নিলাম
‘মানুষ সম্পর্কে আমার ধারনা খুব একটা ভালো নয়।’ আমি বসে বসে বিতানীন জাতীয় উত্তেজক তরল পানীয়ের জন্য অপেক্ষা করছি, ঠিক তখনই একজন আমার সামনের গ্রানাইটের শক্ত আসনে বসামাত্র আমাকে উদ্দেশ্য করে গলার স্বর যতটাসম্ভব নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে কথাগুলো বলল। অন্য সময় হলে আমি হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘কেন?’ আন্তঃনক্ষত্রীয় মহাকাশযানের রওনা হবার ঠিক আগে বেশ কিছু উপদেশবানী শুনিয়ে দেয়া হয়।
‘হাইপার ডাইভের সময় ভয় না পেয়ে সিটবেল্ট বেঁধে রাখুন।’
‘অহেতুক কারও সাথে তর্কে জড়াবেন না।’
‘মানুষ হতে সাবধান থাকবেন।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরই মধ্যে আমার পানীয় চলে এসেছে। আমি আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে চোখ প্রায় বন্ধ করে এই কড়া পানীয় গিলতে শুরু করি। ইউনিট স্বল্পতার জন্য ট্রানজিট প্যাসেঞ্চারের টিকিট কেটেছি বলে এখানে এসেছি মহাকাশযান বদলাতে। আমার গন্তব্য নোরা নক্ষত্রপুঞ্জ। যে মহাকাশযানে করে এখানে এসেছি সেটি সময়মত পৌঁছাতে না পারায় এখান থেকে পরেরটি ধরতে পারিনি। আমাকে এজন্য দুসৌরদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আমি এখন একটি ছোটখাচ পাবে বসে আছি। ট্রাভেল এজেন্সী বলেছিল এটি পাঁচমাত্রার কৃত্রিম উপগ্রহ হবে। কিন্তু আসলে তাতো নয়ই বরং এখানে মহাকাশদস্যুদের অবাধ বিচরণ দেখে ভয়ই পাচ্ছি। ছুটি কাটানোটা বোধহয় পুরোপুরি মাটি হয়ে যাবে। ফিরতি পথে ফিরে যাব কিনা ভাবতে ভাবতে আড়চোখে লোকটির দিকে তাকালাম। বেশ পরিচ্ছন্ন পোশাক, চুল ঘাড় অবধি নেমে এসেছে, কালে সুদৃশ্য দুল ঝুলছে। চোখের দিকে তাকিয়ে আমি থমকে গেলাম। দীর্ঘদিন মহাজাগতিক সভ্যতা নিয়ে গবেষণার ফলে ব্যাপারটি খুব সহজেই ধরতে পারলাম।
ঘরটি অসম্ভব গমগম করছে। মহাকাশে এইসব পাবগুলোতে সবসময়ই ট্যুরিষ্টদের পদচারণায় মুখর থাকে। ফলে সবসময়ই মারিন্তা, ইআসিকো, মানুষ, স্কুটাবা, হঠাৎ হঠাৎ কিছু চেস্যারিয়ান্তো আর দুএকটি রবোট্রন দেখা যায় অবশ্য সব রবোট্রন নয়, যাদের কপোট্রনে থাকে মারিন্তা, ইআসিকোর মস্তিষ্ক। কিন্তু চেস্যারিয়ান্তো? নাহ! গ্যালাক্সীর এ প্রান্তে চেস্যারিয়ান্তোদের খুব একটা দেখা যায় না।
আমি চোখ-কান খোলা রেখে চারপাশ আরও ভালো করে দেখতে থাকি। কাছাকাছি একটি টেবিল ঘিরে ভালো তিনচারজন মারিন্তা তর্কে মেতে উঠেছে। সামান্য দূরে একজন স্কুটাবা। মহাবিশ্বে স্কুটাবা রা হচ্ছে সবচেয়ে রহস্যময় প্রাণী। নিজেদের প্রয়োজন ছাড়া অন্যকোন সভ্যতার ধারেকাছেও যায়না। তাছাড়া ওদের গ্যালাক্সীর থেকে কাছাকাছি অন্য যে গ্যালাক্সীতে প্রাণী বসবাস করে সেটাও অনেকদূরে। আর বাস্তবিক অর্থে ওরা মহাবিশ্বের এককোনায় বসাবাস করে বলে খুব কম সভ্যতাই ওদের সম্পর্কে সামান্যকিছু জানে। জানালার পাশে দুজন তরুণ-তরুণী গভীর আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে। তরুণটি ইআসিকো কিন্তু তরুণটি শীনুতি। রুতুন গ্রহানু পুঞ্জে একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে মহাবিশ্বে সর্বাধিক গ্রহ পরিভ্রমন করে। সেখানেই বিপরীত দিকে ঘূর্ণায়মান দুটি গ্রহের সভ্যতা হচ্ছে ইআসিকো আর শীনুতি। যখন দুইগ্রহ পরস্পরের অস্তিত্ব জানতে পারে তখন দুটোই সভ্যতার চরমে। দুগ্রহের মধ্যে গড়ে ওঠে আশ্চর্য সেতুবন্ধন। আর এজন্য ইআসিকো আর শীনুতিদের সবাই কাজিন বলে।
লোকটি আবার বলল, ‘মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা খুব একটা ভালো না।’
এরকম একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা কেউ বারবার কাউকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকলে ভদ্রতার খাতিরে হলেও বলতে হয়, কি হয়েছে? আমিও বললাম, ‘কেন? কি হয়েছে?’
