Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

বিবেকের কষাঘাত

: | : ০৯/০১/২০১৪

জীবনের পথটা কেন যেন হারিয়েই ফেলেছিল জিতু ছোটকালে । বাবা মারা যায় তার বয়স যখন মাত্র ১২ । ছোট দুইছোট দুই এবং বড় এক ভাই ওর ।  চারজন ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাগা মা তার অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ে । বাবার রেখে যাওয়া কিছুই ছিলনা প্রায় তাদের । সেলাইয়ের কিছুটা কাজ জানা মা কাজের পরিসরটা কিছুটা বাড়ান আর বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, টিউশনি করে যা পেত, তাই দিয়ে অতি কষ্টে দিনযাপন করতে হত তাদের ।

অভাব ভাল লাগতোনা জিতুর । বাবা বেঁচে থাকতে খুবই আদর করতো তাকে । ‘তিনভাই চম্পা’ করে বলত তাকে । অফিস থেকে ফিরেই তাকে নিয়ে বসে থাকত সবসময় । জিতুও তাকে শোনাত সারাদিনের গল্প । সারাদিন সে কোথায় কোথায় গেছিল, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটেছিল কয়বার, কার গাছের কি ফল অগোচরে পেড়ে খেয়েছিল, কে কে তার সাথী ছিল, কোন সাথী কখন কি কি করলো ইত্যকার সবই বলা চাই বাবাকে ।

বাবার মৃত্যুর পর জিতুর ডানপিটে স্বভাবটা যখন কিছুতেই বদলানো গেলনা, বরং দিনকে দিন তা বেড়েই চিলল, দিশেহারা মা এবং বড়ভাই ওর, ওকে বিয়ে দিয়ে দিল ওর চেয়ে বেশ বড় এক পাত্রের সাথে । পাত্রটি থাকে শহরে, কিছুই করেনা, বাবার ক্লিনিক-ব্যাবসা আছে, কিছু ভাগ পায় ।

পাত্রটির নীতির কোন বালাই ছিলনা । অর্থ ও নারীপ্রীতিতেই মেতে থাকতো সে । জিতু কিছু বললে সে বলত, যাওনা, তুমিও মেতে ওঠো কাউকে নিয়ে । আমাকে জ্ঞান দিতে এসোনা, যাও । স্বামীর রক্ষিতা-ধরনের এক নার্সকে দেখে নার্সিংযে ভর্তি হয় ও এবং যথারীতি পাশও করে । একসময়  একটি মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে চাকরীও হয়ে যায় ওর ।

আরো উচ্ছৃংখল হয়ে ওঠে জিতু । নার্সিং কলেজে পড়াশুনার সময়ই তার পরিচয় হয় গাঁজার সাথে । স্বামীর রক্ষিতাদের প্ররোচনায় বহুগামিতার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতাও হয় তার । গাঁজার পর মদ, হেরোইন এবং এ-সংক্রান্ত এমন কোন নেশা নাই, যা সে করেনা । চাকরী হওয়ার পর নজর উঁচু হয়ে যায় তার । নাইট ডিউটিতে কিছু ডাক্তারেরও সংস্পর্শে আসে ও । দুর্নাম যখন ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার, তখন ঢাকায় বদলী হয়ে আসে ও এবং স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে পুরোপুরি মূক্ত হয়ে যায় ।

ডাক্তার হীরন ঢাকা মেডিক্যালে চাকরী করেন । পঁয়ত্রিশের উপর হয়ে গেছে বয়স । বিয়ে করেননি । সৌম্য, শান্ত স্বভাবের মানুষ তিনি, চিকিৎসাই বোঝেন শুধু বলেই আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় । ডিউটির সময় শুধু রুগী-ঔষধ, এসবের বাইরে কোনদিকে চোখ থাকেনা তার । কোনদিন কোন নার্সের দিকে চোখ তুলে তাকাননা তিনি । শুধু ঔষধপত্র সম্পর্কে, রূগীর যত্ন-আত্মি সম্পর্কে খোঁজ-খবরের সময় কচিৎ যদি চোখ পড়ে না যায় ।

