দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ৮
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
ছেলের বিয়ে নিয়ে সালেহা বেগমের বুকে জমে ওঠা অভিমান অবশ্য খুব বেশিদিন থাকেনি । নিজের মনের উদারতার সঙ্গে একমাত্র সন্তানের প্রতি গভীর মমত্তবোধ আর চেয়েও বুঝি অপরাধী ছেলের ব্যকুল আকুতিই শেষ পর্যন্ত ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছিল একজন মায়ের সমস্ত চপা অভিযোগ ।
বিয়ের আগের দিন সন্ধাবেলা যখন চকচকে বিরাটাকার সাদা একটা গাড়ী থেকে নিজের বাড়ীর সামনে নামলো আতিক তখন শুধু সালেহাই নয় , ভীষণ অবাক হয়েছিল আশেপাশের মানুষও । যারা জানতো তাদের প্রিয় আহাদ মাষ্টারের ছেলে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি পেয়েছে জীবনে প্রতিষ্ঠার সাফল্যও – তারা যেন সেদিন প্রত্যক্ষ প্রমানও পেল । পরদিন সকালে সেই গাড়ীতে চড়েই ছেলের সাথে রওয়ানা দিয়েছিলেন সালেহা ।
কিন্তু দুপুরবেলা ছেলের বাড়ী এসে ভীষণ অবাকই হলেন সালেহা । এই একরুমের ফ্ল্যাটটা আতিক নিয়েছে পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেড়ে চাকুরীতে ঢুকার পরেই । মাঝেরই মাপের শোবার ঘরের সাথে সুবিধা বলতে লাগোয়া একচিলতে রান্নাঘর আর বাথরুম । আর তাই এর বাহারী নাম ফ্ল্যাট । তবে অবশ্যই একজনের থাকার জন্য বেশ ভালোই চলনসই । ছেলের এই বাড়ীতে এর আগে দুবার কদিন করে থেকেও গেছেন সালেহা ।
তখনও যেমন দেখেতেন আজও ঠিক তেমন অগোছালো অবস্হাতেই পেলেন ছেলের শোবার ঘরটা । এমনকি রান্নাঘরের অবস্হাও যাচ্ছে তাই করে রেখেছে ছেলে ! আগের কথা না হয় আলাদা ছিল । একা জীবন কাটাতো বাউন্ডুলেটা । কিন্তু এখন তো আর তা নয় । কে বলবে এই কামরার মালিক আজই বিয়ে করে নতুন বউ তুলতে যাচ্ছে এ ঘরটাতেই ।
নাহ , অযথা অভিমান করে থাকাটা ঠিক হয়নি তার । এমন কিছু যে হতে পারে আঁচ করে ছেলের কথামতন কদিন আগে চলে এলেই পারতেন ! এখন নতুন বৌয়ের সামনে মান সম্মান গেলে তো তার যাবে না ! যাবে নামী মানুষটার মান !
– ঘর দুয়ারের একি বেহাল দশা কইরা রাখছো বাপ ! আইজ এই ঘরে এই হালতে তুমি নতুন বউ উঠাইবা ? ইমুন জানলে তো আমি কাইল রাইতেই আইসা পড়তে কইতাম তুমারে আমারে লইয়া !
শেষের কথাগুলো যেন নিজের অপরাধবোধ ঢাকার চেষ্টাতেই বলেছিলেন সালেহা ।
– তুমারে এই লইয়া ভাবতে অইবো না মা ! তুমি অহন ইকটু আরাম কইরা লও । রাইতে তো ঝামেলাও আছে ম্যালা । সব সারতে কত্ত রাইত অইব কে জানে ? তুমার শইল খারাপ করবো মা ।
– হ , আমার পোড়া কপাল আর কি ! তুই যে ইমুন আকাইম্মার মথন কাম কইরা রাখবি আমি কি আর বুজছিলাম ! অন্যায় অইছে আমার । মস্ত অন্যায় । অহন সর দেহি আমারে সব ঠিকঠাক কইরা লইতে দে । আমি পরাণ থাকতে ইমুন আউল্যাইন্যা ঘরে আমার নতুন বউরে নিয়া আসতে পারতাম না ! ঘরে কি নতুন চাদ্দর বালিশ আছে ? না তাও নাই ! না থাকলে সোজা দুকানে যাও ।যত্ত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কিন্যা আনো গিয়া !
