দুষ্প্রাপ্য
একদিন সন্ধ্যার পর মোবাইলে কল এলো। রিসিভ করতেই জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি মামুন ভাই?
একটা মেয়ের সুন্দর কণ্ঠ। স্পষ্ট উচ্চারণ।
বললাম, হ্যাঁ, বলছি।
আপনি কি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েন?
আমি বললাম, আগে পরতাম।
সে সরি বলে কেটে দিল।
দুই মিনিট পর আবার তার ফোন এলো। জানতে চাইলো, এটা কোথায়, একটু বলবেন প্লিজ।
আমি বললাম, খুলনা।
সে ব্যস্ত হয়ে বলল, সরি, সরি।
আমি খুব আশ্চর্য হলাম। কারণ আমার নামও মামুন। নাম্বারটা আমি সেভ করে রাখলাম।
পরদিন সকালে এরকম একটা এসএমএস এলোঃ
মামুন ভাই আপনি কোথায়? আপনার অবস্থান কিছুতেই জানতে পারছি না। কিছুক্ষণ পরেই পরীক্ষা শুরু হবে। প্লিজ, তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করুন।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
বিকেলে আবার এসএমএস এলোঃ
আপনি মামুন ভাই? ফাজিল কোথাকার। মিথ্যা কথা বলে খুব শান্তি পান বুঝি?
এবারও আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
এরপর আর কল আসেনি। আমিও যোগাযোগ করিনি। আট মাস পর মনে হলো তার সাথে পরিচিত হলে ক্ষতি কি। একটু ভয় নিয়ে ফোন করলাম। কণ্ঠ শুনেই বুঝলাম পূর্বের সেই মেয়েই। তার ফোন এবং এসএমএসের কথা জানালাম। তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম।
সে জানালো, তার নাম তমা। গুলশানে থাকে।
আমার সম্পর্কেও জানতে চাইলো। জানালাম, কুয়েটে চাকরি করি।
বিরক্ত না হয়ে এতটা সময় আমার সাথে কথা বলার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানালাম। সেও জানালো, আপত্তিকর কথা না বললে বিরক্ত না হওয়াই তো উচিৎ।
পরদিন সে এসএমএস দুটো ফরোয়ার্ড করতে বলল। এতদিন ওগুলো মুছে দিইনি বলে নিজের উপর খুব খুশি হলাম। সাথে সাথে এসএমএস দুটো ফরোয়ার্ড করলাম।
দুইদিন পর সে জানালো, মামুন নামের একজনের কাছে সে প্রাইভেট পড়তো। এসএমএস পাঠানোর দিন তার পরীক্ষা ছিল। সেদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে পরীক্ষা কিছুটা হলেও ভালো হতো। একটা ডিজিট ভুল হওয়ায় আমার মোবাইলে কল এসেছিল।
কিন্তু এরপর বলল, অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি যে আপনার নাম মামুন না।
বললাম, প্রমাণ করে দেখতে পারেন।
সে বলল, প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন আমার নেই।
মন থেকে কিছুতেই বিষয়টা ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। একটা মেয়ে আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করবে, এটা তো হতে পারে না। তাই ফোন করে তমাকে বুঝিয়ে বললাম। এবার সে একটু নরম হলো। বলল, আসলে ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। ফোন করলাম একজনের কাছে। ভুলক্রমে আপনার কাছে চলে গেল। তার নাম আর আপনার নাম একই। এটা কিভাবে সম্ভব?
অবশেষে সে বিষয়টা অলৌকিক হিসেবে মেনে নিল। আমিও তৃপ্তি পেলাম।
এরপর থেকে আমাদের মধ্যে কথা চলতে থাকলো। একদিন সে জিজ্ঞেস করলো, আপনি দেখতে কেমন?
