দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ৯
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
সেদিন বিকেলবেলা যখন সালেহার নতুন হতে যাওয়া কুটুমরা এলো সবে তিনি তখন সব গুছিয়ে আসরের নামায পড়ে উঠেছেন । সেই সময় আতিক বাসাতেই ছিল । নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার কাজ সেরে নিচ্ছিলো সে আস্তে আস্তে । যদিও ছেলের এই গদাইলস্করী চালে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর কোন মানেই তিনি খুঁজে পচ্ছিলেন । সন্ধার পর বিয়ে অথচ বিকেলবেলা অবধি যার বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তুতি বলতে কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না – সে কি করে এমন নিশ্চিন্তে থাকতে পারে কিংবা কোন সে আলাদিনের জ্বীন তার আয়ত্বে আছে যে কিনা এ লহমায় গন্ধমাদন পর্বত প্রয়োজনের সময় মুহুরতে এনে হাজির করবে , তা ভেবে নিজেই যেন আতঙ্কিত বোধ করছিলেন সালেহা ।
যাই হোক এসব নিয়ে ভেবে মাথা নষ্ট হবার আগেই নতুন কুটুমেরা এসে হাজির হলো । আতিকই নীচ থেকে গাড়ীর জোর হর্ণের আওয়াজ শুনে তাদের গিয়ে নিয়ে এলো । প্রথমে চারজন এসে একে একে নিজেদের বয়ে আনা বিশাল সব মিষ্টি আর ফলের প্যাকেটের বোঝা সালেহার সামনে মেঝের উপর নামিয়ে রেখে যেমন এসেছিল তেমন করেই বেরিয়ে গেল । নিঃশব্দে । সালেহা তাদের কোথায় বসতে বলবেন ঠিক করতে করতেই যেন ঘটনাটা ঘটে গেল চোখের পলকে ।
তাদের বিদায়ের খানিক বাদেই আতিকের সাথে দারুন সুবাস চারপাশে ছড়াতে ছড়াতে ঘরে ঢুকলো দুজন কেতাদূরস্ত নারী পুরুষ । এর মধ্যে পুরুষটিকে মাঝবয়েসী পেরিয়ে যাওয়া মনে হলেও সাথের মহিলাটিকে বেশ যুবতীর মতই মনে হল সালেহার কাছে । অন্তত তার সাজ সজ্জায় ।
মহিলাটি কে ? আতিক তো বলেছিল বৌমার মাও আসবে ! কিন্তু ইনাকে তো তেমন বয়সী বলে মনে হচ্ছে না ! আর কাউকে দেখাও তো যাচ্ছে না । তাহলে বৌমার মা কাজের চাপে আসতে পারেননি ? হতেই পারে ! মহিলার নিজের মেয়ের বিয়ে ! কত্তো কাজের চাপ তার এখন !
নিজের মনেই মুহুর্তে এতসব কিছু একসাথে ভেবে নিলেন সালেহা ।
দুজনকে একনজর দেখলেই বোঝা হয়ে যায় তারা অনেক উঁচু তলার মানুষ । এবং সালেহাও তা বুঝতে পেরে ফের গুটিয়ে গেলেন যেন শামুকের ভেতরে !
