Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ধারাবাহিক উপন্যাস ‘নিয়োগ পত্র”-একবিংশ এবং শেষ পর্ব

: | : ১৩/০১/২০১৪

একবিংশ এবং শেষ পর্ব
(বাইশ)
পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোতে দুঃসহ যন্ত্রনার সিঁড়ি বেয়ে তিল তিল করে এগিয়ে এসেছে তিমির। আজ মৃত্য তার দুয়ারে দাড়িয়ে প্রতীক্ষা করছে। ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এক একটি মুহুর্ত। জানালায় দাড়িয়ে সেই অতীতেই ফিরে গিয়েছিল তিমির। অনেক কাঁদলো। তবুও হালকা হতে পারলো না। জীবনের অন্তিম মুহুর্তে সমস্ত আনন্দ বেদনার স্মৃতিগুলো এক এক করে ভেসে উঠে চোখের সামনে। আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার একটা ব্যর্থ প্রয়াস। অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার প্রবল ইচ্ছা জাগে। স্বচ্ছ আয়নায় ভেসে উঠে বেকার জীবনের অভিশপ্ত দিনগুলো। তারপর কেমন করে যে জীবনের মোড় ঘুরে গেল ভাবতেও অবাক লাগে।
মনে পরছে শিউলী তলায় ফুল কুড়োবার দিনগুলোর কথা। বেশ ভালোই ছিল দিনগুলো। শীতের কুয়াশায় ভিজে যেতো দু’টো পা। শিউলী ফুলের গন্ধে মন ভরে উঠতো। সাঁঝি ভরা ফুল নিয়ে মালা গাঁথতো তিমির। দেবতার অর্ঘ্য দেওয়ার জন্য। দেবতা সন্তুষ্ট হতো কিনা কে জানে। তবে খুব আনন্দ পেতো।
চৈতীও হারিয়ে গেছে তিমিরের জীবন থেকে। চৈতীর ভালোবাসা পেয়ে অনেকদিন বাঁচবে ভেবেছিল। হলুদ খামটা নিয়ে যখনি অফিস থেকে অফিসে ঘুরে বিকালে একটি বারের জন্য দেখা হতো, তখন মুছে যেতো সমস্ত ক্লান্তি। বলতো তুমি তো আর বসে নেয়। চেষ্টা তো কম করছ না। সেই যে রোজ বসে বসে মালা গাঁথতে তাই ভগবান তোমাকে এত শাস্তি দিচ্ছে। তিমির বলতো-হ্যাঁ চৈতী তুমি ঠিকই বলেছো। আচ্ছা আমার যদি কিছু একটা না হয় তখন তোমার কি হবে।
– কি হবে না হবে সে পরে দেখা যাবে। রেগে যেত চৈতী। দেখবে তুমি একদিন পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষটি হবে।
– আর তুমি।
তিমির জানে না। চৈতী সুখী কি অসুখী। যেদিন হারিয়ে যাচ্ছিল সেদিন খুব হাসলো তিমির। অকারনে হাসি আসতো। সে হাসি কেউ থামাতে পারেনি। যাবার সময় নিয়ে গেল শাঁখা, সিঁদুর আর লাল টুকটুকে বেনারসি। পাশে একজন নতুন মানুষ। মাথায় মুকুট। তিমিরের চেয়েও শতগুন শ্রেয়। একটা ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিমির আড়ালে ছিল না। একেবারে সামনা সামনি ছিল। নিজের হাতে প্যান্ডেল করেছে। বরযাত্রী খাইয়েছে। বিয়েতে কত কাজ। সে সমস্থ দেখ ভালো করেছে। কন্যা সম্প্রদান হচ্ছে। মালাবদল হচ্ছে। একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখেছে। এসব দেখে কেবল হাসছিল আর বলছিল-এইতো সুখ। পৃথিবীর কোথায় আছে এত আনন্দ।
বিয়ের অনুষ্টানে তিমির ছিল নীরব স্বাক্ষী। বরের গলায় মালা পরিয়ে দেওয়ার সময় মনে হয়েছিল-চৈতী এই মালা কি আর কাউকে দিতে পারে না। এই মুহুর্তে যদি সৃষ্টিকর্তার কৃপায় একটা বিরাট পরিবর্তন আসতো তবে ভালো হতো। কিংবা এমনতো হতে পারত-প্রচন্ড একটা ঝড় এসে বিয়ে বাড়ীর সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। শুধু রয়ে গেল চৈতী আর আমি। আমাদের বাঁচতে হবে। বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে অগ্নি শপথ করতাম। তারপর চৈতীর সাথে মালা বদল হতো। দু’জনেই সুখী হতাম। জানালার পাশে দাড়িয়ে কথাগুলো মনে পরতেই তিমির কাঁদতে কাঁদতে হাসলো। কি বোকার মতোই না ভাবছে এতদিনের পুরানো কথাগুলো। হয়তো চৈতীর মনেই নেয়।