নিজের সম্পর্কে উত্তরে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সে আমার গায়ের রং, উচ্চতা, প্রিয় পোশাক, প্রিয় রং, প্রিয় খাবার ইত্যাদি জেনে নিল।
আমিও জানতে চাইলাম, তার চুল কেমন? সে জানালো, অনেক লম্বা।
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। কারণ লম্বা চুল আমার খুব পছন্দ। আমার মনে হয়, খোপা নারীত্বকে ফুটিয়ে তোলে। এরপর জানালো, সে দুধে-আলতা ফর্শা। একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা আমেরিকায় থাকেন।
একসময় সে বলল, আমাদের এই সম্পর্কটাকে আমরা কি বলতে পারি?
বললাম, আমরা একে অপরের বন্ধু।
সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ঠিক আছে, আমরা একে অপরের বন্ধু। আর পরস্পরকে আমরা তুমি করে বলবো।
পর মুহূর্তেই সে আমাকে তুমি করে সম্বোধন করলো। কিন্তু আমি পারলাম না। বললাম, আমার এখনই বলতে সংকোচ লাগছে। আমার কয়েকদিন সময় লাগবে।
খিল খিল করে হেসে ফেলে সে বলল, তুমি এতো লাজুক!
কিছুদিন পর আমিও তুমি বলা শুরু করলাম।
তমার সাথে দেশি-বিদেশি সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি নিয়েও কথা হয়। ইন্টারমিডিয়েটে পড়াকালীন বই কেনা, বই পড়া প্রবন্ধ পড়েছিলাম। পরবর্তীতে অনেক বই পড়ার পর এখন সেসব প্রবন্ধের সত্যতা টের পাই। বুঝতে পারি যে ভালো ভালো বই পড়লে স্রোতে গা ভাসিয়ে যা খুশি তাই করে বেড়ানো যায় না। মানুষের প্রতি মমত্ববোধও বৃদ্ধি পায়। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যের পথে চালিত হতে উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়। ফলে জীবন সফলতার দিকে এগিয়ে যায়। তমার সাথে কথা বলে জানলাম, এই বয়সেই অনেক ভালো ভালো বই সে পড়ে ফেলেছে। তাই তার সাথে যোগাযোগ ঘটে যাওয়াটা আমার জীবনের একটা বিরাট প্রাপ্তি বলে মনে হলো।
একটি অনুষ্ঠানে সে ভায়োলিন বাজাবে বলে ঢাকা যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথিও থাকবে। তার ইচ্ছা, সে ভায়োলিন বাজাবে আর আমি সামনে বসে দেখবো। কিন্তু আমি গেলাম না।
পরে ফোন করে সে তার কষ্ট প্রকাশ করলো। বলল, অনুষ্ঠানে সবার প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু আমি আয়োজকদের বলে তোমার প্রবেশের ব্যবস্থা করেছিলাম। তুমি না আসাতে তাদের কাছে আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। অথচ ভেবেছিলাম, আমি একটা পোশাক পরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থাকবো, তুমি আমাকে চিনে নেবে।
আমি তার ফটো চেয়েছিলাম। কিন্তু সে রাজী না হয়ে জানিয়েছিল যে আমি তো ইচ্ছা করলে তাকে সামনাসামনিই দেখতে পারি।
একদিন বলল, আমরা আমেরিকায় চলে যাবো। তুমি যাবে ওখানে?
আমি বললাম, তা তো সম্ভব নয়। কারণ দেশে থেকে আমার কিছু বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা আছে।
সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, তুমি লেখালেখি করো?
আমি বললাম, না না আমি লেখালেখির অ, আ-ও জানিনা। আমার বাবার প্রবন্ধ টাইপের অনেক লেখা আছে। আমরা অনেকগুলো ভাই-বোন। একজন শিক্ষক হয়ে আমাদেরকে মানুষ করার জন্যই তিনি সারাজীবন হিমশিম খেয়েছেন। তাই তার লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেননি। আমি তা করতে চাই। আমাদের পরিবারের আর কারও তা করার মতো মানসিকতা নেই।
সে হতাশ গলায় বলল, ও আচ্ছা।
এক সময় তার মোবাইল বন্ধ পেলাম। এরপর দিনের পর দিন তার সাথে কথা বলতে না পেরে বুঝলাম সে আমার কাছে কি। এভাবে তিন মাস কেটে গেল। হঠাৎ একদিন কল ঢুকল।
সে বলল, তোমার সাথে কথা বলতে বলতে তোমার প্রতি খুব মায়া জন্মে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি তো এ দেশ ছেড়ে চলেই যাবো। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে লাভ কি। তাই মোবাইল বন্ধ রেখেছিলাম।
আমার অনুরোধে মোবাইল চালু রাখলো। জানলাম, ওর মা আমেরিকায় চলে গেছেন। কিছুদিন পর সেও যাবে।
বললাম, তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। তুমি চলে গেলে আমার কি হবে?