– আমার মা ।
ঘরের মাঝখানে ঠায় দাঁড়ানো বৃদ্ধা সালেহাকে পরিচয় করিয়ে দিতে আগন্তুক দ্বয় বুঝি একটু থমকালেন । আসলে তারা ঘরে ঢুকেই দেখতে পেয়েছিল সালেহাকে । কিন্তু তবু তাদের দৃষ্টি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল অন্য কাউকে ! কিন্তু আতিক তাদের দৃষ্টি সালেহার প্রতি আকর্ষণ করায় তাদের বিস্মিত ভঙ্গির সাথে মুহুর্তের জন্য বুঝি কপালে উঁদিত হয়েছিল খানিকটা কুঞ্চণরেখা । কিন্তু তা ঐ মুহুর্তের জন্যই আসলে । কারণ পরমুহুর্তেই দুজনার মুখে একই সাথে ফুঁটে উঠেছিল দারুন উৎফুল্লতায় উদ্ভাসিত হাসি ।
সবার আগে প্রতিক্রয়া দেখালেন ভদ্রমহিলাটি ।
– থাক । থাক আতিক । তোমাকে আর পরিচয় করিয়ে দিতে হবে । আমরাই সেরে নিচ্ছি নিজেদেরটা ।
আতিক সম্ভবত কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল । কিন্তু শুরুতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা দারুন হর্ষোৎফুল্ল এবং অতি অবশ্যই অকৃত্রিম আন্তরিকতায় দু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন সালেহাকে সজোরে ।
– ও মাই গড ! ইনিই আমার একমাত্র বেয়ান ! হা ! হা !
– বেয়ান সাহেবা ইনি হলেন আপনার বেয়াই সাহেব ! আর আমি হলাম বুঝতেই পারছেন আপনার বেয়ান । আমরাই তারমানে আপনার বৌমাটির বাবা মা ।
যেন ভীষণ মজার কোন কৌতুক বললেন এমনভাবে নিজের কথায় নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়লেন সালেহা বেগমের হবু বেয়ান সাহেবা ! তার বাহুডোরে আবদ্ধ জড়োসড়ো হয়ে পড়া সালেহা নিজের মনেই বুঝি খানিকটা লজ্জা পেলেন বেয়ানের সাজসজ্জার কারনে অন্য কিছু ভেবে বসায় । আসলে বৌমার মাকে এতোটাই কম বয়েসী দেখায় যে একজন প্রায় তিরিশ বছর বয়সী মেয়ের মা হিসেবে তাকে চিন্তাই করতে পারেননি সালেহা ! অন্তত নিজের এতদিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিচারে !
তবে শেষ অবধি যাই হোক না কেন , তার নতুন বেয়াই – বেয়ানের ব্যাবহার সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত কোন ত্রুটি সালেহা কিন্তু খুঁজে পেলেন না । বিশেষ করে বেয়াই সাহেব তো প্রথমেই বারংবার তার আরও আগে দেখা করতে পারেন নি বলে প্রায় হাতজোর করেই ক্ষমা চাইলেন । ভূয়সী প্রশংসা করলেন আতিকের মেধা আর স্বভাব চরিত্র আর সততার । সেই সাথে এও জানালেন তিনি আতিকের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন শুধু ছেলে দেখে যে তা নয় । বরং পয়াত আহাদ মাষ্টার সমন্ধে বিস্তারিত জানার পরই তিনি আতিককে মেয়ে জামাই হিসেবে মনোনীত করেছেন । তিনি নাকি তার একমাত্র মেয়ের জন্য ঠিক এরকম সৎ আর বংশীয় পাত্রই খুঁজছিলেন মনে মনে ।
অন্যের মুখে নিজের সন্তান আর স্বামীর বংশের প্রশংসা শুনে ভেতরে ভেতরে আসলেই ভীষণ আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন সালেহা । বেশ গর্ব আর স্বার্থকও মনে হচ্ছিল নিজেকে স্বামীর স্বপ্ন মতন তার রেখে যাওয়া বংশধরটিকে সত্যিই মানুষের মতন মানুষ করতে পেরেছেন । এজন্য কথা শুনতে শুনতেই আল্লাহর দরবারে মনে মনে শোকরিয়া জানাতেও সালেহা ভুললেন না ।
তবে শেষদিকে বিদায় এসে তাদের ভেতর সৃষ্ট সৌহার্দ্য অনেকটাই কেটে যেতে বসেছিল একটা অপ্রিয় এবং সালেহার জন্য ভীষণ অপ্রত্যাশিত একটা প্রসঙ্গ এসে । ততোক্ষণে তার ছেলের বেশ কয়জন বন্ধুবান্ধব এসে পড়েছে । কিন্তু ঘরে সম্মানিত মেহমানরা থাকায় তারা ঢুকতে পারছিল না । অন্যদিকে মেহমানদেরও তখন দেরী হয়ে যাচ্ছে ।
– বেয়ান সাহেব বরের বন্ধুরা সব এসে পড়েছে । আমাদের জন্য বরকে ওরা রেডি করতে পারছে না । আর আমাদেরও দেরী হয়ে যাচ্ছে । চলুন চলুন আমরা বেরুই ।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন আতিকের শ্বশুর মশাই ।
– জ্বে আচ্ছা । আসেন । রাইতে তো দেখা হইবোই । ফি আমানিল্লাহ ।
– আরে রাতে মানে ! আপনি যাচ্ছেন আমাদের সাথে । আমরা তো সেজন্যই এসেছি বেয়ান সাহেবা ।
– আমি ? আমি অহন কই যামু ?