হড়বড় বিরক্ত ভঙ্গিতে বকেই যাচ্ছিলেন সালেহা যতক্ষন না ছেলে এসে থামালো তাকে ।
– মাগো তুমারে এই সব নিয়া ইকটু ভাবতে অইবো না । সব ঠিক আছে মা । তুমি এইহানে চুপ কইরা একটু বসো আগে । আমার কথা ইকটু মন দিয়া হুন ।
সালেহাকে হাত ধরে বিছানায় এনে বসায় আতিক ।
– মা ! মাগো !
তর্ক করতে বা বকতে যাচ্ছিলেন বুঝি সালেহা কিন্তু তার দু হাত ধরে পায়ের কাছে বসা ছেলের ব্যাকুল ডাক উল্টো তাকেই আপ্লুত করে তুললো ।
– কি বাজান ? কিছু কইবা ?
ডানহাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ভীষণ মমতায় ছেলের মাথার উপর রেখে শুধালেন সালেহা ।
– আমি জানি তুমি আমারে ভুল বুইজা রইছো মা । কিন্তুক তুমি বিশ্বাস করো মা আমি কুনু লোভ লালসায় পইইড়্যা এই বিয়া করতাছি না । তুমি কি আমারে সেই শিক্ষা দিছ মা ? আইজ অনেক বছ্ছর ধইরা আমাগো সম্পক্ক ! আমি সত্যই অনুরে পছন্দ করি মা । আর তুমার বউমাও দেইখো খুব ভালা মাইয়া । সেও আমারে খুব …. !
সম্ভবত মায়ের সামনে সংস্কারবশতই কথাটা শেষ করতে পারে না আতিক ।
– আমারে তুমি পরথম থিকা সব কও নাই ক্যান বাজান ? আমি তো তোমারে কুনুকিছু গোপন করা শিখাই নাই বাপ । কুনু কামে আটকাইও নাই ! তাইলে এত্তবড়ো কথাটা আমার কাছে লুকাইলা ক্যামনে তুমি ?
– আমি অনেকবার অনুর কথা তুমারে কইতে চাইছি মা । সাহস পাইনি । আমার শরমও আছিল মা । কিন্তুক এইভাবে যে আমার আৎকা কইরা বৃত্তিটা ঠিকঠাক হয়া যাইব আর সময়ও মিলব না – আমি বুইঝা উঠবার পারি নাই গো মা ! আমি অন্যায় করছি মা ! আমি পাপ করছি । আমারে তুমি মাপ কইরা দাও মা ।
মায়ের কোলে মুখ গুঁজে এবার ফুঁপিয়ে ওঠে আতিক । কয়দিনের জন্য মনে মনে হারিয়ে ফেলা ছেলেকে বুঝি আরেকবার খুঁজে পান সালেহা ।
– আরে করস কি ! করস কি পাগলা আমার ! আইজকার এই শুভ দিনে কি কানতে আছে বাজান ।
– তাইলে কও মা আমারে তুমি মাপ করছো ?
– হ করছি গো বাজান করছি । তুমি উইঠা আমার লগে বহো । আমি তোমাগো মন খুইল্যা দুয়া করতাছি । তুমরা অনেক সুখী অইবা বাজান । তুমার বাপজানও উপর থিকা তুমাগোরে অনেক দুয়া দিতাছেন তা সব সময় জাইনো । তয় বাজান , খালি একটা বিষয়ে আমার মনের মধ্যে ইকটু কামুড় দিতাছে !
– কি মা ?
– এই যে তুমি শ্বশুড়ের হেনে কাম করতাছ এইডার কতা কইতাছি বাপজান । মাইনষে হুনলে আবার খারাপ কইবো না ! আর শ্বশুড়বাড়ীর সাহাইয্যই যুদি লইবা তাইলে আর এত্তো কষ্ট কইরা পড়লাই বা ক্যান বাপ ?
– হুন মা , এই ঢাকা শহরে এইসব নিয়া মাথা ঘামানের সময় কারুর নাই ! আর তাছাড়া মা তুমি জাইন্যা রাইখো আমি কিন্তুক যাইচা পইড়া উনার কাছে যাই নাই । আমি এম এ পাশ করার পরে ভার্সিটি সহ আরো কয় জাগায়ই কিন্তুক ভালা কয়ডা চাকরী পাইছিলাম । করছিও কয়মাস অন্য জায়গায় বড় পোষ্টে । এরমইধ্যে একদিন অনু কইলো অগো কোম্পানীতে আরো বড় পোষ্টে লোক নিব । আমারে কইলো তার বাবার সাথে সব কাগজপত্তর লইয়া দেহা করতে । এই হুইনা পরথমে আমি কি জিগাইছিলাম জানো মা ?