জিতুর সম্পর্কে হীরন শোনেননি বা তাকে যে তিনি সতর্কভাবে নীরিক্ষা করেননি, তা নয় । কিন্তু তিনি জিতুর মধ্যে একটা অদ্ভুত সরলতা লক্ষ্য করেন অবাক হয়ে, যা তার চরিত্রের সাথে যেন মিলেনা । অবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করেন, জিতুর সেবা করার মানসিকতা  এবং দক্ষতা অন্যদের থেকে উন্নত, যেখানে কোন ফাঁকি পরিলক্ষিত হয়না তাঁর কাছে । নীরবে ক্ষত পরিষ্কার করে যায় সে, ইঞ্জেকশনের সুচ ফোটানো অথবা স্যালাইন সেট করা, রুগীকে ঔষধ খাওয়ানোর সময়জ্ঞান, প্রভৃতি নার্সীয় কাজগুলোতে ও কোন ফাঁকি দেয়না ।

অবশেষে আসে সেই রাত, যেরাতের বদৌলতে পুরোপুরি বদলে যায় জিতু । সুনামের আধার ডাক্তার হীরনের উপরও চোখ ছিল জিতুর । সেদিন ছিল ওদের নাইট ডিউটি, বৃষ্টির রাত ছিল ওটা । জিতু ভেবেছিল, সহজ না হলেও খুব কঠিন হবেনা হীরনকে পেতে, কারন পুরুষ তার কম চেনাতো আর হয়নি ।

কত হবে রাত, তখন! দেড়টা অথবা দুইটা, জীবনের পঁচিশটা বছর আগের ফেলে আসা সেই রাতের কথা  ভেবে আজও শিউরে উঠে জিতু ।  হাতঘড়িটা দেখে নেয় ও, জেলে হীরনকে দেখতে যাওয়ার এখনও সময় আছে আরো দুঘন্টা, যেখানে আজ আবার দেখা হবে তার জীবন পরিবর্তন- করে-দেওয়া অতি প্রানের  হীরনের সাথে ।

গত সাত বছর ধরে জেলে রয়েছেন ডাক্তার হীরন উগ্র মার্ক্সবাদী রাজনীতি করার কারনে । কোথাও একটি খুন হয় বছর দশেক আগে এবং হীরন যেহেতু নেতা, তাই ফেঁসে যান তিনি । অথচ নক্সালপন্থার উপর তাঁর আবেগী সমর্থন ছিল, কিন্তু নক্সালপন্থার শ্রেনীশত্রু খতমের তত্ত্ব তিনি সঠিক মনে করতেননা । কারন তিনি মনে করতেন, এক শ্রেনীশত্রুর জায়গায় আরেকজন শ্রেনীশত্রু আসবে । তাই খুন কোন সমাধান নয় । আর খুনের রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন এক রাজনীতি । এতে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য পার্টি এবং বাস্তবে হয়েছেও তা-ই ।

পরিবর্তিত জিতু আবার ফিরে যান পঁচিশ বছর আগের সেই রাতে । গভীর সেই বৃষ্টির রাতে ওয়ার্ডে ডাক্তারদের জন্য নির্ধারিত কামরায় দেখেন জিতু, আধশোয়া হীরন কি যেন একটা বই পড়ছে ।

কি করেন ? প্রশ্ন করেন জিতু ।

বই পড়ছি, কিছু বলবে ?

জিতু ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করে যান হীরনকে পাবার । কিন্তু পেরে ওঠেননা । হীরন তার দিকে তাকানইনা ।

বলেন, দেখ জিতু, তোমার উদ্দেশ্য আমি বুঝি । তবে তুমি যা চাও আমি তা চাইনা এবং কোনভাবেই তোমার চাওয়া পুর্নতা পাবেনা ।

কেন, কেন আপনি তা চাননা ডাক্তার ! আমার কি নাই, যা আপনি চান ? আর এই নিস্তব্ধতায়, কেউ যখন নাই, কেন হবেনা ?