– কেন ? আমাদের মানে আপনার এই ভাইয়ের বাসায় যাবেন । গরীব আত্বীয়টার বাড়ীতে ছেলে – ছেলের বউ নিয়ে কয়টা দিন দাওয়াত খাবেন ।
এবার যেন ছেলের ঘরবাড়ী না গোছানোর মূল কারণটা ধরতে পারছেন সালেহা ।
– হ নতুন আত্বীয়র বাড়ীত তো যামুই বেয়াই সাব । তয় আজকা কেমনে যাই কন ! আগে পোলা আর পোলার বউরে ঘরে তো উঠাই । এরবাদে তো বেড়ান খেলানের লাইগা আল্লায় বাঁচাইলে সারা জনমই পইরা আছে !
– ইয়ে মানে বেয়ান সাহেব এই ঘরে তো দেখছেন একজন মানুষের জন্যই থাকাই কষ্টকর । এখানে নতুন বিয়ে করে সংসার পাতা … ! আর তাছাড়া ওরা যদি দেশে থাকতো তাহলেও না হয় কথা ছিল । কিন্তু ওরা তো দেশেই আছে আর বড়জোড় পনেরো বিশ দিন । এই কয়টা দিনের জন্য আবার নতুন বাড়ী ভাড়া করা আর তারচেয়েও বড় কথা ফার্নিচারসহ নতুন সব কিনে সংসার বসাতে যাওয়ার কোন অর্থই হয় না । খালি খালি আপনার ছেলেরই এত গুচ্ছের টাকা নষ্ট হবে বেয়ান ! তাই আমরা ডিসিসান নিয়েছিলাম এই বাকী কয়টা দিন আমরা সবাই ন হয় আমাদের ওখানেই একটু কষ্ট করে কাটিয়ে দেই !
হ্যাঁ , ব্যাপারটার সুবিধা নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছেন সালেহা । তারপরও কেন যেন নিজেকে আরেকবার এইসব আয়োজনের একেবারে বাইরের কেউ মনে হচ্ছে ! বুকের মধ্যে ফের দলা পাকিয়ে উঠতে চাইছে অনেকক্ষণ ধরে ভুলতে বসা অভিমানটা । মনে হচ্ছিল বুঝিবা ভেঙ্গে পড়বেন হয়তো এবার !