সে বলল, আবার ফিরে আসবো।
হঠাৎ একদিন জানালো, পরদিন রাতে তার ফ্লাইট। আমাকে ঢাকায় যেতে বলায় প্রথমে রাজি হলাম না। বলল, আগেও আসতে বলেছিলাম, আসোনি। এবারও আসবে না? অত দূরে যাচ্ছি, কোনো দুর্ঘটনাও তো ঘটতে পারে।
এমনভাবে বলল, আমি রাজি হয়ে গেলাম।
রাতে রওনা হয়ে ভোরে গাবতলী পৌছলাম।
তমা গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে এলো। ও লাল পোশাক পরেছে। সে বেশ লম্বা, ফর্শা। চুলও অনেক লম্বা। পায়ে কালো স্যানডাল। সে এত সুন্দর যে, দেখে আমি অভিভুত হয়ে গেলাম। মনে হলো, আমাকে দেখে সেও মুগ্ধ।
তাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ফ্রেশ হবার পর খাবার টেবিলে নিয়ে গেল। হেসে বলল, আমি জানি তুমি একটা পেটুক, তাই সেভাবেই রান্না করিয়েছি।
দেখলাম, তার কথা মিথ্যা নয়।
তার রুমে নিয়ে বলল, জার্নি করে এসেছ, হালকা ঘুম দাও।
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙতেই দেখলাম, তমা পড়ছে। সে স্কার্ট আর টপস পরে ছিল। খুব সুন্দর লাগছিল।
সে বিছানায় আমার কোমরের কাছে বসে বলল, কয়েক মাস পরই শুধু তোমার জন্য দেশে ফিরবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তমাকে আদর করার খুব ইচ্ছা জাগলো। কিন্তু জানি, আল্লাহ্ না চাইলে আমাদের মিলন হবে না। সেক্ষেত্রে এটা করলে পরে সে আমাকে ঘৃণা করবে। ভাববে আমি একজন খারাপ মানুষ। তখন আমাকে তার মন থেকে ছুড়ে ফেলবে। তার মতো একটা মেয়ের মনের ভিতরে আমি স্থান পেয়েছি এটা আমার সৌভাগ্য। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে একাকি বসবাস করার আরামের চেয়েও তমার মনের ভিতরে আমি আছি এটাই বেশি সুখের। এই সুখ জীবনের নানা দুঃখ, কষ্ট এবং গ্লানি দূর করে বাস্তবতাকে মোকাবেলা করার উদ্যম পাওয়ার জন্য একান্ত প্রয়োজন। তাই এই মেয়েটির মনে চিরকাল আমি থাকতে চাই। সেজন্য নিজেকে সংযত করলাম।
বিকেলে সে ভায়োলিন শোনালো। এক সময় খুলনা যাবার জন্য তৈরি হলাম। আমাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্য সে গেঞ্জি ও ফুল প্যান্ট পরে এলো।
রাত বারোটায় ওর ফ্লাইট। তাই তার দুই বাহু ধরে ঝাকি দিয়ে কপাল এবং মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, আমার সাথে যেতে হবে না।
তখন তমা চোখ বন্ধ করে ছিল। ও বলল, তুমি এসেছ বলে খুব খুশি হয়েছি।
বিদায় নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো আমার দিকে। মুখে হাসি। মোবাইল ফোনটার কথা মনে পড়ল। কারণ, এটা ছিল বলেই তমার মতো দুষ্প্রাপ্য একটি মেয়ের ভালোবাসা পেয়েছিলাম।