হীরন তাকে বেরিয়ে যেতে বলেন ।

আরো যেন মরিয়া হয়ে ওঠেন জিতু, কি একটা বলতে যান ।

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হীরন বলে ওঠেন, দেখ, দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে তোমারতো কোন জ্ঞান আছে বলে আমি মনে করিনা, জানতো কেবল উচ্ছৃংখলতা । শোন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নীরব গ্যাসচেম্বারে মৃত্যুপথযাত্রী ইহুদী দুই যুবক-যুবতী কোন ধ্যান-ধারনা থেকে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তেও এই অবৈধকাজ সম্পন্ন করেনি জান ? তারা মনে করত যে, ক্ষেতের বাইরে যে বীজ ছিটকে পড়ে, তা থেকে ভাল কোন শস্য জন্মেনা । তাই তারা ক্ষেতের বাইরে ছিটকে পড়া বীজ হতে চাননি, কারন পৃথিবীতে তারা ওরকম ছিটকে পড়া খারাপ বীজ রেখে যেতে চাননি । প্রতিকী ঐ সংলাপের মধ্য দিয়ে আসলে তারা বিবেকের কাছে সবসময় সৎ থাকতে চেয়েছেন, যুগ যুগ ধরে যাতে পৃথিবীতে সততার ধারা অব্যহত থাকে । প্রজন্মান্তরে তারা সততার এই বীজই রোপন করে যেতে চেয়েছেন । মূহুর্তের লোভের কাছে আমি কখনও পরাজিত হবোনা, বেরিয়ে যাও এখান থাকে এখনই । শেষের কথাটা চিৎকার করে বলেন হীরন ।

পোষাক সামলে হীরনের মুখের দিকে জিতু তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন । এমন কথাতো শোনেননি কোনদিন তিনি । একোন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আজ তিনি ? পায়ের কাছে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন জিতু অনেকক্ষন । আরো কি ভাবছিলেন তখন তিনি, আজ মনে পড়ে সেসব কথা তার । অনুশোচনা আসে তার মধ্যে, প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মন তার ব্যকুল হয়ে উঠে তখন । কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলেননা কেমন করে তা করবেন । শেষে পা ধরে পড়ে রইলেন হীরনের ।

হীরনও বাধা দিলেননা, বুঝে গেছেন তিনি, কালিমা দূর করতে চান জিতু এবং কিছুক্ষন তা দিলেনও করতে ।

বেরিয়ে আসেন তিনি একসময় হীরনের রুম থেকে ।

এই পঁচিশটা বছর হীরনের সঙ্গে ঘর না করলে জিতু জানতেননা স্বাভাবিক ঘর-সংসারের বাইরেও অনেক ভাল একটা জগৎ আছে । বখে যাওয়ার হাতছানি যেমন আছে সেখানে, তেমনি আছে বেরিয়ে আসার মত মনোবলও । পৃথিবীতে বোধহয় মার্ক্সবাদই পারে মানুষকে এমন আবেগী করে তুলতে । পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতভেদ থাকলেও সারাবিশ্বে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ যত মানুষের মধ্যে উন্নত চিন্তা-চেতনার জন্ম দিয়েছে, অন্যকোন মতবাদ তা দেয়নি । আবার অধঃপতিত হলেও এরাই হয়েছে তা সবচেয়ে বেশী ।

অনেককে বলতে শুনেছেন জিতু, এই মতবাদ ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক । তেমনটিও কিন্তু তিনি দেখেননি । হীরনসহ এই মতবাদের সমর্থক আরো অনেককে তিনি নামাজসহ অন্যান্য ধর্মীয় আচার-আচরণগুলি পালন করতে দেখেছেন ।

নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছে তাঁকে আজ । হাতঘড়িটা দেখে ছটফট করে উঠেন তিনি । ছয়মাস পর আবার দেখতে পাবেন তিনি তার অতি প্রিয় পথপ্রদর্শক এবং আপনজন, হীরনকে । ছূঁতে হয়তো পারবেননা, কিন্তু দশ-পনেরোটা মিনিট তাকিয়ে তো থাকতে পারবেন তাঁর দিকে অতি নিবিষ্টে, আগামী ছয়মাসের জন্য সেটিই যে হয়ে থাকবে তাঁর একান্ত পাথেয় ।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top