– কি বাজান ?
– জিগাইছিলাম উনি আমাগো কথা জানেন কিনা ! ও কইলো জানে না । তহন আমি ওরে প্রমিস মানে ওয়াদা করাইছিলাম আমার জন্য বাপের কাছে যুদি কুনু সুপারিশ না করে একমাত্র তাইলেই আমি যামু নিয়মমতোন ইন্টারভিউ দিতে । আমার মেরিট দেইখা যুদি চাকরী দেয় করমু ! নাইলে আমার দরকার নাই !
ছেলের কথা শুনে যেন নিজের দেয়া শিক্ষা আর স্বামীর রেখে যাওয়া আত্বমর্যাদাবোধ পুনরায় ফিরে পেতে থাকেন সালেহা ।
– তাই যুদি অইবো তয় সত্যই কিন্তুক তুমি অন্যায় করছো বাজান আমারে সব না জানায়া । অন্তত তোমার শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা জানার আগে সব কথা জানলে আমি নিজে আগে যাইয়া আমার সোনার টুকরা পোলার লাইগা বউমারে তার বাপের কাছ থিকা আবদার কইরা নিতাম ।
– আমার ভুল অয়া গেছে মা ।
– হ বাজান । এইডা তুমার মস্তই ভুল অইছে ।
– যা অওনের অইয়া গেছে মা । অহন তুমি ইকটু বিশ্রাম নিয়া নেও । ইকটু বাদে মেমান আইবো ।
– মেমান ? কারা ? তুমার বন্দু বান্দবরা বাজান ?
– না গো মা । অরা অহন না । সব সন্ধার পরে আইবো । অহন আইবো তুমার নতুন বিয়াই – বিয়াইন । তুমার লগে দেহা করতে আইতাছে ।
বলতে বলতে মাথা নীচু করে লাজুক হাসে আতিক।
– বিয়াই আর বিয়াইন সাবে আইব ? অহন কি করতে ? রাইতে তো দেহা অইবোই ?
বিচলিত অপ্রস্তুত কন্ঠে বুঝি আর্তনাদই করে ওঠেন সালেহা । ছেলে তাকে এ কি বিপদে আর লজ্জার মধ্যে ফেলছে তাকে বরবার । তার বেয়াই – বেয়ান প্রথমবারের মতন তার সাথে দেখা করতে । অথচ তিনি কিনা নিজেই সে খবর জানেন না ! এখন এই বেহাল পরিবেশের মধ্যে কি আপ্যায়ণের ব্যবস্হা করবেন তিনি ? এমন হলে কি আহাদ মাষ্টারের মান থাকবে ?
– উনারা দেশে আছিলেন না মা অনেকদিন । সেইজন্য তুমার লগে নিয়মমতন বিয়ার আগে সাক্ষাৎ করতে পারে নাই । তাই অহন একফাঁকে চিন পরিচয় অয়া যাইবো ইকটু ।
– আয় হায় ! নতুন কুটুম আইতাছে ! তাও পয়লা পরথমবার । অহন আমি তিনাগো কি দিয়া সমাদর করি কও তো ?
– তুমি অযথা ভাইবা মইরা যাইতাছ মা । আমি কইলাম তো উনারা বেশিক্ষণ বইবো না । খালি দু কথা । নিয়ম রক্ষা যারে কয় ।
– হ , তুমি কইলা আমি হুনলাম । আমি যা কই অহন তা তুমি করবা । সোজা মিষ্টির দুকান থিকা সবচে ভালা মিষ্টি আর লগে যা পারো অক্ষনি নিয়া আসবা তুমি । আমি এই ফাঁক দিয়া ঘরটারে যট্টুক সম্ভব ঠিক করি ! কি অইলো ? ব্যাক্কলের মথন খাড়ায়া রইলা ক্যান ? যাও না ? নাইলে কিন্তুক আমি অক্ষনি যেইদিক দুই চক্ষু যায় চইল্যা যামু ! এরপর তুমার মেমান তুমি সামলাও । তুমার বিয়া তুমিই কইরা লও । আমি থাকমু না সাফ কথা !
– যাইতাছি রে মা যাইতাছি !
মায়ের দাবড়ানি খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় আতিক !
( চলবে )