কিন্তু না ,উল্টো আচমকাই ভীষণ শক্ত আর কেমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনে হলো সালেহার নিজেকে । উপলব্দ্ধি করলেন সেই অদৃশ্যটা শক্তিটা ফের হাজির হয়েছে , যেটা জনমভীতু সালেহাকে হঠাৎ হঠাৎই কোন আঘাতে ভেঙ্গে পড়ার আগ মুহুর্তে একেবারে প্রয়োজনমত জুগিয়েছে নতুন করে লড়াইয়ের সাহস ।
এখনও তার ব্যতিক্রম হলো না । এতোক্ষণ যে সালেহা তার নতুন বেয়াই বেয়াইনের সামনে বসেছিলেন অনেকটাই কাঁচুমাচু হয়ে বসেছিলেন , সেই তিনিই যেন কোন যাদুবলে হয়ে উঠলেন প্রবল আত্বমর্যাদায় ভরপুর প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী এক নারীতে ।
– না বেয়ান সাব । আমার পয়লা পরথম দিন পোলার শ্বশুরবাড়ীতে থাকনটা মানায় না । আমরা গাঁও গেরামের মুখ্যুসুখ্যু মানুষ । আমাগো অনেক নাই নাই নিয়ম পালন করা অভ্যাস হয়া গেছে । হইতে পারে ভুল তয় তা অইলেও মরার আগ পর্যন্ত এই জীবনভর মাইনা আইসা ভুলগুলারে ঠিক করা আমাগো জন্য আর সম্ভব অইব না ! তাই এই গরিব বইনটার অক্ষমতারে নিজ গুনে মাফ কইরা দিয়েন ! আর হ , আপনেরা চিন্তা কইরেন না আপনেগো মাইয়া আর মাইয়ার জামাই আপনের বাড়ীতেই উঠব । আর ধইরা লন আইজ থিকা আমার পোলাডা আপনাগো হাতে দাসখত কইরা তুইলা দিলাম !
একটানা কথাগুলো বলার সময় একবারের জন্য এমনকি কনঠস্বর কাঁপলো না পর্যন্ত সালেহা বেগমের । তার কন্ঠস্বরের দৃঢ়তা নজর এড়ালো না মেহমানদেরও । এমনকি তাদের প্রবল ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে যাওয়া সামনে দাঁড়ানো বয়সের ভারে ক্ষয়াটে হতে ছোটখাটো মানুষটির কথায় আর প্রতিবাদ বা কথা বাড়ানোর মতন সাহসও বুঝি পেলেন না তারা । শুধু শেষবারের মতন হার মেনে নেয়া কন্ঠে খানিকটা চেষ্টা চালালেন আতিকের হবু শ্বশুর ।
– কিন্তু আপনি তা বলে নিজের ছেলের বউকে প্রথমদিন নিয়মমাফিক বরণ করবেন না ?
বেয়াই মশাইয়ের কথা শুনে বুঝি খানিকটা তীর্যক হাসির রেখা উঁকি মেরেই মিলিয়ে গেল সালেহা বেগমের ঠোঁটের কোন থেকে ।
– ক্যান করুম না বেয়াই সাহেব । নিশ্চই করুম । তয় আমাগো দেশে শ্বাশুড়ী আত্বীয়রা সব রীতি মাইনা বাড়ীর বউরে বরণ কইরা লয় শ্বশুরবাড়ীত আসনের পরই । অন্য কুথাও না । অন্তত আমাগো দেশ গেরামের চল এইটাই ! আর পয়লা দিনের কথা কইতাছেন বেয়াই সাব ! বাড়ীর বউ যেইদিন পয়লা পরথমবারের মতন তার স্বামী – শ্বশুড়ের ভিটাবাড়ীতে পাও রাখবো , ওইটাই হইবো ঐ বাড়ীর মাইনষের লাইগা বউ বরণ করবার দিন !
বলে একটু থামলেন সালেহা বেগম খানিকটা দম নেবার জন্যই বুঝি ।
– তয় আপনের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে বেয়াই সাব । বিদেশ চইলা যাওনের আগে একবারের লাইগা হইলেও মাইয়ারে একটু শ্বশুড়বাড়ীটা দেখতে পাঠায়েন । শ্বশুড়ের রাইখা যাওয়া ভিটাটা একবার পাড়াইয়াও আইলো । তার লগে লগে শ্বশুড়ের কব্বড়ের সামনে দাঁড়ায়া একটু দুরুদ শরীফ পইড়া দুয়াও নিয়া আইলো ! এতে কইরা মানুষটার আত্বায় শান্তি পাইলেও পাইতে পারে !
শেষদিকে না চাইলেও খানিকটা ধরেই এলো সালেহা বেগমের কন্ঠস্বর !!! ( চলবে )