরে হবু স্ত্রীকে উপলক্ষ্য করে !
না । ছেলে বড় মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে সমাজে এনিয়ে কোন কষ্ট নেই সালেহার । তিনি বরং ছেলের মুখে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ফিরিস্তি শুনে বিস্ময়বোধের সঙগে খুশীও হচ্ছিলেন বটে । শুধু গর্ববোধটুকু কোথায় কোন আত্বসম্মানের দেয়ালে যেন মাথা ঠুঁকছিল প্রয়াত স্বামীর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া একটি স্বপ্নের কথা ভেবে ।
আহাদ মাষ্টার স্বপ্ন দেখতেন তার সন্তানটি একদিন নিজের প্রচেষ্টায় নিজের হাতে আকাশটা ছোঁয়ার মতন বড় হবে !অনেক বড় !
কিন্তু ছেলে যে আজ নিজের স্বপ্ন পূরণের কঠিন পথটা হবু শ্ব্শুড়ের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় সহজ উপায়ে অল্প সময়ের মধ্যে পাড়ি দিতে চাইছে – তা না বললেও সালেহা কিভাবে যেন টের পেয়ে যাচ্ছিলেন । ব্যাপারটা তাকে সত্যিই বেশ পীড়া দিচ্ছিলো ! সেই সাথে নিজেকে কেমন যেন দূরের মানুষ বলেও মনে হচ্ছিল তার ! বিশেষত এতসব ঘটনাবলী তাকে তারই একমাত্র সন্তান কিনা জানাচ্ছে এই শেষ বেলায় ! তার কি এইসব কিছু আরেকটু আগে থেকে জানার কোন অধিকার ছিলো না !
ভীষণ অভিমান হলেও ছেলেকে সেদিন তার মনের চাঁপা কষ্ট অনুভূতির কথা মোটেও বুঝতে দেননি সালেহা । এমনকি আজও না ! হাসিমুখে বরং সম্মতি দিয়েছিলেন ছেলের বিয়েতে । এমনকি যোগ দিয়েছিলেন ছেলের চোখ ধাঁধানো বিয়ের অনুষ্ঠানেও ।
আর সেদিনই বুঝি তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ছেলে যা বলেছিল তার বউমা আসলে তার চেয়েও অনেক বড়ো ঘরের মেয়ে ! আর তার চাইতেও বড় কথাটি হল , তার নিজ গর্ভে ধারণ করা সন্তানটি আজ তাদেরকে চোখের পলকে ডিঙ্গিয়ে উঁঠে গেল অনেক অনেক উঁচুতে !
কিংবা বলা যায় অনেকটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে !!
( চলবে )