বিয়ের পিড়ি থেকে উঠে চৈতী তিমিরকে প্রনাম করতে চাইলো। তিমির পা সরিয়ে নিয়ে শুধু বলেছিল তুমি সুখী হও। তারপর হাটতে হাটতে চলে গেল উঠোনের দিকে। তিমির পেট ভরে বিয়ের খাবার খেয়েছিল। তিমিরের দুঃখটা কাউকে বুঝতে দেয়নি। সবাই পেয়ে সুখী। তিমির হারিয়ে সুখী। তিমির ভুলেও কখনও চৈতীকে দোষ দেয়নি। বরং বলেছিলো তোমাকে হারিয়ে আমার যা থাকবে আমি তাতেই খুশী। তুমি ভেবোনা। এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে তোমাকে ধরে রেখে শুধু কষ্টই বাড়বে। পারলে আমাকে ভূলে যেও।
ইউক্যলিপ্টাসের পাতা গুলো সেদিন বরের মাথায় ফুলের পাপড়ির মতোই ঝড়ে পরছিল। বিছানায় শুয়ে বুকের ব্যাথাটা আবার চিন চিন করে উঠল। একবার মনে হলো সন্ধ্যার পর থেকে কেউ আসেনি। মফিজ, মন্টু, আব্দুল, স্বপন সবাই এসে সান্তনা দিয়ে গেল। বলল-তুই চিন্তা করিস না। তাড়াতাড়ি সেরে উঠবি। চৈতী রক্ষনশীল সমাজের গৃহবধূ। তাই হয়তো আসতে পারেনি।
ছোট ভাইটাও আসেনি। তিমির একা নিঃসঙ্গ শুয়ে আছে। যন্ত্রনার প্রহর কেটে যায় একের পর এক। পাশ ফিরে শুতেই সিস্টার উঠে এসে জিজ্ঞাসা করে-এখনও ঘুমাননি।
– ঘুম আসছে না। সন্ধ্যার দিকে আপনার ভাই এসেছিল। আপনি ঘুমিয়েছিলেন। আর জাগায়নি। আপনাকে ভালোমত দেখার কথা বলে ও চলে গেল। কোথায় নাকি যাবে।
– কোথায় আর যাবে। বাবা হয়তো ছোট কাকার বাসায় যেতে বলেছে। কিছু টাকা ধার করার জন্য। কে দেবে টাকা বলুনতো। কিছু পেলে কিছু দেয়। আমি মরে গেলে ওদের এত কষ্ট হতো না। ভাগ্যের কি নির্মম বাস্তবতা। আমার জীবন দিয়ে ওকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা। অথচ–।
– আপনি ভাববেন না। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– আমাকে একটু পানি দেবেন। গলাটা শুকিয়ে আসছে।
তিমির পানি খেয়ে আবার বালিশে মাথা রাখে। ভোর রাতের ঠান্ডা হাওয়ায় জানালার পর্দা গুলো দুলছে। এবার বুঝি একটু ঘুম আসবে। কতক্ষন ঘুমিয়েছিল খেয়াল নেয়। জানালা দিয়ে রোদের ঝিলিক গায়ে এসে লাগছে। চোখ খুলতেই সিস্টার বলল-আপনার বাবা আর বোন এসেছে। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে। এখন কেমন লাগছে।
– ভালো। প্লিজ ওদের আসতে বলেন।
– ঠিক আছে। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
জগদীশ বাবুর চোখ দু’টো জলে ছল ছল করছে। এ যেন আনন্দের কান্না। তিমিরও নিজেকে একটু হালকা বোধ করছে। শম্পা দাদাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। জগদীশ বাবু চোখ মুছে পাঞ্জাবীর বুক পকেট থেকে একটা হলুদ খাম বের করে বলে এই নে বাবা তোর নিয়োগ পত্র। ভগবান এতদিনে তোর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
তিমির খামটা হাতে নিয়ে শম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কখন যে দু’ফোটা চোখের জল শম্পার মাথায় পরেছে খেয়াল করেনি।

সমাপ্ত

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top