‘তুমি দেখছি কিছুই জাননা! খবর শোননি?’ এবার সে সত্যিই আমাকে অপমান করল। আমি মহাবিশ্বের হালচালের খবর খুব একটা রাখি না, তারপর এখন আমি ট্যুরিষ্ট। ইন্টার গ্যালাকটিক ওয়েব কর্নারে কবে যে চোখ বুলিয়েছি তা মনে করতে পারলাম না।
আমি পানীয়ের গ্লাসে তৃতীয়বারের মত চুমুক শেষ করে বললাম, ‘তোমার মত চেস্যারিয়ান্তোরা যে সব ব্যাপারে বেশী আগ্রহ দেখায় বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় তা নিতান্তই ছেলেমানুষী। সত্যি বলতে কি তোমরা এখনও বুদ্ধিমাত্তার দ্বিতীয়স্তরটি ডিঙাতে পারোনি।
আমিবোধ হয় ওর মর্মমূলে আঘাত হেনেছি। কারণ তার চোখ ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে।
রেগে গেলে চেস্যারিয়ান্তোদের এমনই হয়। সে ঠাস করে টেবিল চাপড়ে বলল, ‘তোমরা আমাদের ছোট করতে পার না। এই মহাবিশ্বে তোমাদের যতটুকু অধিকার আছে আমাদেরও ঠিক ততটুকু অধিকার আছে। তুমি জান আমাদের সভ্যতা কতবছরের পুরোনো? ঠিক করে বল তুমি জান কিনা?’
আমি মাথা নারলাম। চেস্যারিয়ান্তোরা সত্যিকার অর্থেই সবচেয়ে প্রাচীণ বুদ্ধিমান প্রাণী। তাই কথা ঘুড়াবার জন্য আস্তে করে বললাম, ‘কি বলতে চাইছিলে বল?’
‘আমার ভুল হয়েছে মানুষের সাথে কোন কথা বলাই আমার উচিত হয়নি।’
এবার বোধহয় সে আমার মর্মমূলে আঘাত হানল। মানুষ মহাবিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী প্রাণী। তাকে এত সহজে কেউ অবজ্ঞা করতে সাহস পায় না। স্বীকার করছি এই চেস্যারিয়ান্তোটির সাহস আছে।
‘তুমি মানুষকে অপমান করার ধৃস্টতা দেখাতে পার না?’ আমি বললাম।
‘কেন? আমাদের গ্রহ দখল করেছ বলে ভেব না তোমাদের মথা মত আমরা উঠবস করব। মনে রেখ একদিন তোমাদেরও আমাদের মত পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ সে বোধ হয় আমাকে হুশিযার করে দিতে চাইল।
আমিও ওর কথার ঢঙ্গে উত্তর দিলাম, ‘দিবাস্বপ্নই দেখতে থাকো। আর মনে রেখ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাকে হারানো এতটা সহজ না।’
‘মানুষ সৃষ্টির সেরা নির্বোধ জীব।’ সে উত্তর দিল।
এই চেস্যারিয়ান্তোটি অহেতুক তর্ক করে ঝগড়া বাজাতে চাচ্ছে। আর ঘন্টাখানিক পরে আমার মহাকাশযানের সিডিউল। তাই এ মুহুর্তে মেজাজ বিগড়াতে চাইলাম না। উঠে গিয়ে কাউন্টারে বিল মিটিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম। সামনে লম্বা কড়িডোর। আমি সেদিকেই পা বাড়াই। হঠাৎ কোত্থোকে যেন চেস্যারিয়ান্তোটি আরও কয়েকজন নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘শুনলে না মানুষ কী করেছে?’
আমি ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হই। নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে থাকি। ‘তোমরা যা করেছ তাতে মহাবিশ্বের সবাই তোমাদের বোকা নির্বোধ আর অপরিনামদর্শী বলবে। তোমরাতো কারও কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।’
কেউ একজন হেসে ওঠে, ‘কেন মুখ ঢেকে রাখবে।’ আমি তখন শেষমাথায়।
চেস্যারিয়ান্তোটি চিৎকার করে ওঠে, ‘শুনে যাও তোমরা কী করেছ? তোমরা তোমাদের জন্মগ্রহকে নিলামে চড়িয়েছ; পৃথিবীকে নিলামে তুলেছ। তোমাদের পায়ের তলায় এখন আর মাটি নেই।’
একজন বলে ওঠে, ‘আফসোস! কেউ কি কখনও শুনেছে সন্তান মাকে নিলামে তুলেছে। ’ অন্যএকজন বলে, ‘মানুষ পারে মানুষ সব পারে কারন… ’
কারনটা আর আমি শুরতে পারি না। সবার অট্টহাসিতে কথা ঢাকা পড়ে যায়। আর ঠিক তখনই আমার মহাকাশযান এসে পৌঁছাল ওদের কথায় কান দেওয়ার সময় আমার কাছে নেই। সময় কোথায় সময় নষ্ট করার। আমাকে পৌঁছাতে হবে নোরা নক্ষত্রপুঞ্জে।